বিজ্ঞানের গল্প আমাদের সকলের কাছেই আকর্ষণীয়—যদি তা হয় সহজ-সরল ভাষায়। দাঁত-খটমটে কতোগুলো নাম আর আঁকাবাঁকা কতগুলো জটিল চিহ্নের ভেতরে বিজ্ঞানের যে রহস্যময় আনন্দ পুরে দেওয়া আছে,তাকে সাধারণের জন্য তুলে ধরা বেশ সহজ কাজ নয়। আমাদের দেশে বিজ্ঞানের আনন্দ সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে যেক’জন নমস্য ব্যক্তি উদ্যোগী হয়েছিলেন,তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ আল মুতী অগ্রগণ্য। বিজ্ঞানের আনন্দ সাহিত্যের আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি তৈরি করেছিলেন তার স্বতন্ত্র ভুবন। “আবিষ্কারের নেশায়” তার তেমনই এক বিশিষ্ট রচনা। এর প্রথম প্রকাশ ১৯৬৯ সালে। বইটির জন্য সে বছরই ইউনেস্কো পুরষ্কার পেয়েছিলেন লেখক।
বিজ্ঞানের আলাপ করতে বিজ্ঞানীদের গল্প বলার একটা আলাদা মাজেজা আছে। ‘বিজ্ঞানী’ শব্দটা শুনলেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে এমন এক অবয়ব, যাঁর মাথাভর্তি টাক, অথবা উশকো-খুশকো চুল, চোখে পুরু কাঁচের চশমা, নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়ে একমনে তিনি হয়তো বসে আছেন তার ল্যাবরেটরিতে—কিন্তু তার চিন্তা পাড়ি দিয়েছে দূর দিগন্তে—আমাজনের জঙ্গল, তুহিন-শীতল মেরু, পৃথিবীর বাইরে মহাশুন্য কিম্বা লক্ষ-কোটি মাইল দূরের কোনো গ্রহ-উপগ্রহ বা নক্ষত্রে। বিশ্বচরাচরে সত্যের সুপ্ত ভাণ্ডারকে উন্মুক্ত করার গুরুদায়িত্ব যে তাদের ঘাড়ে! সুপরিচিত তেমনি ক’জন বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের গল্প দিয়ে সাজানো আবিষ্কারের নেশায়” বইটি। পাশাপাশি লেখক টেনেছেন ইতিহাস, বলেছেন সেসবের পেছনের গল্প, এনেছেন প্রাসঙ্গিক সব আলোচনা আর বিশ্লেষণ, দেখিয়েছেন আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীদের কী অদম্য নেশা!
বইটিতে রয়েছে মোট সতেরটি অধ্যায়। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর ১৪টি আবিষ্কারের গল্প। আর্কিমিডিস, গ্যালিলিও, লিউয়েন হুক,আইজ্যাক নিউটন, লুই পাস্তুর, কুরি দম্পতি, আইনস্টাইন, ডারউইন—নামগুলো আমাদের মোটেই অপরিচিত নয়। বিজ্ঞানের এই রথী-মহারথীদের আবিষ্কারই তো বদলে দিয়েছে আমাদের আজকের চিন্তাজগৎকে,আমাদের জীবনকে। খুব সহজ ভাষায় তাদের সেই সব অসাধারণ আবিষ্কারের গল্প আমাদের শুনিয়েছেন আব্দুল্লাহ-আল-মুতী। ‘সাদা চাল লাল চাল’, ‘বিজলি এলো হাতের মুঠোয়’, ‘ব্যাঙ নাচানো বিজ্ঞানী’, ‘সুন্দর হে,সুন্দর’—বইয়ের শিরোনামগুলোও কম রসালো নয় মোটেই!
বইয়ের শুরু হয়েছে “একটি মানুষ আর একটি বাহিনী” গল্পের মাধ্যমে—আর্কিমিডিসকে দিয়ে। সিসিলি দ্বীপেরএকাগ্রচিত্ত সাধাসিধে লোকটি কিভাবে ঠেকিয়ে দিলেন গোটা রোমান বাহিনীকে, কেমন করে নির্ণয় করলেন সিরাকিউজ রাজার মুকুটে ভেজালের পরিমাণ—তাই দিয়ে শুরু হয়েছে আবিষ্কারের গল্প বলা। এরপর গ্যালিলিও কিভাবে দেখালেন পড়ন্ত বস্তুর গতি বিষয়ক অ্যারিস্টটলের বক্তব্যের অসারতা,সত্য কথা বলার জন্য কী শাস্তি পেতে হয়েছিল তাকে; অ্যান্টনি লিউয়েন হুকের বৈজ্ঞানিক প্রতিভায় অভিভূত রুশ অধিপতি জার মাইক্রোস্কোপ দেখার জন্য কীভাবে ছুটে এসেছিলেন; নিউটন কীভাবে ব্যাকবেঞ্চার থেকে হলেন দুনিয়ার সেরা বিজ্ঞানী; মৃত ব্যাঙ থেকে কীভাবে ব্যাটারি আবিষ্কারের তত্ত্ব খুঁজে পেলেন গ্যালভানি; লুই পাস্তুর কীভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন একটি আসহায় ছেলেকে, কী করে আবিষ্কার করলেন জলাতঙ্কের প্রতিষেধক;কেবল পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণের জোরে কিভাবে বিশ্বকাঁপানো ক্রমবিবর্তন তত্ব আবিষ্কার করলেন চার্লস ডারউইন—পাঠকের জন্যে এসব রোমাঞ্চকর গল্পের ডালি সাজিয়েছেন লেখক,আর বইয়ের শেষ দিকে দিয়েছেন বিজ্ঞানী হবার মন্ত্র।
বইটি মূলত লেখা কিশোরদের জন্যে,তবে ছোটো-বড় যে-কেউই বইটি পড়ে আনন্দ পাবেন। বয়সে-বড় কেউ পড়লে হয়তো আপত্তি করতে পারেন অতি-সারল্যের কিংবা বিজ্ঞানীদের করা গবেষণার খুব ভেতরে না ঢোকার। এ-সমালোচনাটুকু যৌক্তিক,কিন্তু কিশোরপাঠ্য বই হিশেবে বোধহয় এটুকু ছাড় দেওয়াই চলে! ওই একই কারণে বইয়ের বর্ণনার ঢঙ ভীষণ ঋজু ও সাবলীল। ভাষার প্রবহমানতা অসাধারণ—কোথাও বিন্দুমাত্র দুর্বোধ্যতা-জড়তা নেই। বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবন,জীবনের বাধাবিপত্তি—যেগুলোকে অতিক্রম করে এই মহান মানুষেরা হয়েছিলেন বিশ্বমানবের—এবং তাদের সংগ্রামের গল্প পাঠক এ বইতে পাবেন। বিজ্ঞানীদের জীবনীর একটি বিশেষ দিক বোধ করি এটাই যে,তারা বরাবর মিশে ছিলেন সহজসাধারণের মধ্যে,সেই সাধারণত্বের মধ্যেও তারা নিজেদের প্রতিভার বলে বুঁদ থেকেছেন আবিষ্কারের নেশায়—বিজ্ঞানের প্রসারে। এরপরেও তাদের চরিত্রের অনাবিল রূপটি ছিলো সদা-সমুজ্জ্বল। নিউটনের কথাই ধরা যাক। কতো অজানা পথের দিশাই না তিনি দিয়ে গেছেন মানবজাতিকে,তারপরেও বিনয়ী কণ্ঠে বলেছেন—
নিজের কাছে মনে হয় যেন আমি ছোট শিশুর মতো সাগরের তীরে শুধু নুড়িই কুড়িয়ে বেড়ালাম—কোথাও একটু মসৃণ নুড়ি অথবা একটু সুন্দর ঝিনুক। বিশাল জ্ঞানের সমুদ্র আমার সামনে অজানাই পড়ে রইল!
অন্যান্য বিজ্ঞানীদের জীবনেও এই দিকটি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে আব্দুল্লাহ আল মুতীর লেখায়!
বইটি পড়তে পড়তে আপনি হারিয়ে যাবেন ইতিহাসের পাতায়, সাক্ষী হবেন অনেক আবিষ্কারের, নিজেকে খুঁজে পাবেন মহাকালের যাত্রায় কয়েকজন বিশিষ্ট মানবের জীবনের মধ্যে—সংবেদনশীল দর্শকের ভূমিকায়,বিজ্ঞানের ক্রমবিবর্তনশীল যাত্রায় আবিষ্কার করবেন নিজেকেও। নিঃস্বার্থভাবে এইসকল বিজ্ঞানীরা স্বার্থপর পৃথিবীকে দিয়ে গেছেন দুহাত ভরে,নিয়ে যেতে পারেননি কিছুই—কিন্তু জীবনের একটা সময়ে আমরা তাদের চিনতেই পারি নি,বরং ধিক্কার-গঞ্জনা-উপহাসে নিগৃহীত করেছি তাদের। বইটি আশা করি পাঠককে গড়ে দেবে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি—বিজ্ঞান,বিজ্ঞানের দর্শন ও বিজ্ঞানীদের প্রতি!
Leave a Reply