পৃথিবীতে কেবল মানুষই নিজেদের সভ্য করার জন্য সমাজ গড়েনি, নিজেদের শৃঙ্খল করে রাখার চেষ্টা করেছে ভ্রমর আর বোলতারাও। এদের রাজ্যে রানি আছে, তারা শ্রমবণ্টন করে, খাদ্যের সন্ধানে বের হয়, পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা দেখায়। এরা আন্দোলন করে, তারা শত্রুদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার কৌশলও জানে। আবার অন্যের পরিশ্রম করে জমানো খাদ্য আর শাবকদের অপহরণ করা কিংবা হত্যা করার নজিরও আছে এদের সমাজে। এসব দেখা যায় ভিমরুল আর বোলতাদের রাজ্যেও। শ্রেণিবিন্যাসগত দিক দিয়ে বোলতা আর মৌমাছিরা বেশ কাছাকাছি। তবে মৌমাছি আর ভিমরুল-বোলতাদের মাঝে ফারাক আছে। প্রায় ১২০ মিলিয়ন বছর আগে বোলতাদের থেকেই মৌমাছি প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল। বর্তমানে বোলতাদের প্রজাতির সংখ্যা এক লাখ। আর মৌমাছি আছে ২২ হাজার প্রজাতির। আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল লিখেছিলেন, ‘মৌমাছিদের এমন কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে, যা ভিমরুল আর বোলতাদের নেই।’
যোগাযোগ
জীবন-যাপনের জন্য আমরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলি, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করি অন্য মানুষের কাছে। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমরা ব্যবহার করেছি কোনো না কোনো ভাষা। প্রয়োজনের খাতিরে সেসব ভাষার সংস্করণও হয়েছে অনেকবার। তেমনি ভ্রমর আর বোলতারাও একাকী জীবন কাটায় না। তাদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য রয়েছে বিচিত্র কৌশল। তারা কথা বলে রাসায়নিক আর কম্পনের ভাষায়। মৌমাছিরা তাদের উদরকে ব্যবহার করে এক ধরনের কম্পন সৃষ্টি করে অন্য মৌমাছিদের কাজের জন্য প্রস্তুত হবার সংকেত প্রদান করে। বোলতারাও খাদ্যের সন্ধান পেলে সেটা জানিয়ে দেয় অন্য বোলতাদের। এ জন্য তারা তাদের পেট দিয়ে চাক বা বাসার দেয়ালে ক্রমাগত আঘাত করে কম্পন তৈরি করতে থাকে। বোলতার লার্ভারা খিদে পেলে পপিং (কীটপতঙ্গের বিচিত্র শব্দ) করে বড়দের কাছে খাবারের জন্য বায়না ধরে। তা ছাড়া খাদ্যের সন্ধানে যেতে হবে- এ জন্য ডাকতে হবে সঙ্গীদের, তখন মৌমাছি আর বোলতারা একপ্রকার রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে।
অন্যদিকে রানি আর পুরুষ মৌমাছিরাই প্রজননে সক্ষম। শ্রমিকরা প্রজননে সক্ষম নয়। আসলে এদের সক্ষম হতে দেয় না রানি মৌমাছি। এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে। এই রাসায়নিক অন্য মৌমাছিদের শারীরিক গঠনকে প্রভাবিত করে এবং এদের প্রজনন ক্ষমতাকে দমিত করে রাখতে পারে। কোনো মৌমাছি খাবারের উৎস খুঁজে পেলে অন্যদের জানানোর সঠিক অবস্থান জানাতে নাচানাচি করে। এই দিক দিয়ে মৌমাছিরা বোলতাদের থেকে আলাদা।
বুদ্ধির চর্চা
মৌমাছিরা গণিতেরও চর্চা করে। তাদের মধ্যে আছে সংখ্যার মৌলিক উপলব্ধি। এরা শূন্যের মানে বুঝতে পারে। করতে পারে সংখ্যার যোগ-বিয়োগ। এমনকি এরা জটিল নেভিগেশন সমস্যাও সমাধান করতে পারে। এ ধরনের সমস্যা ট্র্যাভেলিং সেলস পারসন প্রবলেম হিসেবে পরিচিত। ধরা যাক, আপনাকে বিভিন্ন শহরের একটা তালিকা দেয়া হলো। প্রতি দুইটি শহরের মাঝের দূরত্বও বলে দেয়া হলো। এখন আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হলো একটা নির্দিষ্ট শহর থেকে শুরু করে সব শহরে একবার ঘুরে আবার প্রথম শহরে পৌঁছার ক্ষুদ্রতম পথ কোনটি হবে? এমন ধারার সমস্যাগুলোই ট্র্যাভেলিং সেলস পারসন প্রবলেম হিসেবে পরিচিত। মৌমাছিরা একে অন্যের ভাবনা নিয়ে ভাবতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় মেটাকগনিশন।
মৌমাছিরা মানুষের মুখমণ্ডল অন্তত দুদিন অবধি মনে রাখতে পারে। বোলতারাও কিন্তু যুক্তিবিদ্যা কিছু কম জানে না। এদের আছে ইন্টারেনশিয়াল রিজনিং বা অনুমানমূলক যুক্তির পারদর্শিতা। যদি A, B থেকে বড় হয় এবং B, C থেকে বড় হয় তাহলে A ও C থেকে বড় হবে। বোলতারাও এ ধরনের যুক্তি বুঝতে পারে। এরা চাকের অন্য সঙ্গীদের চেহারা মনে রাখতে পারে। পরিচিত সঙ্গীদের চিনতে পারে আলাদাভাবে। ভ্রমর আর বোলতাদের এই বুদ্ধি চর্চা প্রকৃতির এক আশ্চর্য লীলার উদাহরণ। এদের মগজের আকার হয়তো একটা পোস্ত দানার সমান হবে। কিন্তু এদের যুক্তিজ্ঞান সত্যিই অসাধারণ।
স্থাপত্য কলা
মৌমাছি আর বোলতারা স্থাপত্য কলাও জানে। তারা নিজেদের বাড়ি নিজেরাই বানায়। মৌমাছিরা থাকার জন্য মৌচাক বানায়। মৌচাকে ছোট ছোট ষড়ভুজাকার খুপরিগুলোতে এরা ডিম পাড়ে। গণিতবিদ মৌমাছিরা খুপরিগুলো বানায় যথার্থ গণিত মেনেই। অবশ্য তাদের এই গাণিতিক হিসাব তাদের নিজেদের মতো করেই করে। থাকে প্রতিসাম্যতার সৌন্দর্য। মৌমাছিরা মৌচাক বুনে মোম দিয়ে। এই মোম তৈরি হয় তাদের শরীরেই। মৌচাকের এক শিট থেকে আরেকটা শিটের মাঝে যথেষ্ট ফাঁক রাখা হয়। ফলে প্রত্যেকে সহজেই যাতায়াত করতে পারে। বোলতারাও নিজের নীড় বাঁধতে জানে। এদের ঘরগুলোও ষড়ভুজাকার। তারা তাদের ঘরের আকার নির্ধারণ করতে এক রকমের অ্যান্টেনা ব্যবহার করে। বোলতারা ঘর বানাতে ব্যবহার করে পানি আর নানান রকম কাঠ। একেক কাজে একেক রকমের কাঠ লাগে বোলতাদের। যেমন পচে যাওয়া কাঠ, মরা কাঠ কিংবা টাটকা কাঠ।
ধড়িবাজি
মৌমাছিরা ধড়িবাজও বটে। হত্যা, লুটপাট এদের সমাজেও হয়। রানি মৌমাছিরা তাদের জীবনযাত্রা শুরু করে সহোদরা মৌমাছিদের হত্যা করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ মহা লুটতরাজ। লেস্ট্রিমেলিটাগণের অন্তর্ভুক্ত একদল মৌমাছি আছে। এদের হুল থাকে না। কিন্তু এরা ভীষণ ফন্দিবাজ। সুযোগ পেলেই আক্রমণ করে অন্যের মৌচাকে। সেখানে বাস করা সব মৌমাছিকে হত্যা করে ছিনিয়ে নেয় তাদের খাবার। কুকো মৌমাছিরা রাজ্য দখলে আরো পারদর্শী। এরা মৌচাকের রানিকে হত্যা করে তার সব কর্মী মৌমাছিদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করে। বোলতারাও চুরিবিদ্যায় দক্ষ। মধু চুরি করতে এরা দলবেঁধে হানা দেয় ভ্র মৌচাকে। বিশাল আকারের শিকারি ভিমরুলদের দেখা মেলে এশিয়া মহাদেশে। এরা খুবই নিষ্ঠুর। মৌচাকের সন্ধান পেলে এরা হানা দেয় দলবল নিয়ে। হত্যা করে সেখানকার প্রহরী মৌমাছিদের। মৌচাকে থাকা সব বাসিন্দা মৌমাছিদের হত্যা করে। এমনকি রেহাই পায় না লার্ভাগুলোও। ভিমরুল আর তাদের শাবকরা উল্লাস করে খায় মধু আর লার্ভাগুলো।
মৌমাছিরা কিন্তু এদের ওপর এসব আক্রমণ চুপ করে সহ্য করে না। এরা ঝাঁক বেঁধে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। মৌমাছির একটা ঝাঁক একত্রিত হয়ে তৈরি করে গোলাকার বি বল। সেগুলো দিয়ে ঘিরে ফেলে একেকটা শত্রু সেনাকে। কিন্তু অ্যাম্পুলেক্স ডিমেন্টর নামের বোলতাদের কাছে এসব কিছুই না। এরা এদের হুল দিয়ে প্রতিবাদকারী মৌমাছিদের শরীরে এক ধরনের বিষ ঢুকিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মৌমাছিদের নিউরোট্রান্সমিটার গ্রাহক স্নায়ুর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মৌমাছিরা আর নড়াচড়া করতে পারে না তখন। ইকনিউমন বোলতারা ডিম পাড়ে শুঁয়োপোকাদের ওপর। কেউ কেউ আবার তাদের ডিম ঢুকিয়ে দেয় শুঁয়োপোকাদের শরীরে। ডিম ফুটে বের হওয়া লার্ভাগুলো শেষমেশ তাদের আশ্রয়দাতার শরীরকেই খাওয়া শুরু করে।
অবস্থান নির্ণয় দক্ষতা
এ বিষয়ে বোলতারা বেশ ভালোই দক্ষ। ‘ফিলান্থাস ট্রায়াঙ্গোলাম’ নামের বোলতারা তাদের চাকের ধারে কাছের কোনো গাছ বা কিছুকে ল্যান্ডমার্ক হিসেবে মনে রাখে। পরে এই ল্যান্ডমার্ক তাদের নিজের চাক খুঁজে পেতে সাহায্য করে। বোলতাদের স্থানিক দিক উপলব্ধিও দারুণ। মৌমাছিরাও এ বিষয়ে বেশ পারদর্শী। তবে দিক নির্ণয়ে বোলতারাই এগিয়ে থাকবে।
দংশন
অনেকেরই মৌমাছি আর বোলতাদের তীক্ষ্ণ কামড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই অভিজ্ঞতা একেক জনের একেক রকম হয়। কারোর কামড়ানো স্থানে জ্বালা-যন্ত্রণা হয়, ফুলে লাল হয়ে যায়। কারোর আবার মৌমাছির দংশনে অ্যালার্জির সমস্যা শুরু হয়। এ সবেরই কারণ হচ্ছে মৌমাছি আর বোলতাদের হুলে থাকে এক ধরনের বিষ। এই বিষে থাকে ফসফোলাইপেজ এ, হাইলুরোনিডেস নামে এনজাইম। এ ছাড়া থাকে ফেরোমোন নামক রাসায়নিক। ফসফোলাইপেজ এ এনজাইম কোষ ধ্বংস করে এবং অ্যালার্জেন (শরীরে অ্যালার্জি সমস্যা সৃষ্টিকারী রাসায়নিক) হিসেবে কাজ করে। হাইলুরোনিডেস এনজাইম কোষ পর্দায় থাকা শর্করা উপাদানকে ভেঙে ফেলে। ফলে বিষ সহজেই কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
মৌমাছির বিষে মেলিটিন নামের এক ধরনের পেপটাইড (অ্যামাইনো এসিডের ছোট চেইন) থাকে। এটি কোষ নষ্ট করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে উৎপন্ন করে অ্যাপামিন নামের নিউরোটক্সিন। বোলতার বিষে থাকে কাইনিন, ফসফোলাইপেজ বি ও অ্যাসিটাইল কোলিন নামক রাসায়নিক উপাদান। কাইনিন ত্বকে প্রদাহ সৃষ্টি করে, ফসফোলাইপেজ বি শিকারের গতি রোধ করে দিতে পারে। অ্যাসিটাইল কোলিন স্নায়বিক প্রদাহ তৈরি করে। স্ত্রী মৌমাছিরা একবারই দংশন করে। কিন্তু এই একবার দংশনে ৫০ থেকে ১৪০ মাইক্রোগ্রাম বিষ প্রবেশ করাতে পারে। অন্যদিকে বোলতারা বার বার কামড়ায়। আর প্রতিবারে ৩ মাইক্রোগ্রাম বিষ আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।
উপকারিতা
এতসব ধড়িবাজ, লুটতরাজদের মধ্যে পরোপকারী মৌমাছিও আছে অনেক। নানাভাবে তারা গাছ, মানবজাতি, অন্যান্য প্রাণীকুলকে উপকার করে আসছে। ফুলের মধু আহরণ করতে মৌমাছিরা ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। আর তখন পুরুষ ফুলের পরাগরেণু এদের শরীরে লেগে যায়। সেই মৌমাছিই যখন পরাগরেণু নিয়ে স্ত্রী ফুলের ওপর বসে, তখন সেই পরাগ স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে স্থানান্তরিত হয়। আর এভাবেই ঘটে পরাগায়ন। পরাগায়নের মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশবিস্তার ঘটে। উদ্ভিদের টিকে থাকার জন্য যা অতীব জরুরি। আর প্রাণীকুল উদ্ভিদের উপরেই নির্ভর করে বেঁচে থাকে। মধুকররা অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে পরাগায়নের মাধ্যমে। প্রতিবছর ফুল চাষে শত শত বিলিয়ন ডলার আয়ে মৌমাছিদের এই অবদান অপরিসীম।
মধুকরদের সুমিষ্ট মধুর আছে নানাবিধ গুণাবলি। এর রয়েছে ব্যাপক অর্থনৈতিক গুরুত্ব। গত বছর পুরো বিশ্বে মধুর বাজার দর ছিল সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার মূল্যের। আর মৌচাক থেকে পাওয়া মোমের বাজার মূল্য ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
ফাইকাস (Ficus) উদ্ভিদের পরাগায়ন ঘটে কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির বোলতার মাধ্যমে। এই ধরনের উদ্ভিদ নানান কাজে লাগে। এর কাঠ ব্যবহৃত হয় ম্যাচ বক্স ও ফার্নিচার তৈরিতে। এ ছাড়া আছে ঔষধি গুণাবলি। এর পাতা পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। প্রতিবছর পুরো বিশ্বে এই উদ্ভিদ চাষে ৫০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়। কিছু কিছু অর্কিড ফুলের গন্ধ আর গড়ন স্ত্রী বোলতার মতো। পুরুষ বোলতারা তাই অর্কিড ফুলকে স্ত্রী বোলতা ভেবে সেগুলোর সংস্পর্শে যায়। আর এভাবেই তারা অর্কিডের পরাগায়ন ঘটায়। বোলতাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ। তারা উকুন, মাকড়সা, শুঁয়োপোকা, এফিড ও মাছিদের খেয়ে ফেলে। ভেসপুলা নামের বোলতারা বছরে প্রতি হেক্টর জমি থেকে প্রায় ২৩ হাজার পোকামাকড় ধ্বংস করতে পারে। এভাবে তারা চাষিদের অর্থনৈতিক লোকসান থেকে বাঁচিয়ে দেয়।
বি. দ্র.: লেখাটি পূর্বে দৈনিক বাংলার ইউরেকার পাতায় ছাপা হয়েছিল।
তথ্যসূত্রঃ নিউ সায়েন্টিস্টের ১৬ জুলাই ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত ক্রিস সিমসের ‘বি ভার্সেস ওয়াপস’ প্রবন্ধ অবলম্বনে।
Leave a Reply