আমরা কি পারবো বার্ধক্য ঠেকাতে?

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

মৃত্যুকে কে আলিঙ্গন করতে চায়? মরণের কথা উঠলেই সবার আগের বার্ধক্যের কথা মনে পড়ে যায়। যদি আমরা কোনোভাবে এই বার্ধক্যকে আটকে দিতে পারতাম, তাহলে কেমন হতো? বার্ধক্য রুখে দিতে বহু বিজ্ঞানী উঠে পড়ে লেগেছেন। প্রথমেই তো আর মানুষের উপরে গবেষণা চালানো যায় না, অনেকক্ষেত্রে ব্যর্থতা আর ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে। একারণে গবেষকেরা ইস্ট আর গোলকৃ্মির উপর নজর দিলেন। তারা দেখলেন যে বেশ কয়েকটি জিন বয়সবৃদ্ধির সাথে জড়িত। কিছুটা একই পরীক্ষা যখন অন্য বিজ্ঞানীরা ড্রসোফিলা মাছির উপর করলেন, তখন তারা একই ফল পেলেন। এরপর গবেষকেরা বুঝলেন যে বার্ধক্যের সাথে জিনের একটা প্যাঁচ আছে, যেটা মানুষের ক্ষেত্রেও সত্য।

একেক জিন একেক কাজে নিয়োজিত। এর মধ্যে কোনটা আছে বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু সেগুলো চিহ্নিত করা কি সহজ?

জিন কোথায় থাকে? নিউক্লিয়াসে তো থাকেই, আর মাইটোকন্ড্রিয়ার নিজস্ব রাজ্যে নিজস্ব ডিএনএতেও জিন থাকে। নিউক্লিয়াসের জিন উপরের বিষয়টিতে যথেষ্ট নাক গলায়। আর মাইটোকন্ড্রিয়ার জিন মাইটোকন্ড্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এই মাইটোকন্ড্রিয়া কিন্তু আবার বার্ধক্যের সাথে জড়িত। সময়ের সাথে সাথে কোষের ভেতরের মাইটোকন্ড্রিয়নের ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইনের মধ্যে ইলেক্ট্রন থেকে প্রচুর পরিমাণে রিঅ্যাক্টিভ অক্সিজেন স্পিসিস উৎপাদিত হয়। এর ফলে কোষ কেমন জানি মলিন হয়ে যায় এবং আমরা বুড়িয়ে যাই।

যখন একটা বুড়ো বা সেনেসেন্ট কোষ যখন দিন দিন বাড়তে থাকে এবং এগুলো কোনভাবে নির্মূল হয় না, তখন তার প্রতিবেশী কোষগুলোও ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যেতে থাকে আর আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আর এর মাধ্যমেই আমরা চূড়ান্তভাবে বার্ধক্যকে বরণ করে নিই। তখন বিভিন কোষের ফাংশনাল প্রসেস ঘুনে ধরে যায়। ফলে আমরা সহজেই রোগাক্রান্ত হই। আরেকটা কারণ আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে মানবদেহের জীবনীশক্তি সীমিত পরিমাণে থাকে এবং আমরা এই শক্তির অনেক্টাই প্রজননকার্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যয় করে ফেলি। বিজ্ঞানীরা এটিকে “ডিসপোজেবল সোমা থিওরি” বলে অভিহিত করেছেন।

এখন উপায় কী? যদি কোনোভাবে বার্ধক্যকে নেমন্তন্ন করা জিনের মাতব্বরি থামানো যায় কিংবা মাইটোকন্ড্রিয়ার রিঅ্যাক্টিভ অক্সিজেন স্পিসিস উৎপাদনের প্রভাব কমানো যায়, তাহলে হয়ত বার্ধক্যকে থামানো সম্ভব। এছাড়াও আরেকটা কাজ করা যেতে পারে। সেটা হলো যেসব বুড়ো কোষ অন্যদেরকে বুড়ো করে ফেলে, সেগুলোকে উপড়ে ফেলা। তাছাড়া প্রজনন জিনিসটাকে জীবন থেকে ডিলিট করে দিলেও একই ফল পাওয়া যেতে পারে (যদিও জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়)। আরও উপায় আছে। যেমনঃ স্টেম সেল উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা।

নিজের ইচ্ছেমতো কোষকে পরিচালনা করাটা মোটেও যৌক্তিক শোনায় না

কিন্তু এগুলো শুনতে যেমনটা সহজ মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অতটা সহজ নয়, অনেক কঠিন! কারণ বুড়ো হওয়ার সাথে জড়িত জিনগুলো কোথায় কোথায় কতটা করে আছে, সেগুলো চিহ্নিত করা কিংবা মাইটোকন্ড্রিয়াকে নিজের ইচ্ছেমতো চালানো অথবা স্টেমসেলের উপর হুকুমরানি করা-পুরোটাই চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। আর একটা কোষকে কি চাইলেই উপড়ে ফেলা যায়? এছাড়াও বুড়ো ভেবে যদি কোনো কোষকে প্রতিস্থাপন করা হয়, তাহলে সেটার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কী কী হতে পারে সেটা এখনো আমরা জানি না। তাছাড়া প্রজননকে এভাবে বিদায় জানানোটাও কেমন জানি বেখাপ্পা লাগে। এতে করে আমরা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবো।

কোষের ক্রোমোজোমে থাকা টেলোমিয়ার নামক একটি অঞ্চল থাকে, যেটা কোষ বিভাজনের সময় কমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে বার্ধক্য চলে আসে। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি কারও দেহে লম্বা টেলোমিয়ার থাকে এবং অপেক্ষাকৃ্ত ধীরে ক্ষয় হতে থাকে, তাহলে হয়ত বয়সসীমা বাড়তে পারে। তবে গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে যাদের অত্যধিক লম্বা টেলোমিয়ার আছে তাদের ফুসফুসের ক্যান্সার এবং মস্তিষ্কের টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণের গবেষণা সগল হয়েছে ইঁদুরের দেহে।

তবে গবেষকেরা বসে থাকার পাত্র নন। তারা বিভিন্ন প্রাণীদের উপরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এক্ষেত্রে প্রথম সারিতে রয়েছে ইঁদুর। সম্প্রতি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক ১৩ বছর ধরে গবেষণা করে ডিএনএ রিপেয়ারিং এর মাধ্যমে ইঁদুরের বুড়িয়ে যাওয়াকে থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এর ফলে ঐ ইঁদুর নতুন করে যৌবন ফিরে পেয়েছে। এর পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত প্রভাব যেমন হাড়ের দুর্বলতা কিংবা দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের মতো বিষয়গুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।

অনেকে বলছেন যে দীর্ঘ জীবন লাভ আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ নয়। এর চেয়ে বরং কীভাবে স্বাস্থ্যকর জীবন পাওয়া যাবে, সেটা নিয়ে ভাবা উচিৎ। আর অনেক বিজ্ঞানী এখন এদিকটাতেই নজর দিচ্ছে, ফলে বিকাশ ঘটছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের। এটাই বোধ হয় বিজ্ঞানের সফল প্রয়োগগুলোর একটি। এরপরেও বার্ধক্য নিয়েও গবেষণা চলছে। আমরা ভবিষ্যতে বার্ধক্যকে দেরি করে আসতে বলতে পারব কি না সেটা এখনি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বিষয়টা রোমাঞ্চকর বটে, তবে রয়েছে ব্যর্থতা, শঙ্কা আর ঝুঁকির প্রশ্ন। আর যদি সব প্রশ্ন সমাধান করে বিজ্ঞানীরা চূড়ান্ত সাফল্যের মুখ দেখতে পায়, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? জুল ভার্ন বেঁচে থাকলে হয়ত এটা নিয়ে একটা জ্যান্ত সায়েন্স ফিকশন লিখে ফেলতেন! 

( লেখাটির কিছু অংশ দৈনিক বাংলায় পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে)

রেফারেন্সঃ
১. Can We Stop Aging?
২. The ‘Benjamin Button’ effect: Scientists can reverse aging in mice. The goal is to do the same for humans

লেখাটি 260-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।