প্রাণীটার বৈজ্ঞানিক নাম Ampulex compressa। সাধারণ নাম জুয়েল ওয়াস্প,বা বাংলা করে বলতে পারি জুয়েল বোলতা। আফ্রিকা এবং এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকাগুলোয় প্রধানত এর দেখা মেলে। দৈর্ঘ্যে এক ইঞ্চি থেকে সামান্য ছোটো। গায়ে বাহারি রঙ। খটকা লাগতে পারে,এটা কোনো কৃমি না,ভাইরাস না, কোনো ছত্রাকও না; সামান্য একটা বোলতা আবার পরজীবী হয় কীভাবে? আমরা হরদম যেসব বোলতা দেখি,সেগুলো তো গাছের গায়ে মধুর চাক বানিয়ে বাস করে। কাছাকাছি কোনো ঘর থাকলে সেই ঘরের কর্তা-কর্ত্রী বোঝেন তার কি জ্বালা! মজাটা হচ্ছে,জুয়েল বোলতা তার ঘর বানায় একটা জ্যান্ত তেলাপোকার শরীরের মধ্যে।
📷যাকে নিয়ে আজকের আলাপ
ঘটনাটা কীভাবে ঘটে বলি। জুয়েল বোলতা তেলাপোকার সন্ধানে এখানে-ওখানে উড়ে বেড়ায়। খুঁজে পাওয়া মাত্র তেলাপোকার ওপর ‘ল্যান্ড’ করে,এবং ডানা বরাবর কামড়ে দেয়। তেলাপোকাটা ডানা ঝাপটে বোলতাটাকে ঝেরে ফেলতে চেষ্টা করে,অন্যদিকে বোলতাটাও দ্রুত হুল ফোটাতে শুরু করে। ঠিকঠাক হুল ফোটাতে পারলে তেলাপোকাটা মিনিটখানেকের জন্য অসাড়-অচেতন হয়ে পড়ে। তারপর আবার যেমন হঠাৎ করে অচেতন হয়ে গেছিলো,তেমন হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ায়। চাইলেই সে ছুটে পালিয়ে যেতে পারে,কিন্তু মজাটা হলো পালায় না,ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তেলাপোকাটা যেনো ঠিক নড়তে চায় না! কি এক জাদুতে হয়ে ওঠে ‘জম্বি স্লেভ'(Zombie slave)!
ও এখন ওর নতুন মালিকের কথা শুনবে। ধস্তাধস্তির পর বোলতাটাও বেশ ক্লান্ত,ওর একটু ঘুরেফিরে আসা দরকার কি-না? বোলতাটা তাই করে—ঘোরার নাম করে খুঁজে বের করে একটা ছোটোখাটো গর্ত,তেমন কিছু না পেলে কাজ চালানোর মতো কিছু একটা খুঁড়ে ফেলে নিজেই। তারপর আবার তেলাপোকাটার কাছে ফিরে আসে। এই আসা-যাওয়ায় পুরোটা সময় তেলাপোকাটা কিন্তু ওখানেই দাড়িয়ে আছে,নট-নড়নচড়ন অবস্থায়! এখন,মানুষ যেভাবে পোষা কুকুরের গলায় বেড়ি বেঁধে নিজের সাথে সাথে টেনে নিয়ে যায়,বোলতাটাও সেরকম তেলাপোকার একটা শুঁড় ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে গর্তটার দিকে। মজার ব্যাপার,প্রভুভক্ত কুকুরের মতোই তেলাপোকাটাও কোনো আপত্তি করে না, কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই এগুতে থাকে। গর্তের ভেতর গিয়ে মালিক তার দাসের পিঠ চাপড়ে কিছু উপদেশ দেয়,দাস মাথা হেট করে সব শুনে যায়। বোলতাটা তারপর বের হয়ে গর্তের মুখ বুজিয়ে উড়ে চলে যায়,তেলাপোকাটা তখনো ভেতরে—একদম জ্যান্ত!
📷তেলাপোকার অঙ্কীয়তলে বোলতার ডিম
বোলতা কি উপদেশ দিলো তাকে? গর্তের ভেতরে গিয়ে বোলতাটা আসলে তেলাপোকার বুকে ডিম পাড়ে,তারপর ডিমগুলোর খেয়াল রাখতে বলে। তেলাপোকাটাও হয়তো বলে, “জি হুজুর!”; সেই ডিম থেকে একসময় লার্ভা বের হয়। বিদঘুটে চোয়ালবিশিষ্ট শূককীটের মতো সেই লার্ভা তেলাপোকাটার বুকে গর্ত করতে থাকে,পুষ্টি আহরণ করতে থাকে সেখান থেকেই। আস্তে আস্তে বড়ো হয় লার্ভা,তেলাপোকার শরীর থেকে খাদ্য শুষে নিতে নিতে একসময় ঢুকে যায় দেহের ভেতরে। এখনো তেলাপোকাটা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না—কোনো আপত্তি ছাড়াই মনিবসন্তানের খোরাক মিটিয়ে যায় সে! একমাস ধরে চলতে থাকে এই পর্ব। লার্ভা আরো বড়ো হয়,একসময় নিজের চারপাশে গুটির(Cocoon) মতো তৈরি করে ফেলে। সেই গুটির ভেতর তার চোখ ফোটে,দেহ সুগঠিত হয়,পাখা তৈরি হয়; ওদিকে তেলাপোকাটা অচঞ্চল,যদিও সে এখনো জ্যান্ত। শেষপর্যন্ত একসময় বিদায়ঘণ্টা বাজে তেলাপোকার,পরিণতিপ্রাপ্ত বোলতা তেলাপোকার পিঠ ভেদ করে বেড়িয়ে আসে। তেলাপোকার নিথর দেহ পেছনে ফেলে গর্ত থেকে বেড়িয়ে এসে গা ঝারা দেয় সে, মিলনের জন্য উড়ে যায় বিপরীত লিঙ্গের আরেক বোলতার খোঁজে, যাতে করে এই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর চক্র আবার শুরু করতে পারে!
📷তেলাপোকার ভেতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে আগামী দিনের জম্বি
এতোক্ষণ আপনি যা পড়লেন তা মোটেও কোনো কল্পকাহিনী নয়। প্রতিদিন এই ঘটনা ঘটছে,সারাবিশ্বেই ঘটছে। স্বভাবতই বিজ্ঞানীরা এই অদ্ভুত ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে চমৎকৃত হয়েছেন। তারা অনুসন্ধান-গবেষণা করে বের করতে শুরু করেছেন কীভাবে এই চমৎকার সম্ভব হয়। যখন পুরো ব্যাপারটা জানলে হয়তো আপনার সমীহই জাগবে জুয়েল বোলতার প্রতি!
📷তেলাপোকার স্নায়ুজালিকা ও হুলের আঘাতস্থল
শুরুতে ফিরে যাই আবার—বোলতাটা যখন হুল ফোটাতে শুরু করে,তখন কিন্তু কাজটা এলোপাথাড়ি করে না,নিখুঁতভাবে মাত্র দুটো হুল ফোটায়। আপনি যেমন আপনার হাতের তালু চেনেন,ঠিক সেরকম বোলতাটা যেনো তেলাপোকার স্নায়ুতন্ত্রের বিন্যাস ভালোমতোই জানে। প্রথম হুল’টা গিয়ে আঘাত করে তেলাপোকার WRG(Walking Rhythm Generator)স্পটে। নাম থেকেই আন্দাজ করতে পারছেন এই অংশে চলনের সাথে সম্পৃক্ত নিউরনগুলো সংযুক্ত,এখান থেকে সংকেত পেয়েই তেলাপোকার পা বুঝতে পারে যে এখন এইদিকে চলতে হবে। হুলের আঘাতে ঐ নিউরন চ্যানেলগুলো ব্লক হয়ে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় স্নায়বিক বৈকল্য; তেলাপোকা চায় পালিয়ে যেতে,কিন্তু নিজ থেকে নড়াচড়ার যাবতীয় উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলায় তার পা আর সায় দেয় না! এটা কিন্তু অত্যন্ত জটিল ফার্মাকলোজি—এই একই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় রিভার ব্লাইন্ডনেস রোগের চিকিৎসায়! এক বিশেষ ধরনের পরজীবী কৃমি এই রোগের জন্য দায়ী, আর এই রোগের প্রতিষেধক হিসেবে আইভারমেক্টিন(Ivermectin) নামে একটা ওষুধ ব্যবহার করা হয়,যেটা কি না একইভাবে কৃমিটাকে জব্দ করে ফেলে। বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন ১৯৭০ এর দিকে,আর মজার ব্যাপার,জুয়েল বোলতা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে বহুসহস্র বছর ধরে!
📷দ্বিতীয় হুলের আঘাত
এবার দ্বিতীয় হুল’টার কথায় আসা যাক। দ্বিতীয় হুল’টা তেলাপোকার মস্তিষ্কে দুই জায়গায় আঘাত করে। ছবিতে যেমন দেখতে পাচ্ছেন,প্রথম আঘাতটা আসে SEG স্পটে। সেখানে হুল’টা বাধা পায়—খানিকটা বিষ নিঃসরণ করে,আবার সেটা ভেদ করে BR স্পটে আঘাত করে সেখানেও বিষ নিঃসরণ করে। এই একই কাজ চিকিৎসাবিদ্যায় করা হয়,তাকে বলে স্টেরিওট্যাকটিক ড্রাগ ডেলিভারি। এই অত্যন্ত দুরূহ,সংবেদনশীল প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য রোগীকে একটা বড়ো ধাতব ফ্রেমের মধ্যে রাখতে হয়,ওষুধ ঠিক পথে যাচ্ছে কি না দেখার জন্য সবসময় চোখ রাখতে হয় কম্পিউটারের দিকে! বিজ্ঞানীদের ধারণা বোলতার ঐ বিশেষ হুলে কিছু সংবেদী নিউরন থাকে,যেগুলি কি না উপযুক্ত উদ্দীপনা অনুসারে তেলাপোকার মস্তিষ্কে এর নির্দিষ্ট যাত্রাপথ ঠিক করতে পারে। এভাবে খুব সূক্ষ্মতার সাথে হুল’টা মস্তিষ্কের যথার্থ জায়গায় যথার্থ নিউরনকে আঘাত করে(এবং বিষ ঢেলে) তাকে অবশ করে দিতে পারে! আর এর ফলাফল কী হয় তা তো জানলেনই,তেলাপোকাটা তার নিজের শরীরের ওপরেই সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে বশ্যতা স্বীকার করে নেয় বোলতার কাছে!
বোলতা আর তেলাপোকার এই অদ্ভূত,কৌতুহলপ্রদ আন্তঃক্রিয়া সম্পর্কে এখনো অনেক কিছুই আমাদের অজানা। তা সত্ত্বেও যে বিস্ময় এরা আমাদের উপহার দিয়েছে,তা জেনে একে উপভোগ করাও কি কম আনন্দের?
📷কার্ল জিমার: এই লেখার মূল রসদদার
স্বীকারোক্তি:
এই লেখাটি ইয়েল ইউনিভার্সিটির আণবিক জীবপদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক কার্ল জিমারের “Parasite tales : the jewel wasp’s zombie slave” শীর্ষক টেড-টক থেকে অনুপ্রাণিত। কার্ল জিমার সেই বিরলপ্রজ মানুষদের একজন যারা সাবলীল ভাষায় বিজ্ঞানের জটিলতম বিষয়গুলো নিয়ে অনায়াসে আলোচনা করতে পারেন। ছবিসহ এই লেখার যাবতীয় রসদ জিমারের টেড-টক’টি থেকেই ঋণ করা হয়েছে। জিমার বক্তব্যটি রেখেছিলেন এখন থেকে দশ বছর আগে,২০১৩ সালে। তারপর বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়েছে,জুয়েল বোলতা এবং তেলাপোকার এই শোষণমূলক আন্তঃক্রিয়ার পেছনের বিজ্ঞানটুকু বিজ্ঞানীরা সবটা বের করতে না পারলেও অনেকটাই পেরেছেন। সে বিষয়ে বিস্তর বর্ণনা করতে গেলে লেখার আকার যেমন বাড়তো,তেমন খানিকটা বিনষ্ট হতো সহজবোধ্যতাও। আগ্রহী পাঠকের জন্য কয়েকটি সাহায্যকারী সূত্র এখানে উল্লেখ করছি—
১। বিজ্ঞানলেখক,গবেষক আরাফাত রহমান ভাইয়ের তথ্যবহুল বিশ্লেষণধর্মী বিজ্ঞানপ্রবন্ধ “প্রকৃতির দুঃস্বপ্ন – মনচোষক”
২। সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান ম্যাগাজিনের প্রবন্ধ “How a Wasp Turns Cockroaches into Zombies”
Leave a Reply