বীজগণিতের দৃষ্টিপাত
ফরাসি গণিতবিদ রেনে দেকার্তে একদিন উদাস মনে বসে আছেন। এমন সময় তিনি একটা মাছি দেখতে পেলেন। মাছিটা অনেকক্ষণ ওড়াউড়ি করে দেয়ালে বসল। দেকার্তে তখন চিন্তা করলেন, আচ্ছা এই মাছির অবস্থানটা কি আমি বের করতে পারি? দেকার্তে দেয়ালের দুই ধারের সাপেক্ষে মাছির অবস্থান বের করলেন। তিনি ভাবলেন, “আচ্ছা মাছিটা দেয়ালের এই পাশ থেকে এতটুকুতে আছে। এখন যদি আমি এই পাশ থেকে ওপরে যেতে থাকি তাহলেই তো মাছিটাকে পেয়ে যাব। এভাবে যখন তিনি দুইটা অক্ষের সাপেক্ষে মাছির অবস্থান বের করলেন। তখনই স্থানাঙ্ক জ্যামিতির জন্ম হলো।” তিনি জ্যামিতিক আকারকে বিন্দুর মাধ্যমে প্রকাশ করলেন, এভাবে স্থানাঙ্ক জ্যামিতির উদ্ভব ঘটল। এভাবে ভুজ আর কোটি দিয়ে প্রকাশ করা গেল একটা বিন্দু, জ্যামিতিক চিত্র।
এই কাজটা করার পর দেকার্তে চিন্তা করলেন, আমি কী ফাংশনের চিত্র আঁকতে পারি? তখন তিনি ফাংশনের ইনপুটগুলোকে (ডোমেন) ভূজ আর আউটপুটগুলোকে (রেঞ্জ) কোটি ধরে জ্যামিতিক চিত্র আঁকতে পারলেন। এই জিনিসটা আসলেই একটা দারুণ ব্যাপার ছিল। এই কাজটা থেকে আমরা একটা সুন্দর চিন্তা করতে পারি। যদি ভুজ আর কোটির মাধ্যমে ফাংশনের চিত্র আঁকা যায়। তাহলে কোনো চিত্র থেকে যদি আমরা বিভিন্ন কিছু বিন্দু নিই, তারপর সেই বিন্দুগুলো থেকে ফাংশন বের করতে পারি, তখন সেই ফাংশনটা আসলে ওই চিত্রের সমীকরণ হয়ে যাবে। কী সুন্দর একটা বিষয়!
মনে করো, আমার কাছে একটা বৃত্তের পরিধির উপর অবস্থিত কিছু বিন্দু আছে। বিন্দুগুলো হলো,
(0, 3), (0, –3), (1, 2√2), (1, –2√2) …
এখন এই বিন্দুগুলোর মধ্যে আমরা যদি ফাংশন (অন্বয়) বের করতে পারি তাহলে সেটা এই বৃত্তের সমীকরণ হবে। সেটা হবে,
x² + y² = 3²
এখন আমরা সরলরেখার সমীকরণ দেখব। মনে করো আমাদের কাছে দুইটা বিন্দু আছে। (0, 5), (–5, 0) । এখন আমরা এই বিন্দুগুলোর ভুজ আর কোটির মধ্যে সম্পর্ক করার চেষ্টা করব। সম্পর্কটা হবে এমন যাতে এই সরলরেখার যে-কোনো বিন্দুর ভুজ আর কোটির জন্য সেটা সত্য হয়।
আমি দুইটা বিন্দু নিয়েছি, কেউ চাইলে অনেকগুলো বিন্দু নিয়ে কাজ করতে পারে। চলো এখন দেখি ভুজ আর কোটির মধ্যে সম্পর্ক করা যায় কিনা।
(0, 5), (–5, 0) এই বিন্দুগুলোর ক্ষেত্রে ভুজের সাথে 5 যোগ করলে আমরা কোটি পাই।
5 = 0 + 5, 0 = –5 + 5
তাহলে, এই বিন্দুগুলোর মধ্যে সম্পর্কটা হলো,
y = x + 5
এই সমীকরণটাই হলো (0, 5), (–5, 0) বিন্দু দিয়ে আঁকা সরলরেখার সমীকরণ। এখন একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। আমি এই সরলরেখাটার সমীকরণ বের করার জন্য ভুজকে প্রক্রিয়া করে কোটি কীভাবে পেলাম সেটাকে ফাংশন হিসেবে ধরেছি। কেন ভুজকে প্রক্রিয়া করলাম? কোটিকে কেন না?
আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম যে ভুজ হলো ফাংশনের ডোমেন (ইনপুট) আর কোটি হলো ফাংশনের রেঞ্জ (আউটপুট) ।
ফাংশনে আমরা কি করি? ডোমেনকে বিভিন্ন প্রক্রিয়া করেই তো রেঞ্জটা পাই, তাই না?
(এখানে একটা কথা বলে নিই, ফাংশনে যেহেতু ডোমেনকে প্রক্রিয়া করে রেঞ্জ পাই, তাই ফাংশনকে মেশিনের সাথে তুলনা করা যায়)
যেহেতু আমি ধরে নিয়েছি ডোমেন হলো ভুজ আর রেঞ্জ হলো কোটি। তাই ডোমেনকে প্রক্রিয়া করে রেঞ্জ পাওয়ার মাধ্যমে আমি ফাংশন বের করেছি। বা ডোমেনটাকে, ভুজটাকে মেশিনে ঢুকালে মেশিন কীভাবে কাজ করে রেঞ্জ/কোটি বের করে সেটা পর্যবেক্ষণ করেই আমি ফাংশন বের করেছি। একটা কথা একটু বলে নিই, ফাংশন যেহেতু মেশিনের মতো, এই মেশিন আসলে একটা সেটের বাহিরে আউটপুট (রেঞ্জ) দিতে পারে না। ব্যাপারটা হলো তুমি যেই ইনপুটই দাও না কেন মেশিনটা সবসময় একটা সেটের ভেতরে ওই ইনপুটের জন্য আউটপুট দেবে। আর সেই সেটটাকেই ফাংশনের ভাষায় বলে কোডোমেন। এই আলাপ আর দীর্ঘায়িত না করি। আমরা আবার সরলরেখার সমীকরণে ফিরে যাই।
একটু আগে যে আমরা একটা সরলরেখার সমীকরণ বের করেছি। সেটা ছিল একটা নির্দিষ্ট চিত্রের জন্য সরলরেখার সমীকরণ। y = x + 5, এই সমীকরণটা আসলে সব সরলরেখার জন্য সত্য না। তাই আমরা এমন কিছু সমীকরণ তৈরি করবো যা সব সরলরেখার জন্য সত্য হবে। সেটাকে অন্য ভাষায় বলা যায়, সরলরেখার সমীকরণের সাধারণ রূপ দাঁড় করাব।
ইউক্লিডিয় জ্যামিতিতে সরললেখা
সরলরেখার সাধারণ রূপ এর জন্য আগে জানতে হবে সরলরেখা কী, সেটা। ইউক্লিড তাঁর ‘এলিমেন্টস্’ বইয়ে বলেছেন, ‘সরলরেখা এমন একটা রেখা, যা তার বিন্দুগুলোর সাথে সমানভাবে সাজানো থাকে’। এর মানে হলো – সরলরেখার বিন্দুগুলো এলোমেলো থাকতে পারবে না। সমানভাবে বিন্দুগুলো সজানো থাকবে। কার্তেসিয় জ্যামতিতেও এই ব্যাপার খাটে ভূজ আর কোটি দিয়ে বিভিন্ন বিন্দু তৈরি হবে। এই বিন্দুগুলো স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় বসিয়ে যোগ করলে একটা সরলরেখা পাওয়া যাবে।
একটু আগে আমরা যে সমীকরণ দেখলাম–
y = x + 5 ,
এখানেও কিন্তু বিন্দুগুলোর সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।
তাই সরলরেখার সমীকরণের সাধারণ রূপ দাঁড় করানোর জন্য আমাদের একটা বিন্দু নিতে হবে। এই বিন্দুটা যে সরলরেখাটার সমীকরণ বের করব তার সব বিন্দুর প্রতিফলন। মানে হলো, বিন্দুটা হবে বীজগাণিতিক বিন্দু P(x, y), এখানে x ওই সরলরেখার সব ভুজের প্রতিনিধিত্ব করে আর y ওই সরলরেখার সব কোটির প্রতিনিধিত্ব করে। সরলরেখার সমীকরণ তৈরির জন্য আরেকটা জিনিস লাগবে। সেটা হলো ‘ঢাল’। এই ঢাল একটা সমীকরণের পুরো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।
সরলরেখার সমীকরণ দিয়ে বিভিন্ন সরলরেখার বৈশিষ্ট্য বোঝা যাবে। ঢাল যেহেতু একটা সরলরেখার সার্বিক বৈশিষ্ট্য বলতে পারে, তাই সরলরেখার কিছু সমীকরণ ঢাল দিয়েই বের করতে হয়। আর সমীকরণ যেহেতু বীজগাণিতিক রূপ হবে, তাই আমি P(x, y) বীজগাণিতিক বিন্দুটা নিয়েছি।
এখন আমরা জেনে গেছি, সমীকরণের জন্য লাগবে P(x, y) বিন্দুটি কারণ এটি সকল বিন্দুর প্রতিনিধিত্ব করে। আর লাগবে ঢাল, কারণ এটা সরলরেখার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে। এখানে আরেকটা বিষয় জানা দরকার, প্রথমে আমরা y = x + 5 সমীকরণের জন্য নির্দিষ্ট দুইটা বিন্দু পেয়েছিলাম। তারপর প্রতিটা বিন্দুর ভুজ-কোটির মাঝে একটা ফাংশন দেখিয়েছিলাম যাতে আমরা বুঝতে পারি বিন্দুগুলো কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে (ভুজ আর কোটি দিয়েই বিন্দু তৈরি। তাই এদের সম্পর্ককে বুঝতে পারলে বিন্দুগুলোকে বোঝা যায়)। যেহেতু সমীকরণ তৈরির সময় আমরা নির্দিষ্ট রেখা পাচ্ছি না, তাই নির্দিষ্ট বিন্দু পাওয়াও সম্ভব না। এইজন্যই একটা বীজগাণিতিক বিন্দু P(x, y) নিয়েছি। ঢাল শব্দটাও ইতোমধ্যে বলেছি কিন্তু সেটা কী খায়, না বল খেলে সেটা বলিনি। সমীকরণের জন্য যেহেতু ঢাল লাগবেই তাই একটুখানি পরিচয় না দিলেই নয়।
❝ ঢাল হচ্ছে সরলরেখার পরিবর্তনের হার। ❞
সরলরেখা বিন্দু দিয়ে তৈরি। বিন্দুগুলো ভূজ (x), কোটি (y) দিয়ে তৈরি, তাই ঢাল হলো x এর মান বৃদ্ধির সাথে সাথে y এর মান বৃদ্ধির হার।
ঢাল দিয়ে যেহেতু সরলেরেখার পরিবর্তন বা বৈশিষ্ট্য মাপা হয়, তাই একক মাপ বা হারটা জরুরি।
মনে করো দুইটা বিন্দু– (2, 1), (5, 3)
এখানে,
x এর মান 3 একক বেড়েছে যার জন্য y বেড়েছে 2 একক
∴ x এর মান 1 একক বাড়লে y বেড়েছে ⅔ একক।
⅔, এটাই ঢাল।
তাহলে সাধারণ সূত্রটা হলো,
ঢাল = (y₂ – y₁) ÷ (x₂ – x₁)
বা, (Δy/Δx)
(Δy হলো y এর পরিবর্তন Δx হলো x এর পরিবর্তন। আশা করি বুঝতে পেরেছ।)
একটা সরলরেখার ঢাল সবসময় একই থাকে। কারণ ঢাল মূলত একটা অনুপাত (Δy/Δx) । তাই নির্দিষ্ট একটা সরলরেখার যে-কোনো বিন্দুর ঢাল একই থাকে। এই বিষয়টাই আসলে সমীকরণ তৈরির সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এত বকবকানির কারণ হলো সমীকরণ তৈরির জন্য এগুলো অনেক বেশি দরকার। এখন আমরা সমীকরণ বানাই। ভয় পাবার কিছু নেই, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই সমীকরণ নির্ভর করবে।
দেখেছ কী চক্ষু মেলিয়া:
সরলরেখার সকল বিন্দুগুলোর ভুজ আর কোটি একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। প্রথমেই কিন্তু আমরা সেটা উদাহরণে দেখেছি। সেখানে ভুজের সাথে ৫ যোগ হয়ে কোটি হয়েছে। সেই সরলরেখার সববিন্দুই কিন্তু এই নিয়ম মেনে চলছে!
বি দ্র লেখাটা সিরিজ আকারে চলবে।
তথ্যসূত্রঃ
- https://youtu.be/_QFkRcAN1x0
- প্রাণের মাঝে গণিত বাজে: জ্যামিতির জন্য ভালোবাসা—সৌমিত্র চক্রবর্তী
- ইউক্লিড ও এলিমেন্ট — আসিফ
Leave a Reply