ইসলামি স্বর্ণযুগ সম্পর্কে আমরা কমবেশি সকলেই জানি। পূর্বের একটি ব্লগপোস্টে আমি সেই সময়ের ৫ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য তুলে ধরেছিলাম। যদি সেই লেখাটা না পড়ে থাকেন, তাহলে এখনি পড়ে ফেলুন “ইসলামি স্বর্ণযুগের পাঁচ তারকা”। পাঠকদের আগ্রহ দেখে সাহস করে তারই ধারাবাহিকতায় এই ব্লগপোস্টটি লিখছি। এখানেও চেনা-অচেনা পাঁচ জন বহুবিদ্যাবিশারদ ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে কথা হবে। তো, দেরি কীসের? চলেন, শুরু করি!
আব্বাস ইবনে ফিরনাস
আব্বাস ইবনে ফিরনাস ছিলেন একজন মুসলিম আন্দালুসিয়ান জ্যোতির্বিদ, চিকিৎসক এবং রসায়নবিদ, যাকে আমরা খুব কম মানুষই চিনে থাকি। ইউরোপিয়ানদের বহু আগেই এই মুসলিম বিজ্ঞানী অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গিয়েছিলেন। তিনি ৮১০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
ফিরনাস একটি সৌরমডেল তৈরি করেছিলেন। তিনি আল মাকাতা নামক একটি জলঘড়ি তৈরি করেছিলেন। এছাড়াও রক ক্রিস্টাল বা পাথরের স্ফটিককে কাটার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন এই কিংবদন্তি।
আব্বাস ইবনে ফিরনাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল আকাশে উড়ার প্রচেষ্টা। তিনি ওড়ার জন্য গ্লাইডারের মতো এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেন, যেটিতে পালক ও সিল্কের ব্যবহার করা হয়েছিল। ৬৫ বছর বয়সে তিনি আরুস পর্বত থেকে তাঁর সেই যন্ত্র নিয়ে ঝাঁপ দেন এবং প্রায় দশ মিনিট যাবৎ আকাশে ওড়েন। যদিও তিনি ভুলের কারণে ল্যান্ডিং এর সময় প্রচন্ড চোট পান, তবুও ইতিহাস তাঁকেই প্রথম উড্ডয়নকারী ব্যক্তি মনে করে থাকে।
৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এই উড্ডয়ননায়ক মৃত্যুবরণ করেন।
উমর খৈয়াম
আবুল ফাতেহ উমর ইবনে খৈয়াম সেলজুক যুগের একজন গণিতবিদ, কবি এবং জ্যোতির্বিদ। তিনি ১০৪৮ সালে ইরানের নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১০৬৬ সালের এক রাতে উজ্জ্বল হ্যালির ধূমকেতু দেখে তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি কৌতূহল সৃষ্টি হয়।
ইরানের এই গণিতবিদ মাত্র ২২ বছর বয়সে “Treatise on Demonstration of Problems of Algebra” নামে একটি বই লেখেন, যেখানে তিনি ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধানের একটি পদ্ধতি উল্লেখ করেন। এই বইয়ে তিনি বৃত্ত, প্যারাবোলা ইত্যাদি ব্যবহার করে অমূল্য কাজ করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, উমর খৈয়াম দ্বিপদী বিস্তৃতিতেও বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। এছাড়াও সৌর বছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করা, ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা করা ইত্যাদি তাঁর বিশেষ অবদান।
উমর খৈয়ামের ৯৭১ তম জন্মদিনে এই মহান ব্যক্তির অবদানের জন্য গুগল ডুডল তৈরি করে সম্মাননা প্রদান করে। তিনি ১১৩১ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
আল বিরুনি
মুসলিম মনীষী আবু রাইহান আল বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮ খ্রি.) পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি পরিচিত নাম। তিনি শতাধিক বিভিন্ন ধরনের ধাতু ও পাথর সংগ্রহ করে সেগুলো নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করেন। তিনি প্রায় ১৮ ধরনের মূল্যবান ধাতু ও পাথরের ঘনত্ব নির্ণয় করেন। স্থিতিবিদ্যা (Statics) ও গতিবিদ্যাকে (Dynamics) একীভূত করে বলবিদ্যা (Mechanics) নামক গবেষণার নতুন ক্ষেত্র প্রবর্তন করেন।
আল বিরুনির লেখা বইগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং ভূগোলের উপর ভিত্তি করে রচিত। তিনি হাইড্রোস্ট্যাটিক ব্যালেন্স ব্যবহার করে ঘনত্ব নির্ধারণের জন্য বিশেষ পদ্ধতি তৈরি করেন। আল বিরুনি ত্রিকোণমিতির সাহায্যে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয়ের একটি উপায় প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি অনুমান করেছিলেন যে সূর্য স্থির নয়।
এছাড়াও আল বিরুনি মাধ্যাকর্ষণ,পৃথিবীর কক্ষপথ, চিকিৎসাবিদ্যা, জিওডেসি, ফুল ইত্যাদি নিয়েও বিশেষ মতামত ও ধারণা দিয়েছিলেন এবং মৌলিক কাজ করেছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৪৬। এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গবেষককে যদিও সেভাবে স্মরণ করা হয় না, কিন্তু তিনি তাঁর সমকালীনদের চেয়েও অধিকতর জ্ঞানী ছিলেন
আল রাযি
আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া আল রাযি ইরানের তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন জুন্দেরশাহপুর ও বাগদাদে সরকারি চিকিৎসালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়া থেকে আসা রোগীদের চিকিৎসা করতেন। আর সে সময় থেকেই তাঁর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই চিকিৎসাবিদের অস্ত্রোপচার পদ্ধতি গ্রিকদের থেকেও উন্নত আর স্বতন্ত্র ছিল।
আল রাযি একজন বহুবিদ্যাবিশারদ ছিলেন। ধারণা করা হয়, তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২০০ এরও বেশি। এর মধ্যে অন্যতম হলো “আল জুদাইরি ওয়াল হাসবাহ” এবং ১০ খন্ডে রচিত “আল মানসুরি”। তিনি শারীরবিদ্যা এবং অঙ্গসংস্থান নিয়ে নতুন ধারণা ও মতবাদ দিয়েছিলেন। তিনি গুটিবসন্ত ও হামের মধ্যে মোটা দাগে পার্থক্য করেন।
এই শল্যচিকিৎসাবিদ চর্মরোগ, শল্যচিকিৎসা, জ্বর ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন। সালফিউরিক এসিড আবিষ্কার করেন। এছাড়াও ইথানল উৎপাদন, বিশোধন ও চিকিৎসায় এর ব্যবহার করেন।
ইবনুন নাফিস
আপনি হয়ত ইবনুন নাফিসের নাম শোনেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন সেরা আরব্য শল্যচিকিৎসাবিদ। ইবনুন নাফিস (ইবনে আল নাফিস) ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জন্মগ্রহণ করেন। মানবদেহে বায়ু ও রক্ত সঞ্চালনের পদ্ধতি নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রদান করেছিলেন। রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কিত সেসময়ে প্রচলিত গ্যালেনের মতবাদকে ভুল প্রমাণ করাই ছিল ইবনুন নাফিসের সবচেয়ে বড় সফলতাগুলোর একটি।
ইবনুন নাফিস বলেন যে রক্ত হৃৎপিন্ড হতে শিরার মাধ্যমে ফুসফুসে এবং সেখান থেকে আবার শিরার মাধ্যমে রক্ত অক্সিজেন সহকারে হৃৎপিন্ডে প্রবেশ করে। একে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে “পালমোনারি সঞ্চালন” বলা হয়ে থাকে।
সুলতান বাইবার্সের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইবনুন নাফিসের মতবাদ বিজ্ঞানপন্থী হলেও পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদেরা তাঁর কর্মকে স্বীকৃতি দেয়নি। তিনি বহু প্রাচীন ধারণার বিরোধীতা করেন। ওষুধের প্রয়োগ ছাড়াই খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চিকিৎসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়াও মনোবিজ্ঞান, চক্ষুবিজ্ঞান, মানব শারীরবিদ্যা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেছিলেন।
ফুসফুসের গঠন, শিরা-উপশিরা দিয়ে রক্তপ্রবাহ, ইউরোলজি ইত্যাদি নিয়ে তিনি যেসব মতামত দিয়েছিলেন, সেগুলো ৩০০ খণ্ডের “আল-শামিল ফি আল-তিব”, “বুগিয়াত আল তালিবিন ওয়া হুজ্জাত আল মুতাতাব্বিন”, “আল মুহাদ্দাব ফি ই-কাহ্ল” ইত্যাদি বইয়ে স্থান পেয়েছে। বলা হয়, তিনি কল্পবিজ্ঞানও রচনা করেছিলেন। তবে তাঁর কর্মগুলো প্রায় ৭০০ বছর যাবৎ চাপা পড়ে ছিল।
তো, আজ এই পর্যন্তই। আশা করি, এই ব্লগপোস্টটির মাধ্যমে নতুন কিছু জানতে পেরেছেন। লেখাটা শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
তথ্যসূত্র
১. Abbas Ibn Firnas- University of Houston
২. Who was Abbas Ibn Firnas?
৩. Omar Khayyam | Persian Poet, Astronomer & Mathematician
৪. Al-Bīrūnī- Persian scholar and scientist
৫. Al-Razi | Biography & Facts
৬. Abu Bakr al-Razi
৭. Contributions of Ibn Al-Nafis (1210-1288 AD) to the Progress of Medicine and Urology
৮. Ibn al-Nafis
এই লেখাটি ইতিপূর্বে Scientia Society এর ফেসবুক পেইজে প্রকাশিত হয়েছে
Leave a Reply