গ্রাম কিংবা শহরে প্রায় বাড়িতেই মানুষ বিড়াল পুষে। সংখ্যায় একটা দুটো থেকে শুরু করে আট দশটাও হয়। বাড়ির রান্না করা খাবারের বেঁচে যাওয়া হাড়গোড় সবসময় প্রস্তুত থাকে তার উদরপূর্তির জন্যে। কোনো কোনো বাড়িতে ভূরিভোজ এর খানিকটা অংশ দেয়া হয় তাদের। আর ঘরের আনাচে-কানাচে ঘোরাঘুরি করা ইঁদুরের দল তো আছেই। কেউ কেউ আবার আদর করে নামও রাখে এদের। যেমন আমারই এক সহপাঠীর বাড়িতে দশটা বিড়াল পোষা হয়। এগুলোর আছে হরেক রকমের নাম- লালটু, নীলটু, বল্টু ইত্যাদি। কতই না যত্নআত্তি হয় এদের। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে হরহামেশাই দেখা যায়, খেতে বসা থেকে শুরু করে ঘুমোতে যাওয়া অবধিও বিড়াল তার মালিকের সঙ্গী। কাউকে দেখা যায় আদর করে বেশ সূক্ষ্ম গলায় তার পোষা বিড়ালটাকে ডাকছে। বিড়ালও তার মালিকের গলা শুনে দৌড়ে ছুটে আসছে। যেন সে তার মালিকের কথাবার্তা, আবেগ সবই বুঝতে পারে। কিন্তু একটা প্রশ্ন প্রায়শই আমার মাথায় আসে, কেন মানুষ বিড়াল পুষে? এতে মানুষের লাভটা কি?
যেমন মানুষ কুকুরও পুষে। কুকুর তার প্রভুর অনেক কাজেই লাগে। বাড়ি পাহারা দেয়া থেকে শুরু করে, মালামাল এগিয়ে দেওয়াসহ আরও অনেক কাজ। কিন্তু বিড়াল? এই প্রাণীটা আমাদের কোন কাজে লাগে? আপনি ভাবতে পারেন, বিড়াল ঘরের ইঁদুর মেরে সাফ করে দেয়। কিন্তু বিড়াল কি আপনার ঘরের ইঁদুর দূর করতে ইঁদুর মারে? না, বিড়াল মাংসাশী প্রাণী। ইঁদুর তাদের পছন্দের শিকার। তাই ইঁদুর দেখলেই হামলা করে সে। উল্টে সে আপনার ঘরের আসবাবপত্র ভেঙ্গেচুড়ে নতুন উপদ্রব শুরু করে। অন্যদিকে পোষা কুকুর সবদিক থেকেই তার প্রভুর উপর নির্ভরশীল। এমনকি আবেগি দিক থেকেও। কিন্তু বিড়াল হল সোসিওপ্যাথ ধরনের। অর্থাৎ এরা সামাজিক না। মালিক যদি নিয়মিত খাবার এর ব্যবস্থা না করতে পারে, বিড়াল সে মালিককে ত্যাগ করার সম্ভাবনাই বেশী। বিড়াল আদর লাভের আশায় তার প্রভুর কোলে ছোটে আসে। সত্যি কি শুধু আদর পাওয়ার আশায়? না, এর পেছনে মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে উষ্ণতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। হাজার বছর ধরে বিড়াল মানুষের সাথে বসবাস করছে। কিন্তু বিড়াল মানুষের জন্যে আদৌ কি কিছু করেছে? কেন তাহলে মানুষ বিড়াল পুষে?
এর একটা কারণ হতে পারে, মানুষ এখনো বিড়ালকে ঠিকঠাক মতন বুঝে উঠতে পারে নি। নিজেদের প্রকাশ করার ব্যাপারে এরা বেশ চতুর। এরা এমনভাবে অঙ্গভঙ্গি এবং আচরণ প্রকাশ করে যেন আমরা তা ধরতে না পারি। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এরা সামজিক ভাবে বেশ বুদ্ধিমান। পরিচিত মানুষদের সাথে এরা এতটাই মানানসই হতে পারে যা আমরা ধারণাও করতে পারি না। বিজ্ঞানীরা গৃহপালিত বিড়াল সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে এদের জিন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করছেন। পুরো বিশ্বে গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে সবচাইতে পরিচিত হচ্ছে বিড়াল আর কুকুর। তবে এই দুই প্রাণী সম্পূর্ণই ভিন্নভাবে মানুষের সাথে আচরণ করে। কুকুর তার প্রভু বাড়ি আসা মাত্রই দরজার দিকে উচ্ছ্বাসিত হয়ে ছুটে যায়। কিন্তু বিড়াল নির্লিপ্ত হয়ে এককোণে বসে থাকে।
বিড়ালদের পূর্বপুরুষরা পুরোপুরি ভাবেই নির্জনে একাকী বাস করত। অন্যদিকে কুকুরদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে নেকড়ে, যারা খুবই সামাজিক প্রাণী। আজ থেকে দশ হাজার বছর আগে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় মানুষ বিড়ালকে পোষ মানানো শুরু করেছিল। সাইপ্রাস দ্বীপে ন’হাজার পাঁচশ বছর আগের পুরোনো একটা প্রাচীন সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে একটা মানুষের সাথে একটা বিড়ালকেও সমাহিত করা হয়েছিল। ক্রমবর্ধমান জিনতাত্ত্বিক প্রমাণাদি মানুষ এবং বিড়ালের মধ্যকার দীর্ঘকালের সম্পর্ককে সমর্থন করছে। বিজ্ঞানীরা তিন দশক ধরে বিড়ালের জিনোম নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। উদ্দেশ্য এদের বিবর্তনীয় ইতিহাসটা বোঝা। ২০০৮ সালে একটা গবেষণা দল, পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে এগারো শ সংখ্যক বিড়ালের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার বিড়ালদের ডিএনএ তে সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। এই ঘটনা পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় বিড়ালদের উৎপত্তির ব্যাপারে ইঙ্গিত দেয়। অন্য আরেকটা গবেষণা দল হাজার সংখ্যক বিড়াল নিয়ে কাজ করেও একই ফলাফল পেয়েছে।
মানব ইতিহাসে সে সময়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিড়াল এমন এক সময়ে মানুষদের আশপাশে ভিড়তে শুরু করে, যখন পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় মানুষজন শিকার এবং অন্বেষণ ছেড়ে কৃষিকাজ শুরু করে। মানুষ শস্য জাতীয় খাবার যেমন ভুট্টা ঘরে জমা করতে থাকে। ফলত মানব বসতির আশপাশে পালা করে বাড়তে থাকে ইঁদুরসহ নানারকম ক্ষতিকর জীবের সংখ্যা। আর দুইয়ে দুইয়ে চার মেলার মতই, তখন মানুষদের আশপাশে বিড়ালের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। যেখানে ইঁদুরের আনাগোনা বেশি, সেখানে বিড়াল থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে মানেটা কি দাঁড়াল? মানুষ বিড়ালকে পোষ মানায় নি। বিড়াল বুঝতে পেরেছিল মানুষের কাছাকাছি থাকাটা এদের জন্যে লাভজনক। কেননা মানুষের আশপাশে আছে খাবার। মানুষও তাদের আশপাশে বিড়ালকে মেনে নিয়েছে। বলা যায় বিড়ালই নিজেদের গৃহপালিত করেছে, মানুষ না।
বিবর্তন কি বলে?
মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেসলিএ. লিয়ন এবং তার গবেষণা দল ২০১৪ সালে, সর্বপ্রথম সিনামোন নামে একটা আবিসিনিয়ান গৃহপালিত বিড়ালের সম্পূর্ণ জিনোমের ভাষা পাঠোদ্ধার করেন। বন্যবিড়ালদের তুলনায়, এর জিনোমে নানান জায়গায় প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত হওয়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে। গবেষকরা বিড়ালের জিনোমে ভয়ভীতির প্রতি সংবেদনশীলতা প্রকাশ এবং রিঅ্যাওয়ার্ড প্রক্রিয়া সম্পর্কে শেখার সাথে সম্পৃক্ত জিন শনাক্ত করেছেন। কিছু কিছু বিড়াল মানুষদের প্রতি বেশী সহনশীল হতে পেরেছে কারণ এরা সাহসী কিংবা অপেক্ষাকৃত কম ভিতু। সুতরাং এরা বেশী বেশী ইঁদুর শিকার করতে পেরেছে। আর তাই বিবর্তন যে-সব বিড়াল মানুষদের কম ভয় পেত তাদেরকেই বেছে নিয়েছে। তারপর সময় যত গড়িয়েছে মানুষ আর বিড়ালের মধ্যকার সম্পর্ক আরও বেশি গাঢ় হয়েছে। প্রাচীন মিশরে প্রায়ই বিড়ালদের মমি বানানো হতো। সেসব মমি থেকে সংগ্রহকৃত ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এরা সবাই পোষা বিড়ালই ছিল। পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যের হাত ধরে পোষা বিড়াল দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। আফ্রিকান বুনোবিড়ালের দল সুদূর উত্তরে এবং পোল্যান্ড এ আট হাজার বছর আগে ঘোরাঘুরি করত।
হতেও পারে এদের সাথে ইউরেশিয়ান বিড়ালের আন্তঃপ্রজনন সংঘটিত হয় যারা কিনা নিজেদের জিনোমে আফ্রিকান বুনোবিড়ালদের জিন বহন করছে। ২০১৮ সালে সম্পাদিত হওয়া একটা গবেষণা বলছে, মধ্য ইউরোপে বাস করা কিছু বিড়াল রোমানদেরও দু’হাজার বছর পূর্বের পোষা বিড়ালদের জিনোমিক চিহ্ন নিজেদের জিনোমে বহন করছে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল যে, আধুনিক কালের পোষা বিড়ালদের পূর্বসূরি হয় আফ্রিকান প্রাচীন বন্যবিড়াল নয়তো পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার বন্যবিড়াল। এই বিভ্রান্তি সৃষ্টির মূল কারণ হল বুনোবিড়াল প্রজাতি এবং উপপ্রজাতিরা নিজেদের মধ্যে প্রজননে অংশ নেয় খুবই কম। এখনো অবধি তাই-ই। মানুষ নির্বাচিত ভাবে বিড়ালের প্রজনন ঘটানোর চর্চা করছে মাত্র দু’শ বছর ধরে। এক্ষেত্রে কেবল বিড়ালের বাহ্যিক রূপের দিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়, ব্যবহারিক উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবা হয় না। তবে অধিকাংশ বিড়াল প্রজাতিই এই প্রক্রিয়ার আওতায় থাকে না। এরা নিজেদের ইচ্ছে মতনই প্রজননে অংশ নেয়।
অন্যদিকে শতাব্দী জুড়ে কুকুরের প্রজনন ঘটানো হয়েছে তাদেরকে নানা রকম ব্যবহারিক দিকে দক্ষ করে গড়ে তোলবার জন্যে। যেমন শিকার থেকে শুরু করে বাজারের থলে বহন করবার জন্যে। বিড়াল এখনো তার নিজস্ব প্রাকৃতিক আচরণ থেকে বেরোতে পারে নি। যেমন এখনো বাইরে গেলে বিড়াল শিকার ধরবার পেছনে ছোটাছুটি শুরু করে। অন্যান্য পোষা প্রাণীর তুলনায় বিড়ালের নিজস্ব দৈনন্দিন রুটিন এর উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে। আপনার পোষা বিড়ালকে যদি বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দেন, তাহলেও সে একাই নিজের জীবন বেশ ভালো ভাবে যাপন করতে পারবে। বাইরে পাখি, ইঁদুর আর টিকটিকি শিকার করে বেশ ভালোই চলে যাবে তার। সুতরাং বিড়ালের আসলে মানুষের সাথে বাস করবার খুব জরুরি দরকার নেই। কিন্তু তারপরেও বিড়ালের প্রতি মানুষের আদুরে ভাবভঙ্গির কমতি হবে না। মানুষ একাকী ঘরে তার আদুরে পোষা বিড়ালটার সঙ্গে বেশ উচ্চস্বরে, আদুরে গলায় কথা বলে। যেমনটা মানুষ তার নিজের শিশু সন্তানের সাথে করে। মানুষ পোষা কুকুরের সাথেও এমনটা করে। আমরা কি নিজেদের সাথে মজা করছি? হয়ত না। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিড়াল মানুষের আচার আচরণের সাথে বেশ মানানসই। আর সেটা আমাদের ধারণারও বাইরে।
আমরা যখন বিড়ালের সঙ্গে কথা বলি তারা সেটা বুঝতে পারে। গবেষকরা বিষয়টা নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখেছন। দুজন মানুষকে একটা বিড়ালের সঙ্গে আদুরে গলায় কথা বলতে বলা হল। এদের মধ্যে একজন বিড়ালটার মালিক অন্যজন অপরিচিত। মালিক যখন কথা বলল, তখন বিড়ালটা বিভিন্ন রকম ভঙ্গি করে প্রতিক্রিয়া জানাল। চারপাশে তাকাচ্ছে, কান কিংবা লেজ নাড়ছে। কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তির কথায় সে কোনোরকম প্রতিক্রিয়াই জানালো না। তার মানে বিড়াল সব মানুষকে সমান ভাবে নেয় না। মালিকের প্রতি তাদের সত্যি সত্যি বিশেষ অনুভূতি আছে। এই এক্সপেরিমেন্ট বিড়ালদের সামাজিক দক্ষতার ব্যাপারে খানিকটা আলোকপাত করে। গত ক’বছরে জাপানিজ গবেষকরা এই বিষয়ে বেশ ক’টা অবাককরা আবিষ্কার করেছেন। যেমন বিড়াল নিজেদের নাম চিনতে পারে। মালিক তার পোষা বিড়ালের নাম ধরে ডাকলে, বিড়াল তার লেজ এবং কান ভিন্ন ভাবে নাড়াতে থাকে। অন্যান্য কথার প্রতি এইরকম ভঙ্গিতে লেজ কিংবা কান নাড়ে না। তবে আপনার পোষা বিড়ালটিও যে শতভাগ নিশ্চিত ভাবেই নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেবে তা নাও হতে পারে। বিড়াল মানুষের ডাকে সাড়া দেবার জন্যে বিবর্তিত হয় নি। তারা নিজেরা যখন চাইবে কেবল তখনই মানুষের সাথে যোগাযোগ করবে।
বিড়ালের মানচিত্র
কিছু গবেষকদের মতে, বিড়াল ভিন্ন এক উপায়ে তাদের মালিকের সাথে অভিযোজিত হয়। ঘরের কোন কোণ থেকে তার মালিক তাকে ডাকছে বিড়াল সেটা মনে মনে ম্যাপ করতে পারে। মালিকের গলার আওয়াজ শুনেই বিড়াল সেটা ধরতে পারে। গবেষকরা মানুষের আওয়াজ রেকর্ড করে ভিন্ন ভিন্ন স্পিকার থেকে রেকর্ড গুলো বাজান। এমনভাবে স্পিকার গুলো বাজানো হল যেন মনে হয় কোনো মানুষ এক ঘর থেকে অন্য ঘরে কথা বলছে। দেখা যায় বিড়াল রেকর্ড গুলো শোনে চারপাশে তাকাচ্ছে, কান নাড়ছে। এভাবেই বিড়াল মানুষকে সতর্ক ভাবে শোনার চেষ্টা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়াল একই সঙ্গে মানুষের ভিন্ন ভিন্ন সংকেতে ভালো সাড়া দেয়। আপনি বিড়ালের নাম ধরে ডাকার পাশাপাশি যদি আপনার হাতটাও এগিয়ে দেন, তখন বেশ দ্রুত সাড়া দেয়। কিন্তু শুধু নাম ধরে ডাকলে কিংবা হাত বাড়ালে সেরকম সাড়া দেয় না। বিড়াল হিংসাত্মক মনোভাবও প্রকাশ করতে জানে। আপনি যদি আপনার পোষা বিড়ালের সামনে একটা খেলনা বিড়ালকে আদর করতে থাকেন, সে খেলনা বিড়ালটাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে।
২০১৭ সালে করা একটা গবেষণায় আরো অবাককরা তথ্য বেরিয়ে আসে। বিজ্ঞানীরা বিড়ালকে- খাবার, খেলনা, গন্ধ এবং মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়া- এই চার ধরনের উদ্দীপক দিয়ে পরীক্ষা করার চেষ্টা করেন। দেখা গেল, বিড়াল মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়াকেই সবচাইতে বেশি প্রাধান্য দেয়। পছন্দের দ্বিতীয় তালিকায় থাকে খাবার। মানুষের সাথে বিড়ালের আবেগি যোগসাজশটা কেমন? সেটা বোঝার জন্যেও করা হল একটা এক্সপেরিমেন্ট। তিন থেকে আট মাস বয়সী সত্তরটা বিড়াল ছানাকে তাদের মালিকের সহিত একটা অপরিচিত ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। তারপর কিছুক্ষণের জন্যে বিড়াল ছানাগুলোকে ঘরটায় একা ছেড়ে দেয়া হল। মিনিট দুয়েক পরে মালিক যখন পুনরায় ঘরে প্রবেশ করেন, তখন ছানা গুলোর মধ্যে ৬৪ শতাংশই তার মালিকের প্রতি বেশ নিরাপদ একটা আবেগি সংযোগ প্রকাশ করল। ছানাগুলোকে তখন পুনরায় বেশ খুশি মনে এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘরে ছুটাছুটি শুরু করে দিলো। ঠিক মানব শিশুরাও তাদের বাবা-মা এবং যত্নশীলদের প্রতি একই রকম আবেগি সংযোগ প্রকাশ করে। বিড়াল ছানারাও তাদের মালিককে দেখে নিজেদের নিরাপদ মনে করে। এই গবেষণা বলে বিড়াল মানুষের সাথে বেশ দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।
আসলেই কি তাই? অনেকেই এই ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেন। কেননা বিড়াল মানুষের সাথে যোগাযোগ এর জন্যে সেরকম কোনো অঙ্গভঙ্গি করে না যেমনটা কুকুর করে। কুকুর ছানাদের মতন চোখের ভ্রূ উপরে তোলবার জন্যে যথেষ্ট পেশি বিড়ালদের নেই। তবে বিভিন্ন গবেষণা বলে, বিড়াল তার চেহারার পাশাপাশি মানুষদের সাথে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সামাজিক দক্ষতাও অর্জন করেছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বিড়াল দিনদিন দক্ষ গৃহপালিত পোষা প্রাণীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর একটা কারণ হতে পারে, দীর্ঘদিন ধরে মানুষ এদেরকে ঘরে পুষে আসছে। কিছু সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে মধ্য যুগে বিড়াল মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কিছু কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখত। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, মধ্য যুগের বিড়ালদের নিয়ে কোনোরকম গবেষণা করা সম্ভব হয় নি। এমনকি আমাদের কাছে এখনো বিভিন্ন শতাব্দীর বিড়ালদের কোনো ডিএনএ নমুনাও নেই। সুতরাং বিড়াল এখনো অবধি বিবর্তিত হচ্ছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় নি। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিড়ালরা তাদের মালিকের সাথে একটা দৃঢ় সম্পর্ক অনুভব করে।
বিড়ালের অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড
বিড়াল অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা করে বেড়ায়। যেমন বিড়াল কোনো বাক্সের ভেতর ঢুকে বসে থাকতে পছন্দ করে। মাঝে মাঝেই দেখা যায়, বিড়াল চারকোনা বাক্সের ভেতরে বসে ফেল ফেল করে বাইরে তাকিয়ে আছে। শুধু ঘরে পোষা বিড়ালই না, বুনোবিড়ালেরও বেশ পছন্দের কাজ এইটা। এমনকি বিগ ক্যাট নামে পরিচিত বাঘও বাক্সের ভেতর বসে থাকতে পছন্দ করে। বিড়ালের এমন অদ্ভুত কাণ্ডের পেছনে কারণ কি হতে পারে? বাক্সের ভেতরের চার দেয়াল বিড়ালের শরীরে চারদিক থেকে মৃদু চাপ সৃষ্টি করে, এতে বিড়াল আরামবোধ করে। কিংবা এও হতে পারে, বিড়াল বাক্সের ভেতর ঘাপটি মেরে শিকারের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।
বাক্স পছন্দ করার ব্যাপার না হয় বোঝা গেল, কিন্তু বিড়াল কাগজের পৃষ্ঠার উপরেও বসে থাকতে পছন্দ করে। কিংবা বাক্সের মত দেখতে সমতল মেঝেতেও বসে থাকে, এর করণ কি? গবেষকরা এক চতুর্থাংশ কাটা এমন চারটা বৃত্তাকার কাগজের টুকরো এমনভাবে রাখলেন যেন বৃত্তগুলোর কাঁটা অংশগুলো দিয়ে একটা বর্গ তৈরি হয়। এ ধরনের বর্গের নাম কানিজসা স্কোয়ার (Kanizsa square)। দেখা গেল, গবেষণায় ব্যবহৃত প্রতিটা বিড়ালই এই ধরনের বর্গে বসে থাকতে পছন্দ করে। এর পেছনে কারণ কি হতে পারে? ঘরের ভেতরে নতুন কোনো বস্তু দেখলেই বিড়াল চায় তার মধ্যে নিজের শরীরের গন্ধ ছড়াতে। এতে বিড়াল নিজেকে নিরাপদ মনে করে। হয়ত এই কারণেই বিড়াল নতুন কোনো আকৃতি দেখলে তার উপর বসে পড়ে।
কীভাবে বুঝবেন আপনার বিড়াল তার নিজের নাম জানে? খুব সহজ একটা উপায় হলো, আপনার পোষা বিড়ালের সামনে একবার নাম ধরে ডাকুন এবং পরেরবার অন্য কিছু বলুন। যদি সে তার নিজের নাম জানে, তাহলে আপনি যখন নাম ধরে ডাকবেন তখন অপেক্ষাকৃত ঘন ঘন মাথা, লেজ অথবা কান নাড়তে থাকবে। বিড়াল কি তার মালিকের দৃষ্টিপাত ধরতে পারে? হ্যাঁ, পারে। আপনি আপনার পোষা বিড়ালের সামনে দুইটা আলাদা পাত্রের একটায় খাবার দিন। তারপর তার নাম ধরে ডাকার পাশাপাশি খাবার সমেত পাত্রটায় দৃষ্টিপাত করুন। গবেষণায় দেখা যায়, সত্তর শতাংশ সময়েই বিড়াল খাবার রাখা পাত্রটা শনাক্ত করতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ নিউ সায়ন্টিস্ট ম্যাগাজিন এর “The truth about cats” প্রবন্ধ আলোকে লেখা।
Leave a Reply