২০২৫ এর জানুয়ারিতে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. সৈয়দ উদ্দিন একটি বিজ্ঞান বক্তৃতা দেবেন। রেজিস্ট্রেশন করে ফেলুন এই লিঙ্ক থেকে: https://cassa.site/event/colloquium-3/

ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ: মানুষের আঙুলের ছাপ থাকে না যে রোগে 

২০০৭ সাল। সুইজারল্যান্ড অধিবাসী এক মহিলা কোনো এক কাজে যুক্তরাষ্ট্রে  যাবেন ঠিক করেছেন। কিন্তু কাস্টমস অফিসাররা বিমানবন্দরে আটকে দিলেন তাকে। পাসপোর্ট এর ছবির সাথে মহিলার চেহারার মিল থাকলেও কাস্টমস অফিসাররা তার কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট রেকর্ড করতে পারলেন না। মহিলা শরণাপন্ন হলেন বিখ্যাত সুইস ডার্মাটোলোজিস্ট পিটার ইটিন এর। ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডা. ইটিন দেখলেন মহিলার আঙুলে আদৌ কোনো ছাপই নেই! শুধু তাইনা পরবর্তীতে দেখা গেলো ঐ মহিলা ও তার পরিবারের আট সদস্যের কারোরই আঙুলের ছাপ নেই!

ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিং

বর্তমান বিশ্বে বায়োমেট্রিকস প্রযুক্তির সাহায্যে ব্যক্তি শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া খুবই জনপ্রিয় ও সময়োপযোগী একটি কৌশল। এর সাহায্যে কোনো ব্যক্তির ডিএনএ,ফিঙ্গারপ্রিন্ট, চোখের রেটিনা, আইরিশ প্রভৃতির তথ্য বিশ্লেষণ করে নির্ভুল ভাবে কোনো ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতিটি হলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিং। এর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির আঙুলের ছাপের ইমেজ নিয়ে এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলোকে ফিল্টার করে বাইনারি কোড হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে সে ব্যক্তির আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণ করে সংরক্ষিত ডেটার সাথে মিলিয়ে সহজেই তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয় পত্র,পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রভৃতির ক্ষেত্রে ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিং একটি পরিচিত নাম।   

এখানে যে তথ্যটিকে একক হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেটি হলো আঙুলের ছাপ। কেননা আঙুলের ছাপ প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু এমন যদি হয় যে কোনো ব্যক্তির আঙুলের ছাপই নেই, তাহলে সেক্ষেত্রে কীভাবে তাকে শনাক্ত করা সম্ভব? নাকি আদৌ এটা সম্ভব যে কারো আঙুলের ছাপই থাকবে না? 

অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়ায় আক্রান্ত অমল সরকারের হাত!

অবশেষে সেসময় মহিলার বিদেশ যাত্রা পণ্ড হলো। এই যে মহিলার বিদেশ যেতে নানা বিলম্ব হলো সেজন্য ডা. ইটিন এ রোগকে ‘ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ (Immigration Delay Disease)’ নামে অভিহিত করেন। এ রোগের পোশাকি নাম অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া (Adermatoglyphia)। বর্তমানে বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি পরিবারে বিরল এ রোগের সন্ধান পাওয়া গেছে।    

ডার্মাটোগ্লিফ বা সূক্ষ্ণ ছাপ বা রেখা রয়েছে মানুষের হাতের ও পায়ের আঙুলে, হাতের তালু, পায়ের পাতা প্রভৃতি স্থানে। একটি শিশুর ভ্রূণাবস্থায় নিষেকের ১০-১৭ সপ্তাহ পরে এসব রেখা দেখা যায়। আর এসব রেখার গঠনে বিভিন্ন জেনেটিক ও পরিবেশগত উপাদান দারুণ ভূমিকা পালন করে। ভ্রণাবস্থায় বিভিন্ন জিনের সহায়তায় তৈরি সূক্ষ্ণ রেখার স্বতন্ত্র এসব প্যাটার্ন একজন ব্যক্তির সারাজীবনই বিদ্যমান থাকে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আঙুলের ছাপ ছাড়াও যে ব্যক্তি রয়েছে একথাও নির্মোঘ সত্য।

কেন হয় অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া ? 

অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া মূলত SMARCAD1 নামক  জিনে মিউটেশনের কারণে হয়ে থাকে।  কিভাবে মিউটেশনের মাধ্যমে এ রোগটি হচ্ছে সেটি বোঝার আগে  ডিএনএ(DNA), জিন (Gene), মিউটেশন (Mutation) এসব বিষয়ে সংক্ষেপে একটু পরিষ্কার ধারণা নেয়া যাক। ডিএনএ বা ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড হচ্ছে জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক। অর্থাৎ জীবের সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ ও বংশ পরম্পরায় বহন করার অন্যতম মাধ্যম এটি। ডিঅক্সিরাইবোস সুগার, ফসফোরিক এসিড এবং অ্যাডিনিন(A), গুয়ানিন(G), সাইটোসিন(C) ও থাইমিন(T) নামক চার ধরনের বেস (ক্ষারক) নিয়ে এটি গঠিত। ডিএনএতে এ চার ধরনের বেস একটা সুনির্দিষ্ট সিকোয়েন্সে সজ্জিত থাকে।

অন্যদিকে জিন হলো ক্রোমোসোমের একটা নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থিত ডিএনএ অণুর সুনির্দিষ্ট সিকোয়েন্স। এই সিকোয়েন্স একটি কর্মক্ষম পলিপেপটাইড চেইন তৈরির বার্তা বহন করতে পারে। পরবর্তীতে যা প্রোটিন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর এ প্রোটিন দেহে  বিভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশে সহায়তা করে। কেননা আমরা জানি জীবদেহ নানা জৈব ক্রিয়া-বিক্রিয়ার সমষ্টি মাত্র। এসব বিক্রিয়ায় প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে এনজাইম। আর সকল এনজাইমই হচ্ছে প্রোটিন। আবার জীবদেহের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে হরমোনের ভূমিকা অনবদ্য। অধিকাংশ হরমোনই হচ্ছে প্রোটিন। প্রোটিনের এসব বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্যের কারণে  একে জীবনের ভাষা বলা হয়।    

স্বাভাবিক ডিএনএ (বামে), মিউটেশনের পরে ডিএনএ (ডানে)

আর ডিএনএ এর সুনির্দিষ্ট বেস সিকোয়েন্সের স্থায়ী কোনো পরিবর্তন ঘটাকে মিউটেশন বলা হয়। বেস সিকোয়েন্সের এ পরিবর্তন বিভিন্নভাবে হতে পারে। ডিএনএ রেপ্লিকেশনের (ডিএনএ থেকে ডিএনএ তৈরির প্রক্রিয়া) সময় কোনো ভুলের কারনে, এক্স-রে বা অতিবেগুনী রশ্মির সংস্পর্শে আসলে কিংবা বাহ্যিক পরিবেশের বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের কারনে ডিএনএ এর সিকোয়েন্সে স্থায়ী পরিবর্তন তথা মিউটেশন হতে পারে। এখন কথা হচ্ছে এ মিউটেশন এর জন্য আসলে কী ক্ষতি হতে পারে? একটু আগেই বলেছি যে দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বা সুনির্দিষ্ট কোনো কাজে প্রোটিনের ভূমিকা অনবদ্য। আর মিউটশনের ফলে এই প্রোটিনের উৎপাদনেই একটা বড়সড় ব্যাঘাত ঘটে। কখনো’বা কোনো নির্দিষ্ট প্রোটিন নাও তৈরি হতে পারে মিউটশনের কারনে। আর প্রোটিনের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটা মানেই দেহের ভ্রূণাবস্থায় বা পরবর্তীতে দেহের কোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ব্যাঘাত ঘটা।   

এখন SMARCAD1 জিনের মিউটশনে আসা যাক । SMARCAD1 জিন মূলত দুই ধরনের SMARCAD1 প্রোটিন তৈরির জন্য বার্তা বহন করে। একটি সম্পূর্ণ, আরেকটি আংশিক সংস্করণ। সম্পূর্ণ SMARCAD1 প্রোটিন দেহের বিভিন্ন কোষের জেনেটিক তথ্যের স্থায়ীত্ব রক্ষা করে। অন্যদিকে আংশিক SMARCAD1 প্রোটিনটি  শুধুমাত্র  দেহের ত্বকে সক্রিয় থাকে এবং জন্মের পূর্বে হাতের আঙুলের ছাপ বা ডার্মাটোগ্লিফ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতপক্ষে এই আংশিক SMARCAD1 প্রোটিনটার কাজে ব্যাঘাত ঘটার কারণেই অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া নামক এ বিরল রোগ হয়। মিউটেশনের কারণে এ প্রোটিনের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে ত্বকে এর পরিমাণ কমে যায়। এটি এখনো অস্পষ্ট যে কিভাবে এ জেনেটিক পরিবর্তন অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়ায় ভূমিকা রাখে। তবে  গবেষকরা মনে করেন এই  প্রোটিনটির অভাবে ভ্রূণাবস্থায় দেহের স্বাভাবিক ত্বক ও আঙুলের ছাপ  তৈরির জন্য যে সিগনালিং পাথওয়ের প্রয়োজন হয় তাতে মারাত্মকভাবে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে হাতের আঙুলে কোনো  প্রকার ডার্মাটোগ্লিফ বা ছাপই তৈরি হয়না।   

বিরল এ রোগটি অটোসোমাল ডমিনেন্ট প্যাটার্নে বংশানুক্রমে বাহিত হতে পারে। অর্থাৎ পিতা বা মাতার যেকোনো একজনের মধ্যে এ মিউট্যান্ট জিনটি থাকলেই রোগটি পরবর্তী বংশধরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে আশার কথা হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ রোগের জন্য হাতের আঙুলের ছাপহীনতা ছাড়া অন্যান্য কোনো মারাত্মক উপসর্গের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তবে ত্বকে  ঘামগ্রন্থির পরিমাণ কমে যাওয়া, ত্বকে ফোসকা পড়ার মত কিছু উপসর্গও লক্ষ করা যায়। যেহেতু এটি একটি বিরল রোগ এখনো এ রোগ নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলমান রয়েছে।

বাংলাদেশি অমল সরকার ও তার ছেলের আঙুলে কোনো ছাপ নেই!

বাংলাদেশে অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে বর্তমানে বাংলাদেশেও এ রোগটির উপসর্গের রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে যে এশিয়ার মধ্যে আমাদের দেশেই  প্রথম এমনটা দেখা গেছে। রাজশাহীর পুঠিয়ার অমল সরকারের পরিবারের বেশ কয়েক জনের আঙুলেই কোনো ছাপই নেই! অমল সরকার সহ তার বাবা ও তার দুই ছেলে বিরল এ রোগে ভুগছেন। এজন্য অবশ্য কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি তাদের। এনআইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে গিয়ে বেশ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় অমল সরকারকে। শেষে আঙুলের ছাপ নিতে  ব্যর্থ হয়ে নির্বাচন অফিস থেকে তার এনআইডি কার্ডে লিখে দেয়া হয় ‘আঙুলের ছাপ নেই’। পরবর্তীতে অবশ্য তাদের অন্যান্য বায়োমেট্রিক তথ্যসমূহের (রেটিনা,আইরিশ স্ক্যানিং) রেকর্ড নেয়া হয়।

অমল সরকারের এনআইডির ছবি

মজার ব্যাপার হলো পরিবারের সকলে তারা অমল সরকারের স্ত্রীর এনআইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম কার্ড ব্যবহার করেন। কেননা তার এ রোগটি নেই। এ বিষয়ে বিবিসি থেকে ডা. ইটিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান তাদের এ উপসর্গগুলো সেকেন্ডারি অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়ার জন্য হতে পারে। তবে এ বিষয়ে আরো বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন বলেও জানান তিনি। শুধুমাত্র জিন থেরাপির সাহায্যেই এ রোগের নিরাময় হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন ডা. ইটিন।

তথ্যসূত্রঃ

লেখাটি 213-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. Prabir Acharjee Avatar
    Prabir Acharjee

    Palmist অর্থাৎ হাতের ভাষা নিয়ে যারা কাজ করে তাদের অবশ্য পড়া দরকার। ভালো লাগলো পড়ে।

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading