মিসির আলির ভূত গবেষণা

মিসির আলি হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদের তৈরি করা একটি কাল্পনিক চরিত্র। এই চরিত্রের লোকটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের একজন প্রফেসর। উনি যে শুধু সাইকোলজি বিষয়ে পড়ানই, এমন না। উনার কাছে নানান প্যারা-সাইকোলজির কেইস নিয়ে আসা হয়। উনি ঐ প্যারানরমাল বা অলৌকিক ভূতুরে ঘটনার একটি লৌকিক (Rational) ব্যাখ্যা প্রদান করার চেষ্টা করেন। এছাড়াও ভূত, পিশাচের কাহিনি শুনলেই তিনি সবার আগে সেখানে উপস্থিত হবেন। উপস্থিত হয়ে মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান চালাবেন। সর্বশেষে একটা লৌকিক ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করবেন। এই হলো ‘মিসির আলি কে ও তিনি কী করেন’ প্রশ্নের উত্তর।

একটুখানি মিসির আলি 

মিসির আলির ভূত গবেষণার তত্ত্ব বিশ্লেষণের জন্য আমি আপনাদেরকে মিসির আলির একটা গল্প শুনাতে পারি। ছোট করেই বলি। গল্পের নাম – ‘মিসির আলি আপনি কোথায়’।[1] 

ফারুক নামে মিসির আলির এক ছাত্র ছিল। তার স্ত্রীর নাম আয়না। তার স্ত্রীর সাথে কিছু প্যারানরমাল ঘটনা ঘটে। ফারুক যখন শহরে থাকত আর আয়না গ্রামে, তখন আয়নার সাথে ফোনে কথা বলার সময় একদিন আয়না ফারুককে বলে সে যাতে তাদের বাসার আয়নার সামনে যায়। ফারুক আয়নার সামনে যেয়ে আয়নার মধ্যে তার স্ত্রীকে দেখতে পায়। এছাড়াও ফারুক ও তাদের বাসার কাজের মেয়ে স্বচক্ষে দেখেছে আয়না নামের এই মেয়েটি তাদের বাসার আয়নার মধ্যে ঢুকে গেছে। একজন নাহয় চোখে ভুল দেখতে পারে। দুজন তো আর নয়। 

মাঝে মাঝেই কয়েকদিনের জন্য একটা কক্ষে নিজেকে আটকে রাখে আয়না। এসময় কারো সাথে কথা-বার্তা তো দূরে থাক, দেখা সাক্ষাৎও করে না মেয়েটি। এ সময়ে না খেয়ে কীভাবে বেঁচে থাকে তার উত্তর কারো জানা নেই। এরকম আরো অদ্ভুতুড়ে তত্ত্বের তালাশেই মিসির আলিকে ডেকে নিয়ে যায় ফারুক। 

মিসির আলি চরিত্রে ‘দেবী (২০১৮)’ চলচিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরি। ছবি সূত্র – সি ফর সিনেমা

মিসির আলিও প্রচন্ড অবাকভাবে আবিষ্কার করে যে মেয়েটি যার কাছে ইচ্ছা হয় তার কাছে খুবই সুন্দরী চেহারা নিয়ে হাজির হতে পারে। আবার যার কাছে ইচ্ছা হয় না তার কাছে খুবই কুৎসিত চেহারা নিয়ে হাজির হতে পারে। প্রাণীদেরকে নিয়ন্ত্রন করারও অদ্ভুতসব শক্তি আছে মেয়েটির। মিসির আলি একবার রায়না নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মনে মনে যা ভাবছিলেন তা ঠিক ঠিক বলে দিয়ে মিসির আলিকে একেবারে চমকে দিয়েছিল আয়না। এ হলো গল্পটির মূল রহস্যের বিষয়। এসময়ে মিসির আলি তার এই প্যারানরমাল গল্পের একটি লৌকিক কারণ অনুসন্ধান শুরু করেন। 

ভূত ধরার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি

আমরা সেই পিচ্চিকাল থেকে একটা সায়েন্টিফিক মেথডের ব্যাপারে পড়ে এসেছি। বিজ্ঞান সচরাচর এই সায়েন্টিফিক মেথডোলজি অনুসরণ করেই আগায়। বিজ্ঞান দিয়ে কোনো কিছু সত্য বা ভুল প্রমাণ করার জন্যও সায়েন্টিফিক মেথডোলজি ব্যবহার করতে হয়। এই মেথোডলজির প্রথম ধাপ হচ্ছে — হাইপোথিসিস বা অনুকল্প গঠন। [2]

চিত্র – বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অতি সরলীকৃত ফ্লো চার্ট 

মিসির আলির কথাই ধরা যাক। মিসির আলি আয়নার ঘটনার নানা বিষয় পর্যবেক্ষণের পর তিনটি হাইপোথিসিস দাড় করালেন। 

হাইপোথিসিস ১ — আয়নার ভিতর ঢুকে যাওয়ার অলৌকিক ক্ষমতা আসলেই এই মেয়েটার আছে। এই হাইপোথিসিসের সাথে কমনসেন্স একমত হবে না। বিজ্ঞানের আলোচনা বহির্ভূত ব্যাপার। তাই এই হাইপোথিসিস অবৈজ্ঞানিকভাবে ঘোষণা করা হলো। 
হাইপোথিসিস ২ — আয়নার মধ্যে ঢুকে যাওয়া ভিন্ন কোনো রিয়্যালিটি। এরা শুধু রিয়্যালিটি পরিবর্তন করে। ফলে নিজেকেই নিজে চোখের ধোঁকায় ফেলে দেওয়া যায়। বিভিন্ন ধরণের মাদক যেমন এলএসডি সেবনের প্রভাবে মানুষের রিয়্যালিটির পরিবর্তন ঘটে। 
হাইপোথিসিস ৩ — আয়নার স্বামী মূলত ডিলিউশানের রোগী। তার এই রোগ হওয়ার বিভিন্ন কারণ আছে। অতীত দ্বারা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। আর তার স্ত্রী সিম্প্যাথেটিক ডিলিউশানের রোগী। তার স্বামীর যাতে নিজেকে ভুল বা ছোট না ভাবে তাই সে সিম্প্যাথি দিয়ে সব মেনে নিয়েছে। 

এটা হচ্ছে মিসির আলির বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনের প্রথম ধাপ উত্তোরণ। উনি হাইপোথিসিস গঠন করেছেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে হাইপোথিসিসকে নানা দিক থেকে পরীক্ষা করে দেখা। যেমন উপরের তিনটি হাইপোথিসিসের যে-কোনোটিই সত্য হতে পারে। তাই আমাদেরকে এখন কিছু পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে যাচাই করে দেখতে হবে এর মধ্যে কোন হাইপোথিসিসটি আসল কারণ। 

হাইপোথিসিস ১ এর ক্ষেত্রে মিসির আলি জানিয়েছেন আয়নার নিজস্ব ক্ষমতা নেই যে ও আয়নায় নিজ ইচ্ছায় ঢুকবে। ও হটাৎ ঢুকে যায়। কখন ঢুকবে সেই সময়ের উপর আয়নার নিজস্ব কোনো হাত নেই। আপনি যদি এখন এই হাইপোথিসিস পরীক্ষা করতে চান তাহলে তা পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব না। আর যদি কোনো হাইপোথিসিস পরীক্ষা করা সম্ভব না হয় তাহলে ঐ হাইপোথিসিসকে বিজ্ঞানের গন্ডির বাইরে ধরা হয় বা শর্তসাপেক্ষে অপবিজ্ঞানের কাতারে ধরা হয়। বিজ্ঞানের দার্শনিক কার্ল পপারের ভাষায়, প্রতিটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে পরীক্ষণযোগ্য (Falsifiable) হতে হবে।[3] যদি তত্ত্বটি পরীক্ষণযোগ্য না হয় তাহলে তাকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব (Scientific Theory) হিসেবে গণ্য হবে না। সে হিসেবে যেহেতু এই হাইপোথিসিস — ১ পরীক্ষণযোগ্য না, তাই এটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে অগ্রহণযোগ্য।  

হাইপোথিসিস — ২ এর ক্ষেত্রে যা বলা যায় তা হলো রিয়েলিটি পরিবর্তন করা নিজের মস্তিষ্কের উপর। মস্তিষ্কে নানা কেমিক্যাল রিয়েকশনের কারণে আপনি ভুলভাল জিনিস দেখতে পারেন। এই হাইপোথিসিসকে বিজ্ঞান সমর্থন করবে। কারণ এর আগেও এলএসডি সেবনকারী অনেকের মধ্যে এমন রিয়েলিটি পরিবর্তনের রেকর্ড আছে। এলএসডি সেবন করলে অনেকেই ভিন্ন এক জগতে যেয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে সে প্রচণ্ড হালকা অনুভব করে। এসব গুণ আয়নার ঘটনার বেলাতেও লক্ষ্য করা গেছে।

হাইপোথিসিস — ৩ এর ক্ষেত্রে যা বলা যায় তা হলো ওনারা দুইজনই মানষিক রোগী, ডিলিউশান এর শিকার। এটিও সম্ভব। পূর্বেও এমন পরিস্থিতিতে পড়ে অনেকে ডিলিউশনে ভুগেছে এমন রেকর্ড হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে পাওয়া যায়। তথা এই হাইপোথিসিসও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে পরিণত হবে। 

কিন্তু মিসির আলির কাছে আর কোনো ক্লু না থাকায় তিনি এই দুই হাইপোথিসিসের মধ্যে কোনটি অধিক গ্রহণযোগ্য তা বের করতে পারেননি। ওনাকে এখানেই থেমে যেতে হয়। 

বিজ্ঞানের জগতেও কিন্তু এমন অনেক ঘটনাই ঘটে। দুই তা ততোধিক হাইপোথিসিসের পক্ষেই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু কোনটি অধিক শক্তিশালী বা কীভাবে এই দুই হাইপোথিসিস নিজেদের মধ্যে কানেক্টেড তার উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। তবে বৈজ্ঞানিক কমিউনিটি অনেক বড় হওয়ায় অন্য বিজ্ঞানীরাও ঐ একই বিষয়ে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীতে গিয়ে সফলতা লাভ করেছেন। 

মিসির আলির ভূত গবেষণার আরেকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল ‘লিটারেচার রিভিও’। বিজ্ঞানীরা যখনই কোনো বিষয়ে গবেষণা করেন তখন ঐ বিষয়ে পূর্বে কোন কোন গবেষণা হয়েছে আর তার ফলাফল কী বের হয়েছে তা ঘেটে দেখেন। মিসির আলিও এই কাজটিও করেছেন। যেমন আয়নার সাথে ঘটে চলা ঘটনাটি এর আগে অন্য কারো সাথে ঘটেছে কি না তা তিনি ঘাটাঘাটি করেছেন। 

মিসির আলি খোঁজ পান যে হাসান সাব্বা নামে একজন ব্যক্তি ছিল। সে একটি প্রাসাদ বানিয়েছিল। সে প্রাসাদে তার শিষ্যদের সে নিয়ে আসত। প্রাসাদে ঢোকার আগে তার শিষ্যদের হাশিশ নামে একপ্রকার হেলুসিনেজেটিং ড্রাগ পান করাত। ফলে প্রাসাদে ঢোকার পর তারা এক ভ্রান্তির জগতে চলে যেত। এছাড়াও আয়না চরিত্রটির মতো আয়নায় ঢুকে যাওয়ার অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে মার্থা নামের এক মেয়ের ব্যাপারে প্রচলিত আছে; এসব তথ্য তিনি বই ও বিগত পেপার-পত্রিকা ঘেটে বের করেছেন। 

হাসান সাব্বা শিষ্যদের হাশিশ পান করানোর পর তার প্রাসাদে নিলে শিষ্যরা ভাবত তারা এক অলৌকিক দুনিয়ায় পৌঁছে গিয়েছে। ছবি সূত্র – Ehlen

যখনই আপনি বিজ্ঞান দিয়ে কোনো কিছুর উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করবেন তখন আপনাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতেই হবে। নিজের আশেপাশের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে যেয়ে মিসির আলির এ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ বেশ কার্যকর বলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোকে মিসির আলিকেই অলৌকিক ক্ষমতাবান ভেবে বসে। আয়নার ঘটনাটির ব্যাখ্যা মিসির আলি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়ে করতে পেরেছিলেন কি না তা এ লেখায় বলে পাঠকের আগ্রহ কমিয়ে দিতে চাই না। মিসির আলির গল্পগুলোর থ্রিল বুঝতে তা পাঠকদের জন্য রেখে দিলাম।

তথ্যসূত্র

  • [1] আহমেদ, হুমায়ূন (2009). মিসির আলি! আপনি কোথায়। সময় প্রকাশন
  • [2] Pruzan, P. (2016). Research methodology: the aims, practices and ethics of science. Springer.
  • [3] Popper, K. R. (1963). Science as falsification. Conjectures and refutations, 1(1963), 33-39.

কে. এম. শরীয়াত উল্লাহ Avatar

মন্তব্য

Leave a Reply