খোঁজ মিলল সাগর দানব প্লিওসরের ফসিলের

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

২০২২ সালের বসন্তের একটি দিন। শিল্পী ও জীবাশ্ম শিকারী ফিলিপ জ্যাকবস দক্ষিণ ইংল্যান্ডের জুরাসিক উপকূল ধরে হাঁটছিলেন। এমন সময় তিনি এক কোণে কোনো এক অজানা প্রাণীর একটি স্নোট (প্রাণীদের প্রসারিত নাক বা মুখ) পড়ে থাকতে দেখেন। এটি প্রায় দুই ফুট (২৪ ইঞ্চি) লম্বা ছিল। আপনি কি বুঝতে পারছেন এটা কতটা লম্বা? মানুষের স্নোটের সাইজ বড়জোর দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি হয়। 

স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো জীবাশ্ম বিশেষজ্ঞ স্টিভ এচেস এবং ক্রিস মুরের সাথে এচস কালেকশন মিউজিয়ামের কর্মশালায় প্লিওসোরের খুলি পরীক্ষা করছেন।

যাই হোক, জ্যাকবসের খুঁজে পাওয়া স্নোটটিতে ছিল শ খানেকর বেশি ধারালো দাঁত। পরবর্তীতে একদল নাবিক খেয়াল করলেন, স্নোটটি সৈকতের ধারে একটা উঁচু বাঁধ থেকে পড়েছে। খুলির বাকি অংশটা পড়েছিল বাঁধের উপরেই। জীবাশ্মটির দৈর্ঘ্য ছ ফুটেরও বেশি এবং এর মাথার খুলিতে সবগুলো হাড়ই ঠিকঠাক মতন ছিল। খুলিটির দৈর্ঘ্য বেশিরভাগ মানুষের উচ্চতার চেয়েও বেশি। জীবাশ্মটা আসলে  প্লিওসরের। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন ফসিলটা দেড়শ মিলিয়ন বছরের পুরোনো। তখনকার খাদ্য শৃঙ্খলের শীর্ষে রাজত্ব করত প্রাণীটি। চোয়ালে ছিল ধারালো দাঁত, তেমনি গায়ের জোরও কমতি ছিল না। সর্বভুক এই প্রাণীর পুরো সমুদ্রে একচেটিয়া দখলদারিত্ব ছিল। শিকার তালিকায় থাকত মাছ, হাঙর, ডাইনোসর প্লেসিওসর, ইকথাইসর এবং অন্যান্য সামুদ্রিক সরীসৃপ। এমনকি ছাড় দিত না অন্য প্লিওসরদেরও। কি সাংঘাতিক!   

চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে জীবাশ্ম সংগ্রহ করেন জীবাশ্মবিদ স্টিভ এচেস। তিনি বলেন,

“সদ্য আবিষ্কৃত জীবাশ্মটিতে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এর আগে আবিষ্কৃত হওয়া জীবাশ্ম গুলোতে সেসব দেখা যায় নি। আর এই ফসিলটা সম্পূর্ণ। খুলিতে সবকটা হাড়-ই ঠিকঠাক মতন আছে।” 

সেকারণেই এই জীবাশ্মটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর নিচের চোয়ালটি খুলির সঙ্গে জোড়া লাগানো ছিল। প্লিওসরের প্রথম জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছিল ১৮২০ এর দশকে। পরবর্তীতে আরও কিছু ফসিল পাওয়া যায় যেগুলো বিজ্ঞানীদের  প্লিওসর সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়। তবে এবারেরটা থেকে আরও বেশি তথ্য পাওয়া যাবে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। তাছাড়া জুরাসিক যুগের সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের কাঠামোর ব্যাপারেও জানা যাবে অনেককিছু। খুলিটি জুরাসিক কোস্টের প্রায় সাত মাইল পশ্চিমে জুরাসিক মেরিন লাইফের “দ্য ইচেস কালেকশন মিউজিয়ামে” সংরক্ষিত আছে। জানুয়ারিতে দর্শনার্থীদের খুলিটি দেখানোর উদ্দেশ্যে এটিকে একটি ডিসপ্লে কেসে আনার কাজ চলছে। আসছে বছরে খুলিটি বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডেভিড অ্যাটেনবোরোর বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় টিভি শোতে দেখানো হবে। ‘অ্যাটেনবোরো এন্ড দ্যা জুরাসিক সি মন্সটার’ শিরোনামে এই ডকুমেন্টারিটি প্রচারিত হবে বিবিসি ওয়ানে।

১৫০ মিলিয়ন বছর পুরানো পুনরুদ্ধারকৃত প্লিওসোর খুলি, ডরসেটের জুরাসিক উপকূলের ক্লিফ থেকে খনন করা হয়েছে।

দুইশ থেকে সাড়ে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে বিশাল সমুদ্র জুড়ে বাস করত দানব এই প্রাণী। অর্থাৎ জুরাসিক আর ক্রেটাসিয়াস যুগের কথা। লম্বায় চল্লিশ ফুটেরও বেশি ছিল এরা। অত্যন্ত শক্তিশালী চোয়াল, বিশাল ফ্লিপার এবং ড্যাগারের মতো দাঁতের সাহায্যে এরা সহজেই ধরাশায়ী করত শিকারকে। কামড় বসিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারতো। চলুন, আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। দেখে আসি, এই প্লিওসর কতটা বৈচিত্র্যময় ছিল। প্রথমেই বলব, প্লিওসর আসলে একটা গ্রুপ। এই গ্রুপের অধীনে আছে বহু প্রাণী। যেমনঃ লিওপ্ল্যুরোডন, ক্রোনোসরাস, ম্যাক্রোপ্ল্যাটা, রোমালিওসরাস ইত্যাদি। যুক্তরাজ্য এবং উত্তর ফ্রান্সে লিওপ্ল্যুরোডনদের বসবাস ছিল। সম্ভবত এরা জুরাসিক যুগের শেষ দিকের সময়ের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শিকারী ছিল। এরা অত্যন্ত দ্রুত সাঁতার কাটতে পারতো। আর ক্রোনোসরাসরা মূলত থাকতো অস্ট্রেলিয়ার দিকে। এরা লিওপ্ল্যুরোডনদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিল। এরাও আকারে অনেক বড় হতো। একইভাবে ম্যাক্রোপ্ল্যাটা, রোমালিওসরাস ইত্যাদি প্রাণীদের মধ্যেও স্বতন্ত্র ও একই ধরণের বৈশিষ্ট্য ছিল। 

খুলির প্রায় ১৩০টি দীর্ঘ এবং ধারালো দাঁত রয়েছে। প্রতিটি দাঁতের পিছনে সূক্ষ্ম খোঁজ থাকে যা তার শিকারের মাংস ছিঁড়ে ফেলতে সাহায্য করত।

প্লিওসরদের দেহের নিচের দিকের অংশে প্যাডেল সদৃশ অঙ্গ ছিল, যেটি পানিতে সাঁতার কাটার জন্য ব্যবহৃত হতো। এদের কারও কারও দেহের অনুপাতে গলা ছোট ছিল, আবার কারও ঘাড় ছিল অনেক লম্বা। বিবর্তনবিদদের মতে, টিকটিকি এবং সাপের সাথে এদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এদের শারীরিক সক্ষমতা এবং শিকার দেখে বলা যায় এরা শক্তিশালী টিরানোসরাসদের চাইতেও কয়েক গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল। এদের মধ্যে কেউ কেউ অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের দিকে থাকতো। তবে এদের বাসভূমি এই অঞ্চলের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। কারণ এদের ফসিল মোটামুটি সব মহাদেশ থেকেই পাওয়া গেছে। 

বিজ্ঞানীরা ভাবছেন এই জীবাশ্ম প্লিওসর সম্পর্কে নতুন সূত্র দিতে পারে। এচেস এ সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত। তবে এক্ষেত্রে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রায় ২,৫০,০০০ পাউন্ড বা প্রায় ৩০০,০০০ ডলার খরচ হতে পারে। এনিয়ে আরও গবেষণা আমাদেরকে অনেক কিছু জানান দিবে। হয়ত এর মাধ্যমে জীবের বিবর্তনভিত্তিক ইতিহাসের ব্যাপারেও কিছু জানা যেতে পারে। একারণেই এখন প্যালিওবায়োলজিস্ট ও জীবাশ্মবিদদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সমুদ্র দানবের এই ফসিলটি। 

তথ্যসুত্রঃ

লেখাটি 71-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Response

  1. রুফফা নূর জারিয়াহ Avatar
    রুফফা নূর জারিয়াহ

    Wow,awesome

Leave a Reply to রুফফা নূর জারিয়াহCancel reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading