ভিটামিন ডি এর গল্প ছোটবেলায় নিশ্চয়ই শুনেছেন, তাই না? ছোটবেলায় বিজ্ঞানের বইতে আমরা পড়েছি যে রিকেটস এবং অস্টিওপোরেসিস থেকে বাঁচতে হলে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া দরকার। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী এবং পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভিটামিন ডি এর অভাবে ক্যান্সার, কার্ডিওভাসকুলার রোগ, ডিমেনশিয়া, ডায়াবেটিস, অটোইমিউন রোগ, শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা এবং পারকিনসন রোগ দেখা দিতে পারে। ভিটামিন ডি এর অভাবজনিত সমস্যার প্রতিকার নিয়ে গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা নানামুখী আলোচনা করেছেন এবং মতামত দিয়েছেন। টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ও কার্ডিওথোরাসিক সার্জন ড. মেহমেত ওজ বলেন যে এই ভিটামিন পাওয়ার জন্য রোদ সবচেয়ে ভালো উপায়। কিন্তু যদি তা যথেষ্ট না হয়, তাহলে তিনি কডলিভার তেল বা সম্পূরক খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেন। কথাটা যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক। এ কারণে জনপ্রিয় বিভিন্ন কোম্পানির ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্যের বিক্রয় বেড়ে যায়।
একাধিক গবেষণা এবং রিপোর্টে দেখা গিয়েছে যে ভিটামিন ডি এর অভাবে শিশুরা বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার এর অত্যাধিক ডোজের কারণেও অনেকে রোগাক্রান্ত হয়েছে। যেমনঃ কিডনি বিকল রোগ, ডিহাইড্রেশন, হাইপারক্যালসেমিয়া, যক্ষ্মা, হিস্টোপ্লাজমোসিস, হাইপারপ্যারাথায়রয়েডিজম, লিভার ডিজিজ ইত্যাদি। অন্যদিকে, শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি প্রবেশ করলে এর ফলে যেই সমস্যাগুলো হয়, সেগুলোর উল্লেখযোগ্য কয়েকটু উপসর্গ হলোঃ ক্লান্তি, ক্ষুধামান্দ্য, ওজন হ্রাস, অত্যধিক তৃষ্ণা ও মূত্রচাপ, বমি বমি ভাব ইত্যাদি।
ভিটামিন ডি দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, আমাদের জন্য এই ভিটামিন ডি কতটুকু জরুরি? আর সেই পরিমাণ মতো ভিটামিন ডি আমরা কীভাবে পাবো?
বয়স | পুরুষ | নারী | গর্ভবতী | স্তন্যদানকারী |
০-১২ মাস | ১০ mcg (৪০০ IU) | ১০ mcg (৪০০ IU) | ||
১-১৩ বছর | ১৫ mcg (৬০০ IU) | ১৫ mcg (৬০০ IU) | ||
১৪-১৮ বছর | ১৫ mcg (৬০০ IU) | ১৫ mcg (৬০০ IU) | ১৫ mcg (৬০০ IU) | ১৫ mcg (৬০০ IU) |
১৯-৫০ বছর | ১৫ mcg (৬০০ IU) | ১৫ mcg (৬০০ IU) | ১৫ mcg (৬০০ IU) | ১৫ mcg (৬০০ IU) |
৫১-৭০ বছর | ১৫ mcg (৬০০ IU) | ১৫ mcg (৬০০ IU) | ||
৭০ বছরের উপরে | ২০ mcg (৮০০ IU) | ২০ mcg (৮০০ IU) |
প্রথমে উপরের ছকটি লক্ষ্য করুন, যেটি National Institutes of Health এর একটি আর্টিকেল থেকে নেওয়া। এখানে কত বছর বয়সীদের জন্য কতটুকু ভিটামিন ডি প্রতিদিন গ্রহণ করতে হবে সে ব্যাপারে কিছু পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে। এতো উপাত্ত দেখে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। কিছু টার্ম আমি খুলে বলার চেষ্টা করব, আপনি তরতর করে সব বুঝে যাবেন।
এই ছকে ৫টি কলাম রয়েছে। ১ম কলামে বয়স আর ২য় ও ৩য় কলামে যথাক্রমে পুরুষ (ছেলে) ও নারীদের (মেয়ে) জন্য কতটুকু ভিটামিন ডি প্রয়োজন সেই হিসেব দেওয়া হয়েছে। আর ৪র্থ ও ৫ম কলাম-এই দুটো একটু বিশেষ এবং শুধুমাত্র নারীদের জন্য। ৪র্থ কলামটি বলছে যে গর্ভবতী নারীদের অতিরিক্ত কতটুকু ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে হবে। আর ৫ম কলামটি বলছে যে যেসব নারীদের নবজাত সন্তান রয়েছে, অর্থাৎ স্তন্যপান করাতে হয়, তাদের জন্য অতিরিক্ত কতটুকু ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে হবে।
এবার কিছু এককের পোস্টমর্টেম করা যাক। ছকে আপনি নিশ্চয়ই mcg দেখতে পাচ্ছেন? ভাবুন তো এটা কী হতে পারে? এটি হলো Microgram (মাইক্রোগ্রাম)। আর IU হলো ফার্মাকোলজি বা ঔষধসংক্রান্ত বিজ্ঞানের International Unit (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট)। 1 mcg=40 IU, মানে ১ মাইক্রোগ্রামে ৪০ আইইউ হয়।
এবার চলুন, ছকটি পর্যালোচনা করি। দেখুন, ছকটি একটি গড়পড়তা হিসেবের প্রতিনিধিত্ব করে। এটা কোনো চূড়ান্ত হিসাব নয়। রোগী, গর্ভবতী নারী অথবা স্তন্যদানকারী মায়ের ক্ষেত্রে এই হিসাবটা নির্ভর করে তার শারীরিক অবস্থার উপরে। তবে পরিমাণটা ছকে উল্লিখিত পরিমাণের আশেপাশেই থাকবে। কিন্তু মজার বিষয় খেয়াল করেছেন যে পুরুষ এবং নারী উভয়েরই (স্বাভাবিক ক্ষেত্রে) সমান পরিমাণ ভিটামিন ডি প্রয়োজন? তবে কিছু ক্ষেত্রে কিছু মানুষদের ভিটামিন ডি অধিক পরিমাণে প্রয়োজন পড়ে। যেমনঃ যারা রোদেলা পরিবেশ থেকে দূরে থাকে, যাদের গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারি হয়েছে, আফ্রিকান আমেরিকান এবং হিস্পানিক মানুষ (বিশেষত শীতের সময়), যাদের দেহে অনেক চর্বি জমে গিয়েছে, কিডনিতে সমস্যা আছে এমন মানুষ ইত্যাদি। যাইহোক, শিশু এবং জরুরি অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দক্ষ চিকিৎসকের পরামর্শই ভিটামিন ডি এর গ্রহণমাত্রা নির্ধারণ করে দিবে। সেই অনুসারে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান গ্রহণ করতে হবে।
এবার আসি, আমি-আপনি কীভাবে পর্যাপ্ত পরিমান ভিটামিন ডি পেতে পারি। এই ব্যাপারটি আমি দুই ভাগে বর্ণনা করবঃ মূল খাবার এবং সূর্যের আলো। চলুন, শুরু করা যাক।
কিছু খাবারে প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি থাকে। এক্ষেত্রে চর্বিযুক্ত মাছের মাংস (যেমনঃ ট্রাউট, স্যামন, টুনা এবং ম্যাকেরেল) এবং মাছের লিভারের তেল ভিটামিন ডি এর সবচেয়ে ভালো উৎস। গরুর লিভার, মাশরুম, ডিমের কুসুম এবং পনিরে অল্প পরিমাণে ভিটামিন ডি থাকে। এছাড়াও মুরগির মাংস, টার্কি, দুধ, দুধ থেকে তৈরি অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য, ডিম, সয়াদুধ, মার্জারিন ইত্যাদি খাবারেও পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকে।
খাদ্য | পরিমাণ (মাইক্রোগ্রাম) |
কডলিভার তেল (১ চা চামচ) | ৩৪ |
রান্না করা ট্রাউট (৩ আউন্স) | ১৬.২ |
রান্না করা স্যামন (৩ আউন্স ) | ১৪.২ |
দুধ (১ কাপ) | ২.৯ |
বড় ডিম (১টি) | ১.১ |
গরুর যকৃত (৩ আউন্স) | ১.০ |
টুনা মাছ (৩ আউন্স) | ১.০ |
চেডার পনির (১.৫ আউন্স) | ০.৪ |
রোস্টের ব্রেস্ট (৩ আউন্স) | ০.১ |
এবার আসি, সূয্যিমামার গল্পে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে তাদের ভিটামিন ডি এর অন্তত কিছু চাহিদা পূরণ করে। প্রায় ২৯০-৩২০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের টাইপ-B UV (UVB) বিকিরণ অনাবৃত ত্বকে প্রবেশ করে এবং ত্বকের ৭-ডিহাইড্রোকোলেস্টেরলকে প্রিভিটামিন D3 তে রূপান্তর করে, যা পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়ে ভিটামিন D3 তে রূপ নেয়। এক্ষেত্রে বয়স্ক এবং কালো ত্বকের লোকেরা সবচেয়ে বেশি সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি তৈরি করতে কম সক্ষম হয়। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমদের মতে মানুষের মন মেজাজ ভালো থাকা এবং ভালো ঘুমের জন্য সূর্যের আলো খুব প্রয়োজন। তাই দিনের শুরুতে কিছু সময় (১০-৩০ মিনিট) সূর্যের আলোতে নিজেকে মেলে ধরা উচিৎ।
স্বাভাবিকভাবে খাদ্য গ্রহণ ও সূর্যের আলোর মাধ্যমেও যদি ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ না হয় সেক্ষেত্রে আপনাকে সম্পূরক খাদ্য (Dietary supplements) গ্রহণ করতে হবে। মূলত শিশু, রোগী, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের ক্ষেত্রে এই সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োজন পড়ে।
ভিটামিন একটি জাদুকরী উপাদান। আর এক্ষেত্রে ভিটামিন ডি একটা অত্যাবশ্যকীয় উপাদান, যা আমাদের শরীরকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। ভিটামিন ডি এর অভাব যেন অস্টিওপোরেসিসের মতো রোগকে ডেকে এনে শরীরের বারোটা বাজাতে পারে, তেমনি অতিরিক্ত পরিমানে ভিটামিন ডি গ্রহণও আমাদের শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই সঠিকভাবে ভিটামিন ডি যুক্ত খাদ্য গ্রহণ প্রয়োজন, সাথে প্রয়োজন সূর্যের আলোর সংস্পর্শে থাকা। মনে রাখবেন, স্বাস্থ্যই সম্পদ!
তথ্যসূত্র ও বিস্তারিতঃ
১. How Much Vitamin D Do You Need to Stay Healthy?
২. Why Black People Need More Vitamin D This Winter
৩. What’s to know about hypervitaminosis D?
৪. Vitamin D – Health Professional Fact Sheet
৫. ভালো ঘুম, ফুরফুরে মেজাজ আর বিনা পয়সায় ভিটামিন ডি’র উৎস
Leave a Reply