যেভাবে কালাজ্বর শনাক্তের আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল 

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একটি উপেক্ষিত প্রাণঘাতী রোগ হল কালাজ্বর বা ভিসেরাল লেশম্যানিয়াসিস (Visceral Leishmaniasis)। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে এই রোগের প্রকোপ আছে। বাংলাদেশে বিশেষ করে ময়মনসিংহ বেল্টে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। দেশের ৪৫টি জেলা কালাজ্বরের এন্ডেমিক পর্যায়ে আছে (এন্ডেমিক বলতে নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমিত সংক্রমণ বোঝায়)। গবেষণা বলছে, আমাদের দেশের দুই কোটি মানুষ কালাজ্বরে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে আছেন। এটি গ্রীষ্মপ্রধান  অঞ্চলের রোগ। নানা কারনেই রোগটি অবহেলিত। তাই কালাজ্বর অবহেলিত ক্রান্তীয় রোগ (নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ বা NTD) নামেও পরিচিত। সুচিকিৎসা না হলে রোগীর মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। 

বাংলাদেশে কালাজ্বরের প্রোকোপ বিশেষ করে ময়মনসিংহ এলাকায় সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে। সূত্র ICDDR’B

কালাজ্বরে আক্রান্ত হবার কারণ- লেইশম্যানিয়া ডোনোভানি (Leishmania donovani) এবং লেইশম্যানিয়া ইনফ্যান্টাম (Leishmania infantum) নামের দুটো পরজীবীর সংক্রমণ। বাংলাদেশে অবশ্য প্রথমটির সংক্রমণ বেশি। লেইশম্যানিয়া পরজীবীবাহিত বেলে মাছির কামড়ে এই পরজীবী মানুষের দেহে প্রবেশ করে। গ্রামাঞ্চলে যেসব মাটির ঘর আছে সেগুলোর ফাঁকফোকরে এসব মাছির বসবাস বেশি। এই পরজীবী একবার দেহে প্রবেশ করলে ক্রমান্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন- যকৃত, প্লীহা, অস্থিমজ্জা-তে সংক্রমণ ঘটায়। ফলে হেপাটোমেগালি (যকৃত বড় হয়ে যাওয়া), স্প্লিনোমেগালি (প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া) হতে পারে। সমস্যাটা বেশি মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলে রক্তের কোষগুলো একে একে মারা যেতে থাকে, যা প্যানসাইটোপেনিয়া নামে পরিচিত। 

মাইক্রোস্কোপের নিচে লেইশম্যানিয়া ডোনোভানি পরজীবী। সূত্র থার্মো ফিশার

কোনো সংক্রামক রোগ নির্মূলের পূর্বশর্ত হচ্ছে কতটা দ্রুত রোগটির জীবাণু শনাক্তকরণ করা সম্ভব । সম্প্রতি রোগীর মূত্র পরীক্ষা করে কালাজ্বরের পরজীবী শনাক্তে বেশ সহজ, দ্রুততম এবং নির্ভরযোগ্য একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় বিশ্বখ্যাত প্লস (PLOS Journal) জার্নালে। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঞ্জুরুল করিম। গবেষণায় আরও যুক্ত ছিলেন সামিউর রহিম, মোঃ মহিউদ্দিন শরীফ, মোঃ রোবেদ আমিন ও মোহাম্মদ তারিকুর রহমান। 

সম্প্রতি গবেষণা দলটির প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঞ্জুরুল করিম বিজ্ঞান ব্লগকে তাঁর সাক্ষাৎকার দেন।     

তিনি বলেন, 

আগে কালাজ্বর নির্ণয়ে রক্তের ইমিউনোক্রোমাটোগ্রাফিক পরীক্ষা এবং অস্থিমজ্জা, যকৃৎ, প্লীহা ও লিম্ফ নোডের টিস্যু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হতো। প্রথম পদ্ধতিটির স্পেসিফিসিটি খুবই কম। স্পেসিফিসিটি দিয়ে বুঝানো হয় ভিন্ন ভিন্ন পরজীবীর সংক্রমণে আক্রান্ত একই ব্যক্তির দেহে পদ্ধতিটি কতটা কার্যকর। পরের পদ্ধতির ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে রোগ শনাক্তকরণ পর্যন্ত বেশ সময় লেগে যায়। তাছাড়া নমুনা যে অঙ্গগুলো থেকে নেওয়া হচ্ছে সবকটাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আর নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতিটিও বেশ জটিল। সুতরাং নমুনা সংগ্রাহক যদি খুব দক্ষ না হোন রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থেকে যায়। যে কারণে কিনা এ রোগীর চিকিৎসা করাটা না যতটা ক্লান্তিকর তার চাইতেও বেশি আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় রোগ শনাক্তকরণ। ফলে নমুনা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক রোগীই অনীহা প্রকাশ করতেন।      

স্যারের ল্যাবে মাইক্রোস্কোপি নমুনার ভিডিও Leishmaniasis parasite under microscope /\ Amazing microbes

গবেষণা দলটির প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঞ্জুরুল করিম।

এসব জটিলতার কারণে প্রথমে তাঁরা অস্থিমজ্জার পরিবর্তে রোগীর রক্ত থেকে নমুনা নিয়ে কাজ করেন। কেননা অস্থিমজ্জা আক্রান্ত হলে রক্তেও জীবাণু পাওয়ার কথা। তাঁরা বাফি কোট নামে রক্তের একটা বিশেষ অংশ সংগ্রহ করেন। বাফি কোটে থাকা রক্ত কোষসহ, লেইশম্যানিয়া জীবাণুর কোষ ভেঙ্গে ডিএনএ আলাদা করা হয়। তারপর কনভেনশনাল পিসিআর পদ্ধতিতে এসব ডিএনএ থেকে জীবাণুর উপস্থিতি শনাক্ত করা হতো। প্রাইমার নকশা এমনভাবে করা হয় যাতে এর থেকে পাওয়া অ্যামপ্লিকনগুলো (১০০-১৫০ বেসপেয়ার দৈর্ঘ্যের) পরবর্তীতে রিয়েল টাইম পিসিআর এ ব্যবহার উপযোগী হয়। উল্লেখ্য যে, রিয়েল টাইম পিসিআর এ একই সঙ্গে কোয়ানটিটিভ অ্যানালাইসিসও করা যায়, অর্থাৎ কেবল উপস্থিত-অনুপস্থিত সনাক্তকরণই নয়, নমুনায় নির্দিষ্ট ডিএনএ-র পরিমাণও বের করা যায়। এভাবে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ ক্রমধারা (সিকোয়েন্স) অ্যামপ্লিকন তৈরিতে সক্ষম হোন যা কেবল লেইশম্যানিয়া পরজীবীর কোষেই পাওয়া যাবে। এতে করে রোগী অন্য কোনো পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হলেও সেগুলো থেকে কোনো অ্যামপ্লিকন তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই। প্রাইমার তৈরির এই গবেষণায় আরও ছিলেন মাহবুবা খাতুন, এস এম সাব্বির আলম, আবেদ হুসেন খান, এম আনোয়ার হোসেন, জালালউদ্দিন আশরফুল হক, মোঃ শরিফুল আলম জিলানি, মোঃ তারিকুর রহমান। তাঁদের এই গবেষণা এশিয়া প্যাসিফিক জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন এ প্রকাশিত হয়। 

পরবর্তীতে তাঁরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে কালাজ্বরে আক্রান্ত বিভিন্ন রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেন। এ ব্যাপারে তাঁদের সহায়তা করেন প্রফেসর ডক্টর রোবেদ আমিন এবং  ডক্টর মহিউদ্দিন। তাঁরা তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাঁসপাতালের কালাজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের একটা ইউনিট পরিচালনা করতেন। একই প্রাইমার ব্যবহার করে এসব নমুনা থেকে কালাজ্বর শনাক্তকরণ করতেন তাঁরা। এর কিছু পরে, গবেষণা দলটি নমুনা হিসেবে রোগীর মূত্রও সংগ্রহ শুরু করলেন। এর পেছনে কারণ হিসেবে অধ্যাপক করিম জানান- 

কালাজ্বরের রোগের জীবাণু রোগীর কিডনিতেও সংক্রমণ ঘটায়। সুতরাং লেইশম্যানিয়া জীবাণু রোগীর মূত্রের মাধ্যমেও নিঃসরণ হবার কথা। একই সময়ে তাঁরা ব্রাজিলের একটা গবেষণা থেকে জানতে পারেন, সেখানে রোগীর মূত্র থেকেও কালাজ্বরের জীবাণু শনাক্ত করা গেছে। তাই আমাদের দেশেও রোগীর মূত্র থেকে কালাজ্বর শনাক্ত করা যায় কিনা সে ব্যাপার মাথায় রেখে তাঁরা রোগীর মূত্রও নমুনা হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করলেন।       

দেখা গেল কালাজ্বরে আক্রান্ত রোগীর মূত্রেও বেশ ভাল পরিমাণে লেইশম্যানিয়া পরজীবী উপস্থিত থাকে। পরবর্তীতে তাঁরা একই রোগীর অস্থিমজ্জা, রক্ত আর মূত্রের নমুনা থেকে কালাজ্বরের জীবাণু শনাক্ত করার চেষ্টা করলেন। তাঁরা একই সঙ্গে কনভেনশনাল পিসিআর এবং রিয়েল টাইম পিসিআর পদ্ধতি ব্যবহার করলেন। দেখা গেল, একই সঙ্গে অস্থিমজ্জা, রক্ত আর মূত্রের নমুনা থেকে কালাজ্বরের জীবাণু শনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে। সুতরাং কালাজ্বর শনাক্তকরণে অস্থিমজ্জা এবং রক্তের পরিবর্তে রোগীর মূত্র নমুনা হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। 

   লেইশম্যানিয়া পরজীবীর জীবনচক্র। সুত্র- নেচার রিভিউ মাইক্রোবায়োলজি

এখানে বলে রাখা ভালো, গবেষণায় বাংলাদেশের কালাজ্বরের এন্ডেমিক অঞ্চল ময়মনসিংহ বেল্ট এবং নন-এন্ডেমিক অঞ্চল যেমন ঢাকা, চিটাগং থেকে কালাজ্বরে আক্রান্ত নয় এমন মানুষদের কাছ থেকে নমুনা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যারা কালাজ্বর বাদে অন্যান্য রোগ যেমন ডেঙ্গু, যক্ষ্মা, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া আক্রান্ত তাদের কাছ থেকেও নমুনা নেওয়া হয়েছে। এতো বিভিন্ন ধরনের রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে এটা নিশ্চিত করার জন্যে যাতে তাঁদের উদ্ভাবিত নতুন এই পিসিআর পদ্ধতি অন্যান্য রোগের পরজীবীর প্রতিও সংবেদনশীলতা দেখায় কি না। দেখা যায়,  নতুন এই পদ্ধতি অন্যান্য রোগের পরজীবীর প্রতি কোনোরকম সংবেদনশীলতা দেখায় না। ফলে বলা যায়, কালাজ্বর শনাক্তকরণের নতুন এই পদ্ধতি শতভাগ স্পেসিফিক। 

রোগ নির্ণয় পদ্ধতির সফলতা বিচার করতে আরেকটা বিষয়ও দেখতে হয়। সেটি হল সেন্সেটিভিটি। অর্থাৎ পদ্ধতিটি রোগ নির্ণয়ে কতটা কার্যকর সেটাই দেখা। অন্যভাবে বলা যায়, সেন্সিটিভিটি বলতে একটা পরীক্ষাপদ্ধতি কতোটা সংবেদনশীল, বা কতো কম নমুনায় কাঙ্ক্ষিত সংকেত দেয়, সেটার পরিমাপ। দেখা যায়, অস্থি মজ্জা পরীক্ষা করে যেসব রোগীর রোগ নিশ্চিত করা গেছে, মূত্র পরীক্ষা করেও একই রোগীর কালাজ্বর নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, সেন্সেটিভিটির দিক দিয়েও পদ্ধতিটি শতভাগ নিশ্চিত। তবে এক্ষেত্রে সংবেদনশীলতার মাত্রার দিক দিয়ে অস্থিমজ্জাই সবথেকে বেশি এগিয়ে। তারপর রক্ত এবং সবশেষে মূত্র।

রোগীর দেহ তরলের দশ মাইক্রোলিটার দ্রবণে যদি একটিও লেইশম্যানিয়া জীবাণু উপস্থিত থাকে তাহলেও নতুন উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিতে কালাজ্বর শনাক্তকরণ সম্ভব হবে। এভাবে নমুনা সংগ্রহ করা থেকে রোগ শনাক্তকরণ করা পর্যন্ত সময় লাগে মাত্র তিন ঘণ্টা। এছাড়া যেখানে গতানুগতিক পদ্ধতিতে কালাজ্বর শনাক্ত করতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাঁসপাতালেই দুই হাজার টাকা লেগে যেত, সেখানে নতুন উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিতে খরচ লাগবে মাত্র ছয়-সাত’শ টাকা। সুতরাং বলা যায়, কালাজ্বর শনাক্তে নতুন এই উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবেই রোগীবান্ধব একটা পদ্ধতি। 

গবেষণা দলের প্রধান বলেন, 

এখন তাঁরা তাদের উদ্ভাবিত এই নতুন পদ্ধতির আন্তর্জাতিক প্রসারের লক্ষ্যে আফ্রিকা থেকে নমুনা সংগ্রহের কথা ভাবছেন। ইতোমধ্যেই আফ্রিকার কেনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁদের যোগাযোগ হয়েছে। তাঁরা এ ব্যাপারে যুক্ত হওয়ার আশা ব্যক্ত করেছেন। 

পাশাপাশি আমাদের দেশেও জনস্বাস্থ্য পর্যায়ে নীতিনির্ধারক যারা আছেন কালাজ্বর শনাক্তকরণের দারুণ এই পদ্ধতি তাঁদের নজর কারুক এই আশা ব্যক্ত করেছেন তিনি। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার কালাজ্বর নির্মূলের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। তবে একদম মাঠ পর্যায়ে আসলেই কালাজ্বর নির্মূল হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আরেকটু সাবধান হওয়ার কথা বলেছেন তিনি। শুধু কালাজ্বরই নয় এরকম আর যত এনটিডি রোগ আছে যেমন গোদরোগ, সয়েল ট্রান্সমিটেড হেলমিনথায়াসিস ইত্যাদি নির্মূলের বিষয়টিও যেন এসডিজির আওতায় আনা হয়। এই রোগগুলো নির্মূল হলে আমাদের জনস্বাস্থ্য খাতে যেমন একটা বিরাট অর্জন হত তেমনি আমাদের পর্যটক খাতও লাভবান হত বলে মনে করেন গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক ড.  মোহাম্মদ মঞ্জুরুল করিম।  

তথ্যসুত্র- বিজ্ঞান ব্লগকে দেওয়া গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক ড.  মোহাম্মদ মঞ্জুরুল করিম এর সাক্ষাৎকার।

আগ্রহীরা পড়তে পারেন এ বিষয়ে প্রকাশিত গবেষণাপত্র-

লেখাটি 166-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers