শরৎকালে আপনার স্বাস্থ্য সুরক্ষা

এই শরতে আউটডোরে যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্যণীয়, তা থেকে সতর্ক থাকুন।
lost teddy toy in protective mask lying on pavement alone
Photo by Gustavo Fring on Pexels.com

কখনো বৃষ্টি, মেঘের লুকোচুরি। কখনো বা প্রচন্ড রোদের তীব্রতায় ছারখার হয় এই ধরণী। আবার হঠাৎ গা গুলানো গুমোট গরম। কখনো দেখা যাবে ফুরফুরে বাতাস বইছে আপনার শরীরে একরাশ প্রশান্তি ছড়িয়ে। আকাশের রঙেও নীল বেড়েছে। রয়েছে  তুলার মতো মেঘের ভেলা। এসব থেকে সহজেই আপনি আঁচ করতে পারবেন প্রকৃতিতে এখন শরৎ এসে গেছে।

এ যেন প্রকৃতিতে শরৎ এর রঙতুলির আঁচড়...

 এই ঋতু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি আপনার জন্য কিছু রোগব্যাধিও বয়ে আনে। আমাদের সামান্য সতর্কতা, কিছু অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগগুলোর বিস্তার কিছুটা হলেও রুখে দেয়া সম্ভব। 

কোভিড-১৯

কোভিড ১৯ গত কয়েকটা বছর পৃথিবীতে রীতিমতো তান্ডব চালিয়েছে। এই ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির আঘাতে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আশঙ্কার কথা হল এবার আমাদের দেশে এই শরৎকালে নতুন করে কোভিডের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই শরৎকালে আবার নতুন করে কোভিডের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কোভিড-১৯ হলো একটি বিশেষ ধরণের ভাইরাস যেটি সার্স ভাইরাস এবং কয়েক ধরনের সাধারণ সর্দি-জ্বর জাতীয় ভাইরাসের পরিবারভুক্ত। এর লক্ষণগুলোর ভেতর অন্যতম হল জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। অনেক সময় এই সংক্রমণের ফলে নিউমোনিয়া বা শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা হতে পারে। কাশি বা হাঁচি দেবার সময় মুখ এবং নাক কনুই দিয়ে বা টিস্যু দিয়ে ঢেকে রাখুন। ব্যবহৃত টিস্যুটি তাৎক্ষণিকভাবে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিন। ঠান্ডা লাগা বা জ্বরের লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন। আপনার কিংবা আপনার সন্তানের জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত বাড়িতে এবং পরিস্থিতি অবনতি হলে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করুন।

ডেঙ্গু জ্বর

বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মারাত্বক আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। এডিস ইজিপ্টি নামক এক ধরনের মশা এই ভাইরাস নিজেদের শরীরে বহন করে। রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। রোগীকে প্রচুর পানি, শরবত, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। 

এডিস ইজিপ্টি মশার কারণে ডেঙ্গু ছড়ায়।

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল এডিস মশার বিস্তার রোধ করা। এই প্রজাতির মশা সাধারণত স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানিতে এরা ডিম পাড়তে পারে না। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

হ্যান্ড ফুট এন্ড মাউথ ডিজিজ

কোভিড পরবর্তী সময়ে হ্যান্ড ফুট এন্ড মাউথ ডিজিজ নামের এক ধরনের রোগে কম বয়সের বাচ্চারা অতিমাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছে। মূলত অতি সংক্রামক এই রোগটি কক্সাকি – ১৬ ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। এই রোগের একটি প্রধান সমস্যাই হল পানিশূন্যতা। তাই লক্ষ্য রাখতে হবে আক্রান্ত বাচ্চাটি কোনোভাবেই যেন পানিশূন্যতায় না পড়ে। পানিশূন্যতা দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে শিরাপথে স্যালাইন দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। প্রয়োজনে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে আবার এই অসুস্থ বাচ্চাটির মাধ্যমে হাসপাতালে রোগটি নতুন করে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

অ্যাজমা

শরত কালের অসুখের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অ্যাজমা বা হাঁপানি। এই বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যাক্তির কাশি, সর্দি আর হাঁপ ধরা শরীরে জেঁকে বসে। এর ফলে সারা রাত ঘুম না হওয়া, বুকে সর্দি জমা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। শরতের শীতল ও শুষ্ক বাতাস এ রোগটিকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। ফুসফুসের এই রোগে শ্বাসকষ্ট, বুক আঁটসাঁট ভাব লাগা , রাতে বা খুব সকালে প্রচন্ড কাশি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।

অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগের বিভিন্ন লক্ষ্মণসমূহ।

হাঁপানি এমন একটি রোগ যা সহজে পুরোপুরি নির্মুল করা যায় না। কিন্তু চেষ্টা করলে কিছুটা হলেও নিজের  নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। গবাদি পশুর লোমে আপনার অ্যালার্জি থেকে থাকলে, তা থেকে দূরে থাকুন।

যেসব খাবারে আপনার  অ্যালার্জির সমস্যা হয় সেগুলো প্রতিদিনের খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিন।

ব্যাগে জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য স্টেরয়েড ইনহেলার রাখতে হবে। যে কোনো ধরনের ধোঁয়া থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন।

ডায়রিয়া

এবারের শরৎকালে আরেকটি রোগের প্রাদুর্ভাব বিশেষ ভাবে আমার নজরে এল। সেটি হল ডায়রিয়া। এই ক’দিন আউটডোর বা ইমার্জেন্সী, হাসপাতালের যে অংশেই ডিউটি করেছি, সেখানেই অসংখ্য রোগী ডায়রিয়ার সমস্যা নিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ আবার শিশু। সাধারণত রোটা ভাইরাস, নরওয়াল্ক ভাইরাস প্রভৃতি দিয়ে ডায়রিয়া হতে পারে। তাছাড়া ভিব্রিয়ো কলেরি, ক্যামপাইলোব্যাকটোর জেজুনি, সালমোনেলা, সিগেলাসহ নানা ধরণের ব্যাকটেরিয়ার কারণে ডায়রিয়া হতে পারে।

পানির মত বার বার পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলা হয়। সাধারণত ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৩ বার বা তার বেশি বার পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলে। এক্ষত্রে তিনবারের কম হলে ভয়ের কিছু নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এই ডায়রিয়া। ডায়রিয়া সাধারণত নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়:

হঠাৎ করে পায়খানা লাগা। পায়খানা লাগলে দ্রুত টয়লেটে যাওয়া বা অপেক্ষা করতে না পারা। তলপেটে কাঁমড় বা তীব্র ব্যাথা অনুভব করা। শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া। জ্বর হওয়া এবং ঠাণ্ডা লাগা। হালকা মাথা ব্যাথা/ মাথা ঘোরা।

কিছু অ্যান্টিবায়োটিক আছে যেগুলো দেহের খারাপ ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলার পাশাপাশি ভালো ব্যাকটেরিয়াও মেরে ফেলে। ফলে অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটে, যা পুরো শারীরিক অবস্থাকে ডায়রিয়ার দিকে ধাবিত করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন অ্যান্টি-ক্যানসার ওষুধ এবং ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত অ্যান্টাসিডও কিন্তু ডায়রিয়া সৃষ্টির করতে পারে। ডায়রিয়া এড়াতে খাবার ও পানি জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। পানি ফুটানোর ব্যবস্থা না থাকলে প্রতি ৩ লিটার পানিতে একটি পানি-বিশুদ্ধকরণ ক্লোরিন ট্যাবলেট দিয়ে পানি নিরাপদ করা যেতে পারে। রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর ও উন্মুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। খাওয়ার আগে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। পায়খানা করার পর অথবা শিশুর পায়খানা পরিষ্কার করার পর সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে। রোগীর হাইড্রেশন নিশ্চিত করতে হবে। কোন ভাবেই যাতে ডাইরিয়ায় পানিশূন্যতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ডাবের পানি, স্যালাইন রোগীর পানি ও লবণের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। তাছাড়া বাচ্চারা খুব দ্রুত পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হয়ে খারাপ অবস্থায় চলে যায় বলে তাদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

সূত্র:

Daily Tips for a Healthy Autumn Season | Mercy Health Blog

15 Autumn Wellness Tips to Keep You Healthy This Fall – Active Minds

Coronavirus disease (COVID-19)

Hand Foot Mouth Disease | NHS

What is Astma | WebMD

Dengue Fever: Mayo Clinic

ইংরেজিতে কন্টেন্ট রাইটার হয়ে গড়ে তুলতে পারেন নিজের ফ্রিল্যান্স-ক্যারিয়ার।

কীভাবে? দেখুন ফ্রি-মাস্টারক্লাস ভিডিও

এমরান আহমেদ
এমরান আহমেদ,পেশায় একজন চিকিৎসক। জন্ম ১৩ অক্টোবর,১৯৮৮ কুষ্টিয়ায়, নানা বাড়িতে।খুলনা বিদুৎকেন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, খুলনা নৌবাহিনী কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চমাধ্যমিক শেষে ভর্তি হন খুলনা মেডিকেল কলেজে। পরে একটি স্বনামধন্য মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে বিসিএস-এ গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সহকারী সার্জন পদে কুষ্টিয়ায় কাজ করেছেন। মহাকাশবিদ্যা, আর্কিয়োলজি নিয়ে তার প্রচন্ড আগ্রহ। মেডিকেল ছাত্রাবস্থায় তার লেখালেখির শুরু। বর্তমানে বিজ্ঞানচিন্তা, রহস্যপত্রিকা সহ বেশ কিছু স্বনামধন্য পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। মহাজাগতিক প্রাণের খোঁজে নামে তার একটি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া আইসফল নামে একটি থ্রিলার অনুবাদ করেছেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন, এনাটমি ডিসেকশন রুম। প্রখ্যাত বিজ্ঞানলেখক ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর সাথে যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন, এলিয়েন : কল্পনা ও বাস্তব। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন, এক্সোপ্লানেটের সাতকাহন।