প্রায় প্রতিটি মানবকোষই মাইটোকন্ড্রিয়া দ্বারা চালিত হয়। শিম-আকৃতির এই অঙ্গাণু অক্সিজেন ব্যবহার করে দেহের ব্যবহার উপযোগী শক্তি সংশ্লেষণ করে। কোটি কোটি বছর আগে একটা প্রাচীন আর্কিওব্যাক্টেরিয়া একটা ব্যাকটেরিয়াকে গিলে ফেলে। এই ব্যাকটেরিয়াই পরবর্তীতে মাইটোকন্ড্রিয়া হিসেবে বিবর্তিত হয়। আর এভাবেই উদ্ভব ঘটে সুকেন্দ্রিক কোষের। তখন থেকেই মাইটোকন্ড্রিয়া তার পূর্বসূরী অণুজীবের মতো ডিএনএ বহন করে আসছে। প্রাণীকোষের নিউক্লিয়াসে অর্ধেক সংখ্যক ক্রোমোজম মাতা ও বাকি অর্ধেক পিতা থেকে আসে। কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ বংশগতির একটা ভিন্ন নিয়ম মেনে চলে। ডিম্বাণুর সাথে নিষেকের সময় শুক্রাণুর মাইটোকন্ড্রিয়া নিষিক্ত ডিম্বাণুতে প্রবেশ করে না। এ কারণে প্রায় সকল মানুষই তাদের মায়ের ডিম্বাণু থেকে তাদের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (mtDNA) উত্তরাধিকার সূত্রে পায়।
কিন্তু শুক্রাণুর মাইটোকন্ড্রিয়া ডিএনএর কী হয় তাহলে? এই প্রশ্নটার উত্তর জানার মাধ্যমে বিভিন্ন জেনেটিক রোগের পেছনে মাইটোকন্ড্রিয়া সঠিকভাবে কাজ না করার ব্যাপারটি বোঝা সম্ভব। অন্যান্য প্রাণীর ডিম্বাণুর নিষিক্তকরণের পরে বিভিন্ন আণবিক প্রক্রিয়ার ফলে শুক্রাণুর মাইটোকণ্ড্রিয়ন ভেঙে যায়। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এটা কখন হয়, সেটা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
তবে সম্প্রতি ক’জন জীববিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন, মানুষের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা গোড়ার দিকেই ঘটে যায়। আসলে মানুষের শুক্রাণুর কয়েকটি মাইটোকন্ড্রিয়ায় কার্যত কোনও ডিএনএ থাকে না। নেচার জেনেটিক্সের সাম্প্রতিক সংখ্যায় এই বিষয়গুলি প্রকাশিত হয়েছে।
ফিলাডেলফিয়ার টমাস জেফারসন ইউনিভার্সিটির আণবিক জীববিজ্ঞানী দিমিত্রি টেমিয়াকভ বলেন,
“প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শুক্রাণুতে এমটি ডিএনএ (mtDNA) এর অনুপস্থিতিতে আমরা খুবই অবাক হয়েছিলাম।”
কারণ পূর্ববর্তী গবেষণায় পরস্পরবিরোধী ফলাফল পাওয়া গেছে। তার মতে এই mtDNA এর বাদ যাওয়ার প্রক্রিয়া মানুষের বন্ধ্যাত্বে ভূমিকা পালন করতে পারে এবং মাইটোকন্ড্রিয়ার রোগ বুঝতে সাহায্য করতে পারে।
এ গবেষণায় আণবিক জীববিজ্ঞান এবং মাইক্রোস্কোপি কৌশল ব্যবহার করে গবেষকরা মানুষের বিকাশরত শুক্রাণু কোষ পরীক্ষা করেছেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ বলছে, শুক্রাণুর পূর্বসূরি কোষের মাইটোকন্ড্রিয়াতে ডিএনএ রয়েছে। আর এর সাথে মাইটোকন্ড্রিয়াল ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর-এ (টিএফএএম-TFAM) নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন রয়েছে, যা সেই ডিএনএকে প্রতিপালন ও রক্ষা করে। কিন্তু যখন শুক্রাণু কোষ পরিপক্ক হয়, তখন সামান্য রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে টিএফএএম (TFAM) এগুলোর মাইটোকন্ড্রিয়ায় প্রবেশ করতে পারে না।
এখানেই মূল ব্যাপারটা লুকিয়ে আছে। দেখুন, যেই প্রোটিন মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএকে রক্ষা করতো, সেই উপাদানটাই মাইটোকন্ড্রিয়ায় যথেষ্ট পরিমাণে অবস্থান করতে পারে না। এগুলো তখন নিউক্লিয়াসে ঢুকে যায়। ফলে ধীরে ধীরে মাইটোকন্ড্রিয়ন টিএফএএম (TFAM) শূন্য হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে ঐ কোষীয় অঙ্গাণুর ডিএনএকে রক্ষা করার মতো আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তখন ডিএনএ নষ্ট বা বিলুপ্ত হতে থাকে। এমটি ডিএনএ (mtDNA) যদি শুক্রাণুর মাইটোকন্ড্রিয়ায় আটকে থাকে, তাহলে এটি বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে। পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে শুক্রাণুর কিছু কোষে উচ্চ পরিমাণে এমটি ডিএনএ (mtDNA) থাকায় লোকেদের শুক্রাণুর সংখ্যা এবং গতিশীলতা হ্রাস পেয়েছে।
ডিএনএ থাকাটা কীভাবে বন্ধ্যাত্বের কারণ হলো? স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের মাইটোকন্ড্রিয়াল সেল বায়োলজিস্ট জিনান ওয়াং বলেছেন, ইঁদুরের উপর করা গবেষণায় দেখা গিয়েছে এগুলোর শুক্রাণুর মাইটোকন্ড্রিয়াতে টিএফএএম (TFAM) অনুপস্থিত। এর ফলে এমটি ডিএনএ (mtDNA)ও একসময় হারিয়ে যেতে পারে। যাহোক, টেমিয়াকভ বলেছেন এমন অনেক অজানা পদ্ধতি রয়েছে, যেগুলো কীভাবে এই ডিএনএ অন্য কোষে কী কী ভূমিকা পালন করে সেগুলো বলতে পারে। আর এই কাজগুলো ব্যহত হলে মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ হওয়ার ব্যাপারটাও সেই প্রক্রিয়া-ঘটনা থেকে জানা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, “মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ এবং সেগুলোর চিকিত্সাপদ্ধতি সম্পর্কে আরও ভালভাবে বোঝার জন্য আমাদেরকে এই পদ্ধতিগুলো উন্মোচন করতে হবে।”
তথ্যসুত্রঃ Sperm Cell Powerhouses Contain Almost No DNA
Leave a Reply