“ওহ মাই গড! বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখুন একবার। পৃথিবী ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ওয়াও! অনিন্দ্য সুন্দর, তাই না?”
কথাগুলো ছিল নাসার বিখ্যাত অ্যাপোলো ৮ মহাকাশযানের নভোচারী উইলিয়াম ‘বিল’ অ্যান্ডার্সের। যখন কিনা তিনি চাঁদের কক্ষপথে ইতিহাসের প্রথম সফল ভ্রমণ শেষে বাকি দুই সঙ্গীসহ ফিরে আসছিলেন পৃথিবী পানে। সেই ঐতিহাসিক মিশনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উইলিয়াম পরবর্তীতে মহাকাশ ইতিহাসবিদ অ্যান্ড্রু চাইকিনকে বলেছিলেন,
বহুপথ পাড়ি দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম চাঁদের অজানাকে জানতে। কিন্তু ঘটেছিল ঠিক উল্টোটা। আমরা যেন নতুন করে আবিষ্কার করেছিলাম পুরনো চিরচেনা পৃথিবীকে।
আর্থ রাইজের সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্তটিকে ক্যামেরার ফ্রেম বন্দি করে রেখেছিলেন উইলিয়াম। ইতিহাসের অংশ হয়ে যায় ছবিটি।
যদি উইলিয়াম প্রায় চার বিলিয়ন বছর আগের সময়ে ফিরে যেতে পারতেন, তাহলে কেমন পৃথিবী দেখতে পেতেন তিনি? উপরের ছবির মত নীলাভ সাদা পৃথিবী কি তার দৃষ্টিগোচর হতো? উত্তর হলো, না। বরং তিনি দেখতে পেতেন এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডকে, যাকে দোযখ হিসেবে আখ্যা দিলেও বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলা হবে না। সেই পৃথিবীর সর্বত্র ছিল গলিত পাথর এবং উত্তপ্ত লাভার রাজত্ব। বিশালাকার সক্রিয় সব আগ্নেয়গিরিতে ঘটা বিস্ফোরণে প্রায়শই প্রকম্পিত হতো চারদিক। আর মহাশূন্য থেকে ছুটে আসা প্ল্যানেটেসিমালদের (বড় আকারের পাথর খন্ড) সাথে সংঘর্ষ ছিল পৃথিবীর নিত্য দিনের ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসের এই চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল সময়ের নাম দেয়া হয়েছে “হেইডিয়ান পিরিয়ড” । গ্রিক মিথলজির পাতল পুরের দেবতার নামের সাথে মিল রেখে এমন নামকরণ।
প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের (মূল নক্ষত্রের প্রটোস্টার দশায় ঘিরে থাকা বিশাল গ্যাস ডিস্ক, যেখান থেকে জন্ম নেয় গ্রহরা) গ্যাস টেনে নিয়ে গড়ে উঠা পৃথিবীর প্রাথমিক বায়ুমণ্ডলটি খুব বেশি সময় টিকে থাকতে পারে নি। হেইডিয়ান পিরিয়ডের মাঝেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মত হালকা গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত হওয়া এই বায়ুমণ্ডলকে পৃথিবীর গ্র্যাভিটি আটকে রাখতে পারে না, মিলিয়ে যায় মহাশূন্যে। আমাদের সৌরজগতের বাকি টেরেস্টিয়াল গ্রহদের প্রাথমিক বায়ুমণ্ডলও একই ভাগ্য বরণ করে। সূর্যের জীবন চক্রের টি-টাউরি দশায় নিঃসারিত হওয়া বিকিরণ ও সৌর বাতাস উভয়েই এদের অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আদিম বায়ুমণ্ডলের বিদায়ের পর পৃথিবীতে শুরু হয় দ্বিতীয় বায়ুমণ্ডল তৈরির কর্মযজ্ঞ। এর জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের যোগান দেয় তখনকার পৃথিবীতে থাকা পাথরগুলো। কি অবাক হলেন? ভাবছেন পাথর আবার কীভাবে গ্যাসের যোগান দিতে পারে? আসলে প্রচণ্ড উত্তাপে এই পাথরগুলো গলে যায়। ভারী ধাতুর তৈরি পাথরগুলো ক্রমশ পৃথিবীর কোরের দিকে সরে যায়। আর হালকা সিলিকেটের তৈরি গলিত পাথর দখল করে পৃথিবীর উপরিভাগ। গলন প্রক্রিয়ার সময়েই পাথরদের মধ্যে থাকা গ্যাস অবমুক্ত হয়। যেগুলো কিনা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলা প্রাথমিক ধূলিকণা থেকে কঠিন বস্তু তৈরির প্রক্রিয়ার সময়ে পাথরদের মাঝে আটকা পড়ে গিয়েছিল। মুক্তি পাওয়া এই গ্যাসদের হাত ধরেই শুরু হয় পৃথিবীর দ্বিতীয় বায়ুমণ্ডল তৈরির কাজ। এতে অস্তিত্ব থাকে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন, জলীয় বাষ্প ইত্যাদি হরেক রকম গ্যাসের মিশ্রণ। তবে অস্তিত্ব থাকে না কোন মুক্ত অক্সিজেনের। এদের আবির্ভাব হয় আরো অনেক পড়ে। এই বায়ুমণ্ডলের সদস্যরা হাইড্রোজেন বা হিলিয়ামের চেয়ে ভারী হওয়ায় পৃথিবীর গ্র্যাভিটি খুব সহজেই ধরে রাখতে পারে।
উইলিয়াম অ্যান্ডার্সের আর্থ রাইজের ছবিটি নীল এক পৃথিবীর সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয় আমাদের। যার পৃষ্ঠের প্রায় পুরোটা জুড়েই রয়েছে পানির অস্তিত্ব। শতকরা হিসাবে প্রায় ৭১ ভাগ। পৃথিবীর মোট ভরের তুলনায় পানির পরিমাণ অবশ্য খুব নগন্য। মাত্র ০.০৫ শতাংশ। অথচ এতটুকু পানিই বদলে দিয়েছে সব হিসাব নিকাশ। প্রাণের বিস্তার ঘটিয়ে মহাবিশ্বের বুকে পৃথিবীকে করেছে অনন্য। পৃথিবীতে কীভাবে পানির আবির্ভাব হয়েছিলো তা বিজ্ঞানীদের কাছে আজও এক অমীমাংসিত রহস্য। এমনকি হেইডিয়ান পিরিয়ডে তৈরি হওয়া দ্বিতীয় বায়ুমণ্ডলে থাকা জলীয় বাস্পের উৎস নিয়েও পুরোপুরি নিশ্চিত নন বিজ্ঞানীরা।
আসলে পৃথিবীর অবস্থান সূর্য থেকে এমন এক দূরত্বে যেখানকার প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কে কোনভাবেই পানি বা বরফের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। যে প্রাথমিক ধূলিকণা থেকে কোটি কোটি বছর ধরে চলা জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবী আত্মপ্রকাশ করে, তাতে বরফের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায়। মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে অবস্থান করা অ্যাস্ট্রয়েড বেল্টের দিকে তাকালেই এর সত্যতার দেখা মিলে। সূর্য থেকে ২.৪-৪ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরত্বে থাকা বেল্টের গ্রহাণুতে যথেষ্ট পরিমাণ বরফের অস্তিত্ব দেখা যায়, যা কিনা এদের মোট ভরের প্রায় দশ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অন্যদিকে, মঙ্গল গ্রহের কাছাকাছি অবস্থান করা গ্রহাণুতে (প্রায় ১.৫ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরে) বরফের পরিমাণ মাত্র ০.০৫ থেকে ০.১ শতাংশ। এই ট্রেন্ড অনুসরণ করলে পৃথিবীর জন্মস্থানে বরফের পরিমাণ নেমে আসবে প্রায় শূন্যতে। অর্থাৎ, আমাদের বাসস্থান গ্রহটি গঠিত হয়েছিল শুষ্ক বস্তুদের সমন্বয়ে। এমনটা হয়ে থাকলে পৃথিবীতে এতো পানি এলো কীভাবে?
পানির রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত দুইটি সম্ভাবনাময় তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন। এর প্রথমটির নাম “ভেজা পৃথিবী তত্ত্ব” । এই তত্ত্ব অনুসারে, পৃথিবীতে পানির আবির্ভাব হয়েছিল এর সৃষ্টির সময়েই। তবে সেটি বরফ বা তরল অবস্থায় নয়, বরং গ্যাস আকারে। সূর্যের প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের ভেতরের অংশে (পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থানে) কঠিন বরফ তৈরি হতে না পারলেও এর পুরোটা জুড়েই অস্তিত্ব ছিল প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্পের। পৃথিবী সৃষ্টিতে অংশ নেয়া প্ল্যানেটেসিমালগুলো প্রতিনিয়ত এই বাষ্পগুলোতে এক রকম গোসল করতো। ফলে এদের গায়ে পাকাপাকিভাবে জলীয় বাষ্প লেগে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়। হেইডিয়ান পিরিয়ডে পাথরগুলো গলে যাওয়ার মাধ্যমে দ্বিতীয় বায়ুমণ্ডলে অবমুক্ত হতে পারে সেই বাষ্পরা। অতঃপর কালের বিবর্তনে ঘনীভূত হয়ে এরা রূপান্তরিত হতে পারে তরল পানিতে।
ভেজা পৃথিবী তত্ত্ব অনুসারে, অন্য আরেকভাবেও পানি আবির্ভাবের সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই ভার্সনে প্ল্যানেটেসিমালদের গায়ে জলীয় বাষ্প লেগে যাওয়ার কোন দরকার পড়ে না। ডিস্ক থেকে সরাসরি টেনে আনা গ্যাসদের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া প্রাথমিক বায়ুমণ্ডলেই থাকতে পারে জলীয় বাষ্পের অস্তিত্ব। হাইড্রোজেন বা হিলিয়ামের মত হালকা মৌলদের ধরে রাখতে না পারলেও এই বাষ্পীয় অণুদের ঠিকই ধরে রাখতে পারে পৃথিবীর গ্র্যাভিটি। পরবর্তীতে এরা অংশ হয়ে যায় দ্বিতীয় বায়ুমণ্ডলের। বাকি গল্পটা আগের মতই।
ভেজা পৃথিবী তত্ত্বটি বেশ সম্ভাবনাময়। তবে গ্রহ গঠনের অন্য সব তত্ত্বের মতই এরও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। প্রথম ঝামেলা বাঁধে নিষ্ক্রিয় গ্যাসদের নিয়ে। জলীয় বাষ্পের পাশাপাশি প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কে অস্তিত্ব থাকে প্রচুর পরিমাণ হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন ইত্যাদির মত নিষ্ক্রিয় গ্যাসের। প্রায় কোন ধরণের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ না নেয়ায় কালের বিবর্তনে এদের মোট পরিমাণে খুব একটা তারতম্য হয় না। যদি সত্যি জলীয় বাষ্পরা ডিস্কের গ্যাস থেকে সরাসরি আসতো, তাহলে এদের সাথে সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নিষ্ক্রিয় গ্যাসদেরও চলে আসার কথা। ফলে আমাদের বায়ুমণ্ডলে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের অনুপাত হতো অনেকটা সূর্যের অনুরূপ। কিন্তু এমনটা হতে দেখা যায় না। আবার, বর্তমান পৃথিবীতে অস্তিত্ব থাকা মোট পানির জন্য প্রয়োজনীয় জলীয় বাষ্প টেনে আনতে হলে আদিম প্রাথমিক বায়ুমণ্ডলের আকার হতে হবে বেশ বড় সড়। তবে সেটি আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। কারণ তেমন বায়ুমন্ডল গঠন করতে যে সময় প্রয়োজন পড়বে, তা প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের জীবনকালের চেয়েও অনেক বেশি।
এই রকম আরো কিছু সমস্যা ভেজা পৃথিবী তত্ত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। ফলে পৃথিবী সৃষ্টির সময়েই পানির অস্তিত্বের ধারণাটি নড়বড়ে হতে শুরু করে। সামনে আসে নতুন আরেকটি সম্ভাব্য সমাধান। যার নাম “শুষ্ক পৃথিবী তত্ত্ব”।
বি. দ্র.- লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব আসবে।
তথ্যসূত্রঃ
দ্য প্ল্যানেট ফ্যাক্টরি: এক্সোপ্ল্যানেটস অ্যান্ড দ্য সার্চ ফর আ সেকেন্ড আর্থ, এলিজাবেথ জে টাস্কার
Leave a Reply