নোবেল পুরস্কারের শূন্যতা পূরণে গণিতের রাজ্যে বিশেষ অবদানকে স্বীকৃতিদানে যে পুরস্কারগুলোকে সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তন্মধ্যে ফিল্ডস মেডেল ও অ্যাবেল পুরস্কার অন্যতম। এ বছর সম্মানজনক অ্যাবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ৭২ বছর বয়সী ফরাসি গণিতবিদ মাইকেল পিয়েরে তালাগ্র্যান্ড। গত ২০ মার্চ ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে নরওয়েজিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড লেটারস ‘গাণিতিক পদার্থবিদ্যা ও পরিসংখ্যানে অসামান্য প্রয়োগ সহ সম্ভাব্যতা তত্ত্ব এবং ফাংশনাল বিশ্লেষণে যুগান্তকারী অবদানের জন্য’ তালাগ্র্যান্ডকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে। একাডেমির সভাপতি লিসে ওভরিস বলেন, “তালাগ্র্যান্ড একজন অসামান্য এবং অত্যন্ত সৃজনশীল ক্ষমতাধিকারী গণিতবিদ যার কাজ সম্ভাব্যতা তত্ত্ব, ফাংশনাল বিশ্লেষণ এবং পরিসংখ্যানকে রূপান্তরিত করেছে। তিনি গণিত এবং এর প্রয়োগের উপর একটি বিশাল অবদান রেখেছেন।”
তালাগ্র্যান্ডঃ একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী
মাইকেল তালাগ্র্যান্ড ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন, এক ছোট বোনের সাথে বেড়ে ওঠেন পূর্ব-মধ্যভাগে রোন ও সোন নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত লিওঁ শহরে। বাবা ছিলেন গণিতের অধ্যাপক এবং মা ফরাসি ভাষা শিক্ষা দিতেন। জিনগত অসুস্থতার কারণে পাঁচ বছর বয়সে তিনি একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান। পনের বছর বয়সে তার অন্য চোখও ঝুঁকিতে পড়েছিলো। অন্ধ হওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে তিনি এই সময় কঠোর অধ্যয়ন করেছিলেন এবং গণিত ও পদার্থবিদ্যায় তাঁর সুপ্ত প্রতিভা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে তিনি লিওঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত অধ্যয়ন করেন। ১৯৭৭ সালে তালাগ্র্যান্ড পিয়েরে অ্যান্ড মেরি কুরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তবে তার পূর্বেই ১৯৭৪ সালে প্যারিসের ন্যাশনাল সেন্টার অফ সায়েন্টিফিক রিসার্চ (সিএনআরএস) থেকে একটি গবেষণা পদের প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। তিনি ইনস্টিটিউট ফর ম্যাথামেটিকাল সায়েন্সেস এর ফাংশনাল বিশ্লেষণ দলের সদস্য ছিলেন এবং ১৯৮৫ সাল থেকে সিএনআরএসের গবেষণা পরিচালক পদে আসীন ছিলেন। মাইকেল তালাগ্র্যান্ড ২০০৪ সালে ফ্রেঞ্চ সায়েন্টিফিক একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন এবং ২০১১ সালে নাইট অফ দ্য লিজিয়ন অফ অনারে ভূষিত হন। অ্যাবেল পুরস্কারের আগে তিনি লোয়েভ পুরস্কার (১৯৯৫), ফারম্যাট পুরস্কার (১৯৯৭) এবং শ’ পুরস্কার (২০১৯) সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। শ’ পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তিনি তাঁর ওয়েবসাইটে গাণিতিক সমস্যা সমাধানে একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন [১]।
গণিতে যে অবদানের জন্য এই স্বীকৃতি
অ্যাবেল কমিটির উদ্ধৃতি অনুসারে, স্ফটিক অবিশুদ্ধতার দৈব প্রকৃতি, বৈদ্যুতিক সার্কিটের তাপীয় ওঠানামা, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অসঙ্গতি – এই সব ঘটনার গাণিতিক বর্ণনার মূলে উদ্ভূত অনেক মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তালাগ্র্যান্ড। মূলত তাঁর কাজের তিনটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের জন্য অ্যাবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়ঃ
- প্রত্যাশিত মান থেকে বিচ্যুতিঃ তালাগ্র্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঘনত্ব অসমতা (concentration inequality)। গণিতের সম্ভাব্যতা তত্ত্বের ক্ষেত্রে, তালাগ্র্যান্ডের ঘনত্ব অসমতা হল গুণনের সম্ভাব্যতা ক্ষেত্রের জন্য একটি আইসোপেরিমেট্রিক (isoperimetric) ধরনের অসমতা, যা একটি জ্যামিতিক অসমতা যেখানে একটি সেটের পরিধি এবং এর আয়তন জড়িত। বৃহৎ সংখ্যার আইনে (Law of Large Numbers) প্রত্যাশিত মান থেকে বিচ্যুতি এই প্রসঙ্গে অসমতার একটি আদর্শ; ঘটনার সম্ভাব্যতা এবং ঘটনার পুনরাবৃত্তির সংখ্যার ফাংশন হিসাবে প্রদত্ত বিচ্যুতির সম্ভাবনার জন্য একটি ঊর্ধ্বসীমা। সর্বোপরি, তালাগ্র্যান্ডের পদ্ধতিতে প্রকৃত সম্ভাব্যতা মডেলের বৈধতার একটি সীমা নির্ধারণ করা যায়, যেমন আবহাওয়ার পূর্বাভাস কতখানি সুনির্দিষ্ট হতে পারে।
- বিভিন্ন পরিমাপের মধ্যে পরিবহন খরচঃ অ্যাবেল কমিটি দ্বিতীয় যে অবদানের কথা উল্লেখ করেছে সেটি হলো, সম্ভাব্যতা পরিমাপ এবং গাউসিয়ান বন্টনের মধ্যে তাদের আপেক্ষিক এনট্রপি দ্বারা একটি দ্বিঘাত পরিবহন খরচের দূরত্বকে সীমাবদ্ধকারী একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অসমতা। একটি বৃহৎ অঙ্কের অর্থের অসংখ্য বন্ড এবং শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পোর্টফোলিও পুনর্বিন্যাস করার জন্য পরিবহন খরচ কমানোর সর্বোত্তম সমাধানটি মূলত দুটি পোর্টফোলিও বিতরণের নির্ভরতার জন্য একটি সংখ্যাসূচক মান দ্বারা আবদ্ধ। এই সংখ্যাসূচক মানকে আপেক্ষিক এনট্রপি বলা হয়। যদি দুইটি পোর্টফোলিওর প্রোফাইল একই হয়, তাহলে তাদের মধ্যে কোন পরিবহন খরচ নেই। তারতম্য উল্লেখযোগ্য হলে, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাবে।
- স্পিন গ্লাসের মুক্ত শক্তির সীমাঃ স্পিন গ্লাস হলো পদার্থের এমন একটি রূপ যাতে পরমাণুগুলো নিজেরাই নিজেদের সজ্জিত করতে পারে। পরিসংখ্যান এবং সম্ভাব্যতার ধারণা প্রয়োগ করে তালাগ্র্যান্ড স্পিন গ্লাস কিভাবে আচরণ করে তা নির্ধারণ করেন এবং ২০২১ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারজয়ী জর্জিও প্য্যারিসির অসমাপ্ত প্রমাণ সম্পূর্ণ করেন। পারমাণবিক থেকে মহাজাগতিক স্তরে ভৌত বস্তুর অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা ও পরিবর্তন কিভাবে ঘটে, তা সহজে অনুধাবন করার পথ আবিষ্কার করেন প্য্যারিসি।
অ্যাবেল পুরস্কার নিয়ে দুটি কথা
নরওয়ের বিখ্যাত গণিতবিদ নিল্স হেনরিক অ্যাবেল (১৮০২ – ১৮২৯) এর নামানুসারে নরওয়ের সরকার ২০০১ সালে এই পুরস্কারের প্রচলন করে। এটি একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার যা প্রতিবছর এক বা একাধিক গণিতবিদকে গণিতের যে কোনো শাখায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করা হয়ে থাকে।
গণিতের অপর একটি বিখ্যাত পুরস্কার হলো ফিল্ডস মেডেল। তবে অ্যাবেল পুরস্কারের সাথে এর পার্থক্য হলো ফিল্ডস মেডেল আন্তর্জাতিক ম্যাথমেটিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক ৪০ বা তার কম বয়সী দুই থেকে চারজন গণিতবিদকে চার বছরান্তে প্রদান করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ফিল্ডস মেডেলকে তরুণদের গণিতের নোবেল বলা যেতে পারে। আর অ্যাবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, এটি সবার জন্য উন্মুক্ত এবং ২০০৩ সাল থেকে ফিবছর এই পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। অ্যাবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্যমান ৭.৫ মিলিয়ন নরওয়েজিয়ান ক্রোন। এই পুরস্কার প্রদানের সর্বপ্রথম প্রবক্তা ছিলেন নরওয়ের অপর এক বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ সোফাস লি (১৮৪২ – ১৮৯৯)। ১৮৯৭ সালে আলফ্রেড নোবেল যখন একটি বার্ষিক পুরস্কার প্রবর্তনের চিন্তা করছিলেন, আর তাতে গণিতের কোনো স্থান ছিলো না, তখন লি সেই শূন্যতা পূরণার্থেই মূলত অ্যাবেল পুরস্কারের ধারণা উত্থাপন করেন। এরপর ১৯০২ সালে অ্যাবেলের জন্মশতবার্ষিকীতে তৎকালীন রাজা দ্বিতীয় অস্কার এই মহান গণিতবিদের সম্মানার্থে একটি পুরস্কার প্রচলনে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরবর্তিতে নরওয়ের ডাকটিকিট ও ৫০০ নরওয়েজিয়ান ক্রোন ব্যাংক নোটে অ্যাবেলের প্রতিকৃতি প্রকাশ করা হয়। অবশেষে ২৩ আগস্ট ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে অসলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক বক্তৃতায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টলটেনবার্গ (বর্তমানে ন্যাটোর মহাসচিব) ২০০ মিলিয়ন নরওয়েজিয়ান ক্রোন আর্থিক মূল্যমানের একটি অ্যাবেল তহবিল গঠনের ঘোষণা দেন। ২০০৩ সালে প্রথম এই পুরস্কারে ভূষিত হন ফরাসি গণিতবিদ জিন-পিয়েরে সেরে। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে মাইকেল তালাগ্র্যান্ড পঞ্চম ফরাসি গণিতবিদ হিসেবে অ্যাবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত হন।
Leave a Reply