জীববিজ্ঞানের সুন্দরতম পরীক্ষণ


লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

ডিএনএকে বলা হয় জীবনের নীল নকশা। দ্বিসূত্রক ডিএনএ’তে A,T,C,G এই চারটি অক্ষরে জীবনের যাবতীয় তথ্যাদি ‘লেখা’ থাকে। জীবনের এই তথ্যকে ‘রেসিপির সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যে রেসিপি’ অনুযায়ী তৈরি হয় নানাবিধ প্রোটিন। প্রোটিনের মাধ্যমেই আমাদের চোখের রং, চুলের ধরন থেকে শুরু করে কোষে অক্সিজেন পরিবহণ, বহিরাগত জীবাণুর মোকাবিলাসহ নানাবিধ শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়। যাহোক, জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বংশগতীয় তথ্যের সঞ্চারণ। এজন্য ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত সকল জীবই কোষ বিভাজনের পূর্বে তার ডিএনএ’র সংখ্যা বাড়াতে হয়। ডিএনএ’র সংখ্যা বাড়ে প্রতিলিপন (Replication) প্রক্রিয়ায়।

ডিএনএ’র সরলীকৃত রাসায়নিক গঠন

ডিএনএ’র প্রতিলিপন হয় এটা জানা থাকলেও, ঠিক কীভাবে হয় সে-ব্যাপারে জল্পনা-কল্পনা ছিল বহুদিন। প্রাথমিকভাবে তিনটি অনুকল্প (Hypothesis) আলোচিত হয়। এগুলো হলো:

  • সংরক্ষণশীল অনুকল্প: এই ধারণা মতে একটি আদি ডিএনএ থেকে যে দুটি ডিএনএ তৈরি হয়, তার একটিতে দুটি সুতা-ই আসে আদি ডিএনএ থেকে এবং অপরটিতে দুটি সুতা-ই নতুনভাবে সৃষ্টি হয়। এই অনুকল্পটি সঠিক বলে বিবেচিত হয় নি।
  • অর্ধ-সংরক্ষণশীল অনুকল্প: এই অনুকল্প মতে নতুন তৈরি হওয়া ডিএনএ অণুর একটি সুতা হয় আদি ডিএনএ’র, অন্যটি হয় নতুনভাবে সৃষ্ট। এখানে পুরোনো ডিএনএ’র ‘অর্ধেক’টা, মানে একটা সুতা, নতুন ডিএনএতে সংরক্ষিত থেকে যায় বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে অর্ধ-সংরক্ষণশীল অনুকল্প। ১৯৫৩ সালে ডিএনএ’র গঠন বিষয়ে তাঁদের যুগান্তকারী মডেল প্রণয়নের পর, ওয়াটসন এবং ক্রিক এই পদ্ধতিতে ডিএনএ প্রতিলিপন হয় বলে প্রস্তাব করেছিলেন।
  • বিচ্ছুরণশীল অনুকল্প: এই ধারণা অনুসারে আদি ডিএনএ’র সুতা দুটো বিশ্লিষ্ট বা খণ্ডিত হয়ে প্রতিলিপি তৈরি করে। এরপর বিভিন্ন পরিমাণের নতুন ও পুরাতন খণ্ডকের সংযুক্তির মাধ্যমে নতুন দুটো ডিএনএ তৈরি হয়। এই ধারণাটিও শেষমেশ বাতিল হয়।
ডিএনএ প্রতিলিপন অত্যন্ত জটিল এবং ঘটনাবহুল একটি প্রক্রিয়া

ম্যাথিউ মেসেলসন এবং ফ্র্যাঙ্কলিন স্টাহল ১৯৫৮ সালে এক ‘ক্লাসিক’ পরীক্ষার মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেন ডিএনএ প্রতিলিপনের পদ্ধতি অর্ধ-সংরক্ষণশীল। এই পরীক্ষণটিকেই ‘জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে সুন্দরতম পরীক্ষণ’ বলা হয়ে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না পরীক্ষাটি ছিল অত্যন্ত চৌকস। কাজ করার জন্য তাঁরা বেছে নেন প্রাণরসায়নবিদদের পছন্দের মডেল ব্যাকটেরিয়া ই কোলাই’কে। প্রথমে তারা ই কোলাই’এর একটা পপুলেশনকে একটি বিশেষ মাধ্যমে বাড়তে দিলেন। মাধ্যমটার বিশিষ্টতা এ-ই যে সেখানে নাইট্রোজেন উৎস হিসেবে আছে নাইট্রোজেনের ‘ভারী’ আইসোটোপ 15N। প্রকৃতিতে অবশ্য নাইট্রোজেনের ‘হালকা’ আইসোটোপটিরই প্রাচুর্য বেশী।

অনেক প্রজন্ম বাড়তে দেওয়ার পর তাঁরা যখন ওইসব কোষের ডিএনএ আলাদা করে সেন্ট্রিফিউজ করলেন দেখা গেলো এই ডিএনএগুলো সাধারণ 14N দিয়ে তৈরি ডিএনএর চেয়ে প্রায় এক শতাংশ ভারি হিসেবে পৃথক ব্যান্ড তৈরি করেছে। এখানে বলে রাখা ভালো, সেন্ট্রিফিউগেশন প্রাণ-রসায়নে বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। এখানে কেন্দ্রবিমুখী বল’(Centrifugal Force) কে কাজে লাগিয়ে একটি মিশ্রণ থেকে বিভিন্ন ঘনত্বের উপাদানগুলিকে আলাদা করা যায়। নমুনা দ্রবণকে টেস্টটিউবে নিয়ে টেস্টটিউবটিকে সেন্ট্রিফিউজ মেশিনের অক্ষের চারপাশে উচ্চ গতিতে ঘুরানো হয়। প্রোটিন, বিভিন্ন কোষ অঙ্গাণু কিংবা প্রাণ-অণুকে (Biomolecules) পৃথক করতে এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর। মেসেলসন এবং স্টাহল যে বিশেষ সেন্ট্রিফিউগেশন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন,তার নাম সিজিয়াম ক্লোরাইড ডেনসিটি গ্রেডিয়েন্ট

ম্যাথিউ মেসেলসন এবং ফ্র্যাঙ্কলিন স্টাহল

সেন্ট্রিফিউগেশন। এখানে সেন্ট্রিফিউজ টিউবটিতে মাধ্যম হিসেবে সিজিয়াম ক্লোরাইডের দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। তবে কোনো নির্দিষ্ট ঘনমাত্রার নয়, বরং বিভিন্ন ঘনমাত্রার দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। টিউবের নিচের দিকে থাকে বেশি ঘনমাত্রার দ্রবণ এবং ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে উপরের দিকে দ্রবণের ঘনমাত্রা থাকে সবচেয়ে কম। এভাবে ঘনমাত্রার একটি ‘আনতি’ তৈরি করা হয়। বিভিন্ন প্রাণ-অণু,বা অঙ্গাণুকে যখন এতে সেন্ট্রিফিউজ করা হয় তখন উপাদানগুলো তাদের ঘনত্ব অনুযায়ী সিজিয়াম ক্লোরাইডের একেক স্তরে আলাদা হতে থাকে। এভাবে তাদের আলাদা করা যায়।

যাহোক, অনেক প্রজন্ম ধরে বংশবিস্তারের পর যখন সব ব্যাকটেরিয়ার জিনোমেই নাইট্রোজেনের ভারী আইসোটোপ স্থায়ী হয়ে গেলো, তখন এই মাধ্যম থেকে সরিয়ে তাদের আলাদা একটা মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হলো যেখানে নাইট্রোজেনের উৎস শুধুমাত্র 14N। মেসেলসন এবং স্টাহল জানতেন এককোষী ই কোলাই ঠিক কতসময় পর বাইনারি ফিশন প্রক্রিয়ায় একটি মাতৃকোষ থেকে দুটি অপত্য কোষ তৈরি করে। সময়টা মোটামুটি বিশ মিনিট। ঠিক বিশ মিনিট পর,যখন কিনা কোষগুলো একবার মাত্র বিভাজিত হয়ে কোষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে, সিজিয়াম ক্লোরাইড গ্রেডিয়েন্ট

ছবি- সেন্ট্রিফিউগেশন। সূত্র- দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি

সেন্ট্রিফিউগেশনে দেখা গেলো ভারি ডিএনএ’র ব্যান্ড এবং হালকা ডিএনএ’র ব্যান্ড দুটোর মাঝামাঝি জায়গায় একটা ব্যান্ড তৈরি হয়েছে। এর অর্থ হলো প্রথম প্রজন্মের এই ডিএনএ’গুলো মূলত ‘সংকর’ (Hybrid) প্রকৃতির। অর্থাৎ নতুন ডিএনএ’তে হালকা এবং ভারী দুইরকম নাইট্রোজেনই যুক্ত আছে। এই ফলাফল সংরক্ষণশীল প্রতিলিপনের ধারণাকে বাতিল করে দিলো। ডিএনএ প্রতিলিপন সংরক্ষণশীল পদ্ধতিতে হলে দুটো আলাদা ব্যান্ড পাওয়া যেত। কারণ তখন আদি ডিএনএ বিভাজিত হয়ে যে নতুন দুটো ডিএনএ তৈরি করতো, তার একটি হতো সম্পূর্ণভাবে ভারি আইসোটোপের, আরেকটি হতো হালকা আইসোটোপের।

ছবিসুত্র- Lehninger Principles of Biochemistry,Nelson and Cox,4th edition

অর্ধ-রক্ষণশীল পদ্ধতির পক্ষে আরো জোরালো সমর্থন মিললো পরীক্ষণের পরের ধাপে। কোষগুলোকে আবারো ওই একই মাধ্যমে বিভাজিত হতে দেওয়া হলো। দ্বিতীয় প্রজন্মের কোষগুলো থেকে পৃথকীকৃত ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা গেলো এরা দুটি ব্যান্ড তৈরি করেছে। তার একটি মিলে যায় হালকা ডিএনএ’র সাথে, আরেকটি পূর্বতন ধাপে পাওয়া সংকর ডিএনএ’র সাথে। বিচ্ছুরণশীল অনুকল্প সঠিক হলে এই ধাপেও আগের মতোই একটা মাত্র ব্যান্ড পাওয়া যেতো এবং সেটি হতো সংকর ডিএনএ’র ব্যান্ড।

অর্ধ-রক্ষণশীল প্রতিলিপন নিশ্চিত হওয়ার পর দেখা দিলো নতুনসব প্রশ্ন:

ডিএনএ প্রতিলিপন কি যাদৃচ্ছিক (Random) যেকোনো জায়গা থেকে শুরু হতে পারে? মাতৃ ডিএনএ’টা কি প্রতিলিপনের সময় সম্পূর্ণ খুলে যায়,না-কি কিছুটা খোলে আবার কিছুটা প্যাঁচ খায়? একবার প্রতিলিপন শুরু হলে,সেটি কি কেবল একদিক বরাবর হতে থাকে,না কি দু-দিকে চলতে থাকে?

এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা সাজিয়ে বসেন নতুন সব পরীক্ষণের পরিকল্পনা,সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে থাকে নতুন তথ্য-তত্ত্ব এবং সত্য; আর আমরা ধীরে ধীরে এগোতে থাকি জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই অণুটির ব্যাপারে আরো সমৃদ্ধতর জ্ঞানের দিকে। 

ডিএনএ’র গঠন আবিষ্কারের যাত্রা এবং নিজেদের পরীক্ষা নিয়ে কথা বলেছেন মেসেলসন এবং স্টাহল-

তথ্যসূত্র-

  • Lehninger Principles of Biochemistry,Nelson and Cox,4th edition
  • দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি, সুজয় কুমার দাশ, অন্বেষা প্রকাশন, প্রথম মুদ্রণ (২০২৪)

লেখাটি 140-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Response

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading