মানবদেহের গড়ন অবিশ্বাস্যরকম জটিল। সাম্প্রতিক তথ্যমতে, আমাদের দেহ ষাট ধরনের টিস্যুর চার শ রকমের কোষ নিয়ে গঠিত। বিজ্ঞান আমাদের শরীর সম্বন্ধে বিশদে জানার দুয়ার খুলে দিয়েছে। বড় বড় রোগ থেকে সেরে উঠা এখন মামুলি ব্যাপার। এমনকি এই জটিল রহস্যময় শরীরের বিবর্তন বোঝাও সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞানের কল্যাণে। কিন্তু এখনও রহস্যের ডেরা এই শরীরের অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। সেকমই এক রহস্য হল নারীর মেনোপজ তথা রজোনিবৃত্তি হওয়া।
বয়স পঞ্চাশের কোঠায় পৌঁছুলে সব নারীরই ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যায়। এসময় স্ত্রী দেহে ডিম্বাণু উৎপাদন প্রক্রিয়া থেমে যায়। সন্তানধারণ আর সম্ভব হয় না। আমাদের চোখে এটা সম্পূর্ণই স্বাভাবিক একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু অন্যদিক দিয়ে ভাবলে এটা মোটেও স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কেন সম্পূর্ণ সুস্থ সবল থাকার পরেও নারীর প্রজনন ক্ষমতা বন্ধ হয়ে যাবে? যেখানে আরও কয়েক দশক সুস্থ জীবন সামনে পড়ে আছে। এমন ঘটনা প্রকৃতিতে অন্যান্য প্রাণী প্রজাতিদের মধ্যে খুবই বিরল। একেবারেই যে নেই তা না। শিকারি তিমি অর্কাস, ছোট পাখাবিশিষ্ট পাইলট তিমি, বেলুগাস এবং নারওয়ালদের স্ত্রী সদস্যদের মধ্যেও এমনটা দেখা যায়। এরা উর্বর কাল নিবৃত্ত হওয়ার পরেও অনেকদিন বাঁচে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন নারীদের মেনোপজ হয়? প্রশ্নটা অন্যভাবে করি যদি, কেনই বা উর্বরকাল থেমে যাবার পরেও নারীরা অনেকদিন বাঁচে?
চিরায়ত বিবর্তনবিদ্যা বলে, যেকোনো জীবের ততদিনই বেঁচে থাকা উচিত যতদিন সে নিজের জিন বংশানুক্রমে ছড়িয়ে দিতে পারে। তাই যদি হয় তাহলে নারীদের রজোনিবৃত্তি হওয়ার পরেও অনেকদিন বেঁচে থাকাটা ঠিক বিবর্তনের ধারণার সাথে সাযুজ্য হয় না। নারীদের রজোনিবৃত্তি হওয়ার কারণটা পুরোপুরি ভাবেই জৈবিক। তাদের শরীর ঠিক কতদিন উচ্চ গুণাগুণ সমৃদ্ধ ডিম্বাণু উৎপাদন করতে পারবে তার একটা সময়সীমা আছে। বিজ্ঞানীদের মতে কালপরিক্রমায় মানুষের গড় আয়ু বাড়লেও নারীদের মেনোপজ হওয়ার বয়স বরং কিছুটা কমে এসেছে। নারীরা জন্মসূত্রে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম্বাণু নিয়েই জন্মায়। বয়সকালে সে সংখ্যা বাড়ে না বরং ধীরে ধীরে ডিম্বাণুর ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ফলে গুণাগুণ নষ্ট হয়। ওদিকে পুরুষ স্বাভাবিক জীবদ্দশায় কখনো একেবারে অনুর্বর হয় না। যদিও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণাগুণ দুটোই কমে।
এবারে আমার প্রশ্নে ফেরা যাক। রজোনিবৃত্তি হওয়ার পরেও নারীদের অনেকদিন বেঁচে থাকার ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানীরা “গ্র্যান্ডমাদার অনুকল্প (হাইপোথিসিস)” নামে একটি অনুকল্প দাড় করিয়েছেন। অনুকল্পটি বলে, নারীদের উর্বরকাল সমাপ্ত হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার ব্যাপারটা বরং আমাদের বিবর্তনে অনেক বড় সুবিধা দিয়েছে। রজোনিবৃত্তি হলে ঐ নারী আর সন্তান জন্ম দিতে পারেন না ঠিকই কিন্তু জীবনের বাকী সময়টা নিজের নবাগত নাতি-নাতনিদের দেখাশুনা করতে পারেন। সাধারণত একটি মানব শিশুর জন্ম হয় বেশ অপরিণত আর অসহায় অবস্থায়। জন্মের পর ঐ শিশুটির স্বনির্ভর হতে অন্তত দুই দশক লেগে যায়। প্রথম কয়েক বছর তো নিজের খাবার অবধি নিজে খেতে পারে না। এমতাবস্থায় শিশুটির বাবা-মা জীবিকার সন্ধানে গেলে কিংবা অন্য সন্তানদের যত্নআত্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকলে, ঐ শিশুটির খাবার খাওয়ানোসহ সামগ্রিক দেখভালের দায়িত্ব নেন এটির দাদি। অন্যদিকে আমাদের কাছের আত্মীয় শিম্পাঞ্জির শিশু জন্ম নেয় বেশ পরিণত অবস্থায়। ছ বছর থেকেই এটি নিজের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে শিখে যায়।
সম্প্রতি বেশকিছু প্রমাণাদি গ্র্যান্ডমাদার অনুকল্পের পক্ষে সমর্থন যোগায়। তানজানিয়ার হাডজা এবং প্যারাগুয়ের এইচ’দের মতো কিছু শিকারিগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়, পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীরা তরুণ সন্তানদের টিকে থাকা এবং উর্বরতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছেন। যেহেতু নাতি-নাতনিদের শরীরে ২৫ ভাগ জিন তাদের দাদির কাছ থেকে আসে সুতরাং এদের টিকে থাকার মধ্য দিয়ে দাদি তার জিন ছড়িয়ে দিতে পারছেন। অর্থাৎ এভাবে বিবর্তনের অন্ধ প্রজননের উদ্দেশ্য ঠিকই রক্ষা হচ্ছে। শিশু যদি না টেকে তাহলে অনেক সন্তান নিয়েও তেমন লাভ নেই। তাই বিবর্তন মানব স্ত্রীদের একটা সময় উর্বরতার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বরং নবাগত বংশ প্রদীপদের রক্ষা করার দিকে চালিত করে। বিজ্ঞানীদের মডেল বলছে, এটা একটা নারীকে তিনটা নতুন সন্তান জন্মদানের সমান সুবিধা দেয়।
একই ব্যাখ্যা খাটে অর্কাস এবং পাইলট তিমিদের বেলায়ও। এদের শিশুরাও মানবশিশুর মতই বেশ অপরিণত এবং অসহায় অবস্থায় জন্মায়। রজোনিবৃত্ত স্ত্রী তিমিরা এসব শিশুকে খাদ্যের জোগান দিয়ে, কোথায় কি করে খাবার সন্ধান করতে হয় তা শিখিয়ে সাহায্য করে।
এতে করে এসব অপরিণত শিশুর টিকে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অজিত ভারকি দাবি করেছেন, তিনি গ্র্যান্ডমাদার অনুকল্পের সপক্ষে জিনতাত্ত্বিক প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৫ সালে তাঁর গবেষণা দল, মানব ডিএনএ’তে CD33 নামে এক প্রকার ইমিউন জিনের সন্ধান পেয়েছেন। জিনটি শেষ বয়সে আলঝেইমার রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানীরা ২০ শতাংশ আধুনিক মানুষের দেহে এই জিনটি শনাক্ত করেন।
কিন্তু মানুষের নিকট আত্মীয় শিম্পাঞ্জি, নিয়ানডার্থাল কিংবা ডেনিসোভানদের জিনোমে পাওয়া যায় নি। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, প্রাকৃতিকভাবে এই জিনটি আমাদের জিনোমে নির্বাচিত হওয়ার কারণ আমাদের স্ত্রী সদস্যদের শেষ বয়সে আলঝেইমারের মতন বুদ্ধিমত্তার জটিলতার হাত রক্ষা করা। যেহেতু আমাদের স্ত্রী সদস্যরা মেনোপজ হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকেন নাতি-নাতনিদের দেখভাল করবার উদ্দেশ্যে। কাজেই এসময় তাদের সুস্থ থাকাটা জরুরি। এতে করে তারা বংশের নবাগত শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারেন। পরবর্তীতে ভারকি ও তাঁর দল, CD33 জিনের অনুরূপ আরও দশটি জিন শনাক্ত করেন যেগুলো মেনোপজ পরবর্তী নারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক জটিলতার হাত থেকে রক্ষার সঙ্গে জড়িত। এই বিষয়টিই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নারীরা রজোনিবৃত্তি হওয়ার পরেও এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন যে তাদের মানসিক সুস্থতা রক্ষার্থে আমাদের জিনোমে নতুন জিনও বিবর্তিত হয়েছে। কাজেই রাত্রিবেলা নিয়মিত শরীর ঘেমে উঠা কিংবা গরম অনুভূত হওয়া আসলে নারীর জীবনে নতুন তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনার ইঙ্গিত যার ওপর গোটা মানবজাতির বিবর্তনীয় সফলতা নির্ভর করে।
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply