আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে এমন কী আছে, যেটা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু এটম বোমার চেয়েও বিধ্বংসী; তাহলে আমি চোখ বন্ধ করে এই ধাঁধার উত্তর দিবো, ‘ভাইরাস’। হালের করোনা অতিমারী (সার্স-কোভ-২) সেটা ভালো মতোই বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে। অণুজীবজগতের সবচেয়ে বিষ্ময়কর বস্তু হলো ভাইরাস। আজ পর্যন্ত গবেষকেরা ভাইরাসের জটিলতাকে সম্পূর্ণরূপে সমাধান করতে পারেননি। তবে এরা শুধু অপকারই করে না, উপকারও আসে। ভাইরাস বড়ই রহস্যময় স্বত্ত্বা!
ভাইরাস কী?
নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রিউ লৌফ বলেছিলেন, “A virus is a virus. It is neither a living organism nor a non-living chemical, but something between and betwixt.” যেটার মানে দাঁড়ায়, ভাইরাস ভাইরাসই। এটি জীবও নয়, আবার জড় বস্তুও নয়। বরং এটি জীব ও জড় পদার্থের মধ্যবর্তী পর্যায়ের কিছু একটা, যা কখনো জীবের মতো, আবার কখনো জড় পদার্থের মতো আচরণ করে। আধুনিক গবেষণানুসারে আজ আমরা জানতে পেরেছি, ভাইরাস নিষ্ক্রিয় অবস্থায় জড়ের মতো আর সক্রিয় অবস্থায় জীবের মতো থাকে।
কিন্তু ব্যাপারটা এতটাও সোজা নয়। কেন সোজা নয়, সেটা জানব। তবে তার আগে আমাদের জানা দরকার ভাইসের জৈবিক বা জড় বৈশিষ্ট্য আসলে কেমন। প্রথমে ভাইয়াসের জৈবিক বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দেওয়া যাক। এদের দেহে নিউক্লিক এসিড (ডিএনএ/আরএনএ) আছে। আর ‘নিউক্লিক এসিড’ একমাত্র জীবেরই বৈশিষ্ট্য। ভাইরাস বাধ্যতামূলক পরজীবী, যা পোষক দেহের অভ্যন্তরে বংশবৃ্দ্ধি করতে সক্ষম। এরা মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন জাত সৃষ্টি করে। শুধু তা-ই নয়, ভাইরাসে ভ্যারিয়েশন (প্রকরণ), জিনগত পুনর্বিন্যাস বা জেনেটিক রিকম্বিনেশন, মিউটেশন ইত্যাদি ঘটতে দেখা যায়। এসব কিছু বিবেচনা করে একদল বিজ্ঞানী এদেরকে ‘জীব’ বলে আখ্যা দেয়। কারণ-
- ভাইরাস নিউক্লিক এসিডের মাধ্যমে বংশগতীয় স্বকীয়তা রক্ষা করে নতুন বংশ সৃষ্টি করে
- মিউটেশন, ভ্যারিয়েশন এবং জেনেটিক রিকম্বিনেশন কেবলমাত্র জীবদের বৈশিষ্ট্য
এই দুই বৈশিষ্ট্যের কারণে কিছু বিজ্ঞানী ভাইরাসের প্রকৃতি ‘জীব মতবাদ’ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। একারণে ভাইরাসকে জীবজগতের অন্তর্ভুক্ত করতে জীবজগৎকে প্রধান দুইভাবেগ ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো ক্যাপসিড এনকোডিং অরগানিজম (CEO: Capsid Encoding Organism) এবং অন্যটি রাইবোজোম এনকোডিং অরগানিজম (REO: Ribosome Encoding Organism)। একদম খাঁটি বাংলায় ভাঙলে এর মানে দাঁড়ায়-
- ক্যাপসিড গঠনের সংকেতওয়ালা জীব (CEO)
- রাইবোজোম গঠনের সংকেতওয়ালা জীব (REO)
এক্ষেত্রে মারগুলিস, হুইটেকার এবং সোয়ার্টজের পঞ্চ রাজ্যের জীবেরা আরইও (REO) এর অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ আরইও’দের জিনোমে রাইবোজোম গঠন করার নির্দেশবাহী জিন রয়েছে। আর এই বৈশিষ্ট্যটি ব্যাকটেরিয়া, প্যারামেসিয়াম, ইস্ট, মানুষ এবং গাছের কোষের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যায়।
অন্যদিকে রয়েছে সিইও (CEO), যার মধ্যে পুরো ভাইরাসজগৎ অবস্থান করবে। যেহেতু ভাইরাসদের দেহে রাইবোজোম নেই, তাই রাইবোজোম গঠনের সংকেত বহন করার প্রশ্নই ওঠে না। ভাইরাসে প্রোটিন আবরণী (ক্যাপসিড) থাকে। আর এটা গঠনের সংকেত তাদের জিনোমে পাওয়া যায়, যেটা আবার আরইও’দের নেই। সেদিক বিবেচনা করে ভাইরাসকে জীবজগতের অংশ হিসেবে ধরাই যায়।
কিন্তু, আরেক পক্ষ থেমে নেই। তাদেরও যুক্তি আছে এবং তারা প্রমাণ করতে চায় যে ভাইরাস আসলে জড়। আর এক্ষেত্রে তারা ‘অণু মতবাদ (Molecule theory)’ প্রদান করেছেন। প্রাণরসায়নবিদদের এই মতবাদানুসারে, ভাইরাস একটি ক্ষুদ্র রাসায়নিক অণু। ভাইরাস মূলত নিউক্লিক এসিড ও প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত রাসায়নিক পদার্থ মাত্র। এতে কোনো কোষীয় অঙ্গাণু নেই (কোষই নেই, অঙ্গাণু থাকবে কীভাবে?), নেই কোনো শক্তি উৎপাদনকারী সিস্টেম। আর আমাদের আজকের গল্পের নায়ক ভাইরাসে কোনোরকম বিপাক প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় না। এখানেই জীবদের সাথে ভাইরাসের তফাৎ। কারণ ভাইরাসে এটিপি (ATP) তৈরি করার ক্ষমতা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভাইরাস স্বাধীনভাবে প্রোটিন তৈরি করতে পারে না।
এখন ভাইরাসের আরও কিছু জড় বৈশিষ্ট্য দেখে আসা যাক। এরা খাদ্য বা পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে না এবং এদের স্বাধীনভাবে জন্মানোর ক্ষমতা নেই। আরও মজার বিষয় আছে। ভাইরাসকে পরিস্রুত ও কেলাসিত করে ক্রিস্টালে পরিণত করা যায়। শুধু তা-ই নয়, ডিটারজেন্ট প্রয়োগ করে ভাইরাসের উপাদানসমূহ পৃ্থক করা যায়। মজার ব্যাপার হলো, এই উপাদানগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে আবার যুক্ত করা হলে ভাইরাস পূর্বাবস্থা ফিরে পায়। এখানেই কি শেষ? ওদের সাসপেনশনও তৈরি করা সম্ভব। তাছাড়া ভাইরাসের আয়তন স্বাভাবিকভাবে কখনো বাড়ে না। যদিও এই যুক্তিটি অতটা শক্তিশালী নয়, তবে প্রাণরসায়নবিদেরা ভাইরাসকে যেই করেই হোক জড় পদার্থ প্রমাণ করতে চান। কারণ পোষক দেহ ছাড়া ভাইরাস একেবারেই জিরো।
তাহলে? এই তর্ক-বিতর্ক কি চলতেই থাকবে নাকি কোনো একদিকে বিজ্ঞানীরা ঝুঁকে পড়বেন? এই প্রশ্নটা নিয়ে আমাদের চেয়ে বিজ্ঞানীদের মাথাব্যাথা বেশি। জিনোমিক্স এবং সাইটোলজির প্রভূত উন্নয়নের ধারায় গবেষকেরা ভাইরাসকে নির্দিষ্ট সারিতে রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন। তবে আপাতত এটি “দুমুখো সাপ” হিসেবেই বিজ্ঞানীদের মাথা খেতে থাকুক।
ভাইরাসের উৎপত্তি
ভাইরাস জীব নাকি জড় সেই বিতর্কের যেরকম শেষ নেই, তেমনি এদের উৎপত্তি কীভাবে হলো তা নিয়েও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই। তবে মোটাদাগে ‘ভাইরাসের উৎপত্তি’ নিয়ে ৩টি ধারণা সবচেয়ে বেশি আলোচিত। এদের আবার গালভরা নামও আছেঃ প্রোগ্রেসিভ হাইপোথিসিস, রিগ্রেসিভ হাইপোথিসিস এবং ‘ভাইরাসই প্রথম’ হাইপোথিসিস। একে এই তিনটির ভেতরে ঢোকা যাক!
প্রোগ্রেসিভ হাইপোথিসিস অনুসারে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের রূপান্তরের মাধ্যমে প্রোটিন এবং নিউক্লিক এসিডের সৃষ্টি। এই জৈব যৌগগুলোই প্রাণের মৌলিক উপাদান। বিজ্ঞানীদের মতে এই উপাদানগুলো থেকেই জলজ পরিবেশে অকোষীয় সরল ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটে। এই হাইপোথসিসি অনুসারে, অজীব উপাদান থেকে জীবের মতো সত্ত্বার উৎপত্তি ঘটেছে বলে একে অগ্রগতিমূলক অনুকল্প বা প্রোগ্রেসিভ হাইপোথিসিস বলা হয়। তবে কিছু সীমাবদ্ধতা এবং অস্পষ্টতার কারণে এই মতবাদ বর্তমানে গ্রহণযোগ্যতা হারাতে বসেছে।
এবার রিগ্রেসিভ হাইপোথিসিসটা বোঝা যাক। এই মতবাদানুসারে ভাইরাস অন্য কোনো অণুজীব থেকে সৃষ্ট। এক্ষেত্রে ভাইরাসকে রিকেটসিয়া, ক্ল্যামাইডিয়া বা মাইকোপ্লাজমার মতো জীবদের বিবর্তিত রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ধারণার সমর্থকদের মতে, ব্যাকটেরিয়া ডোমেইনের কোনো জীব সদস্য অপর কোনো জীবের সাথে মিথোজীবীতার সম্পর্ক তৈরি করে এবং একটা সময়ে গিয়ে ব্যাকটেরিয়াটি ঐ জীবদের দেহে প্রবেশ করে পরজীবীতে পরিণত হয়। স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলা এই বাধ্যতামূলক পরজীবীই ভাইরাস। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা মিমিভাইরাসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। কারণ রিকেটসিয়া প্রোওয়াজেকিই (Rikettsia prowazekii) এর সাথে মিমিভাইরাসের প্রায় সবক্ষেত্রেই সাদৃশ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে আদিকোষী থেকে অকোষীয় সত্ত্বার আবির্ভাব ঘটে বলে একে পশ্চাদমুখী ধারণা বা রিগ্রেসিভ হাইপোথিসিস বলা হয়।
আর বাকি রইল ‘ভাইরাস ফার্স্ট’ মতবাদ। আগের দুটির চেয়ে এটি একটু ভিন্ন রকম। কারও কারও মতে, সরল আরএনএ থেকেই ভাইরাসের উদ্ভব এই আরএনএ অণু এনজাইমের মতো কাজ করত এবং এর ফলে বিভিন্ন বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। এই বিক্রিয়াগুলোই ভাইরাসের সূচনা করে। পরবর্তীতে গিয়ে হয়ত মিউটেশনের প্রভাবে ভাইরাসগুলোর সংক্রমণ ক্ষমতা পেয়েছে। ধীরে ধীরে পরিবর্তনের পরিক্রমায় ডিএনএ ও ডিএনএ ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটে।
তিনটি ধারণার পেছনেই যুক্তি আছে। আবার ধারণাগুলোর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। আবার এই ৩টির কোনটাই পুরোপুরি সঠিক নাও হতে পারে। তাই ভাইরাসের উৎপত্তি এখন ‘ডিম আগে নাকি মুরগি আগে?’ প্রশ্নের মতো হয়ে গিয়েছে। তবে আধুনিক জীববিজ্ঞানের সাধকেরা আদাজল খেয়ে এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে নেমে পড়েছে। আশা করা যায়, সামনে আমরা কোনো স্থিতিশীল সমাধান পাবো।
ভাইরাসের গঠন
এতক্ষণ যেই ‘এটম বোমা’ নিয়ে কথা বললাম, সেটা দেখতে কেমন? তালের মতো নাকি আমের মতো? প্রথমেই বলি, ভাইরাস দেখাটা যেন-তেন ব্যাপার না। এটা অতিআণুবীক্ষণিক (Ultramicroscopic) সত্ত্বা। চাইলাম আর ঠুস করে দেখে ফেললাম, এই মামার বাড়ির আবদান এখানে চলবে না। একে দেখতে হলে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ লাগবে। তারপর এটির প্রকৃত গঠন বোঝা যাবে। বিজ্ঞানীরা এই কাজটা ভালোমতোই করেছেন। করে কী কী তথ্য পেলেন, সেগুলোই এখন জানতে হবে।
ভাইরাস এত ক্ষুদ্র যে এর ব্যাস প্রায় ৮-২০০ মাইক্রোমিটার। সংক্রমণ ক্ষমতা বিশিষ্ট ভাইরাস কণাকে ভিরিয়ন বলে। এই ভিরিয়নের মূল গাঠনিক উপাদান দুটিঃ ক্যাপসিড ও নিউক্লিক এসিড। ক্যাপসিড হলো প্রোটিন আবরণী। এটি মূলত নিউক্লিক এসিডকে বেষ্টন করে রাখে। অনেকে ভুল বশত মনে করে যে ভাইরাসে বহিঃআবরণী হল ক্যাপসিড। সবক্ষেত্রে এই ধারণ সঠিক নাও হতে পারে। যেসকল ভাইরাস প্রাণীদেরকে আক্রমণ করে (যেমনঃ ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস), সেসকল ভাইরাসের ক্যাপসিডের বাইরেও আরেকটা আবরণী থাকে, যেটা ঐ ভাইরাসের চূড়ান্ত বহিঃআবরণী। এই অতিরিক্ত আবরণকে বলে এনভেলাপ। অর্থাৎ ক্যাপসিড নিউক্লিক এসিডের আবরণী এবং এনভেলাপ নিউক্লিওক্যাপসিডের বহিরাবরণ।
একটি ফুলের মালায় যেরকম অনেকগুলো ফুল থাকে, তেমনি ক্যাপসিডে অনেকগুলো সাব-ইউনিট থাকে, যেগুলো ক্যাপসোমিয়ার বলে। ভাইরাসের ধরণ ভেদে ক্যাপসোমিয়ারের সংখ্যায় পার্থক্য দেখা যায়। যেমনঃ হার্পিস ভাইরাসের ক্যাপসিডে ১৬২টি ক্যাপসোমিয়ার থাকে। ক্যাপসোমিয়ারগুলো প্রতিসাম্য বজায় রেখে বিন্যস্ত থাকে। একারণে এদের সজ্জাক্রম কখনো প্রিজমাকার, আবার কখনো বর্তুলাকার হতে পারে। ক্যাপসিড মূলত প্রোটিন নির্মিত হলেও কিছু কিছু ভাইরাসের ক্যাপসিডে পলিস্যাকারাইড ও লিপিড থাকে। এই ক্যাপসিড কিছুটা ‘বুলেটপ্রুফ’ জ্যাকেটের মতো নিউক্লিওয়েড অঞ্চলকে (যে অঞ্চলে নিউক্লিক এসিড অবস্থান করে) সুরক্ষা প্রদান করে এবং এন্টিজেনিক পদার্থ হিসেবে কাজ করে।
ক্যাপসিড ভেদ করে আরও ভেতরে ঢুকলে আমরা নিউক্লিক এসিড দেখতে পাবো। ভাইরাস ভেদে এর পরিমাণ ৫%, ৬%, ৪০% বা ৫০% হতে পারে। ভাইরাসে সাধারণত যেকোনো এক প্রকার নিউক্লিক এসিড থাকে (ডিএনএ/আরএনএ)। সাধারণত উদ্ভিদে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসগুলো আরএনএ-ভাইরাস এবং প্রাণীদেহে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসগুলো ডিএনএ-ভাইরাস হয়ে থাকে। তবে এরও ব্যতিক্রম দেখা যায়। ভাইরাসের ডিএনএ একসূত্রক (কলিফেজ ভাইরাস) বা দ্বিসূত্রক (টি-টু ব্যাকটেরিওফাজ ভাইরাস) হতে পারে। আবার আরএনএও একসূত্রক (টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস) বা দ্বিসূত্রক (রিওভাইরাস) হতে পারে। যাহোক, এই নিউক্লিক এসিড মূলত সংক্রমণ ও প্রতিলিপি তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
এবার বলব এনভেলপের কথা, যেটার ব্যাপারে কিছুক্ষণ আগেই দুয়েক বাক্য ব্যয় করে ফেলেছি। যে ভাইরাসে এনভেলপ থাকে, তাকে এনভেলপড ভাইরাস বলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এনভেলপড ভাইরাসকে লিপোভাইরাসও বলা হয়। এই কিউট নামের কারণ হলো এনভেলপে সাধারণত লিপিড থাকে। লিপিড ছাড়াও প্রোটিন ও পলিস্যাকারাইডও থাকে। আর যে বিধবা ভাইরাসে এনভেলপ নেই, তাকে নগ্ন ভাইরাস (Naked Virus) বলে। এনভেলপে কিছু অভিক্ষিপ্ত কাঁটা সদৃশ অংশ থাকতে পারে, যাকে ‘স্পাইক’ বলে। এই স্পাইক মূলত ‘হিমাগ্লুটানিন’ প্রোটিন দ্বারা তৈরি। বলুন তো, এই স্পাইকের কাজ কী? নাকি এরা বেকার?
ভাইরাসের রাসায়নিক গঠনে আরও ব্যতিক্রমী কিছু উপাদান থাকতে পারে। যেমনঃ লাইসোজাইম, রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ এনজাইম, কপার, বায়োটিন ইত্যাদি। কিন্তু এসব উপাদান কেন থাকে, সেই প্রশ্নের উত্তর আশা করি কৌতুহলী পাঠকেরা খুঁজে বের করবেন।
লাইটিক ও লাইসোজেনিক চক্র
ভাইরাস সম্পর্কে জানতে গেলে এই বিদঘুটে শব্দ দুটো সামনে আসবেই। প্রথমে লাইটিক চক্রের কথা বলি। এই প্রক্রিয়ায় ভাইরাস এক সাংঘাতিক কাজ করে বসে। প্রথমে পোষক ব্যাকটেরিয়ার ভেতরে ভাইরাসটা ভদ্রভাবে ঢোকে। তবে ঢোকার সময় টুক করে নিজের দেহের লাইসোজাইম নামক এনজাইম নিঃসরণ করে, যেটার প্রভাবে ব্যাকটেরিয়ার মিউকোপেপ্টাইড স্তর দ্রবীভূত হয়ে যায়। আর এই সুযোগে বেটা ভাইরাস নিজের পথ করে নিয়ে ঢুকে পড়ে নতুন এলাকায়। তবে ঢোকার সময় ক্যাপসিড ফেলে দিয়ে যায়।
ব্যাকটেরিয়ার এলাকাতে ঢুকেই সে দাদাগিরি শুরু করে। নিজের ডিএনএ দিয়ে পোষক কোষের ডিএনএকে ধমকায়। বেচারা পোষক কোষের ডিএনএ ভয়তে প্রোটিন সংশ্লেষণ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বেটা ভাইরাস নিজে ঐ ব্যাকটেরিয়ার নিউক্লিওটাইড ব্যবহার করেই ডিএনএ ও প্রোটিন সংশ্লেষণ করতে থাকে। অনেকটা ব্রিটিশ উপনিবেশের মতো অবস্থা! যেহেতু ডিএনএ আর প্রোটিন দুটোই ভাইরাস পেয়ে যায়, তাই সে নিজেকে নতুন রূপে সজ্জিত করে। এরপর নিজের সাঙ্গ-পাঙ্গ বাড়াতে থাকে, মানে সংখ্যাবৃদ্ধি করে। এরপর ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীর গলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে চলে আসে।
লাইসোজেনিক চক্র অতটা সাংঘাতিক না হলেও ভয়ঙ্কর বটে। এক্ষেত্রে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএর সাথে বন্ধুত্বের অভিনয় করে। ভাইরাসের ডিএনএ ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএর সাথে যুক্ত হয়। এই সহাবস্থানকে প্রোফাজ বলে। এরপর থেকে যখনি ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ বিভাজিত হয়, তখন ফ্রীতে এক কপি ভাইরাল ডিএনএও পাওয়া যায়। এ ধরণের বিভাজন পদ্ধতিকে বলা হয় সিনক্রোনাস বিভাজন।
বিস্তার ও স্থানান্তর
কোথায় ভাইরাসের রাজত্ব নেই? সবুজ-শ্যামল প্রকৃ্তি, সুসজ্জিত বাসা-বাড়ি, বডিবিল্ডারের শরীর কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকার মুখের সামনের ফুচকা-আইসক্রিম- সবখানেই ওরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমরা এতোটাই নির্বোধ যে হাসতে হাসতে তাদেরকে আমাদের দেহে ঢুকিয়ে ফেলি। আর তারাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আমাদেরকে পরাস্ত করে।
ডজনখানেক উপায়ে ভাইরাসের স্থানান্তর ঘটতে পারে। আমরা জানি, ভাইরাস বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে নিমিষেই আমাদের শরীরে ঢুকতে পারে। এটা করোনা মহামারির সময় বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই বুঝতে পেরেছে। মাঝেমধ্যে সায়েন্স ফিকশন মুভিতে দেখা যায়, কোনো একটা প্রাণীর কামড়ে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়ে বিদঘুটে কিছু একটাতে পরিণত হচ্ছে। মুভিতে বিষয়টাকে অতিরঞ্জিত করা হলেও বাস্তবে কিন্তু এরকম বিধ্বংসী ভাইরাস ছড়ানোর ঘটনা ঘটে। এছাড়াও বাদুড়-কুকুরের মতো প্রাণী, খাবার-পানি, বিভিন্ন হাবিজাবির মাধ্যমে আপনার-আমার দেহে ভাইরাস ঢুকে যেতে পারে।
তবে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস ট্রান্সমিশনের (স্থানান্তরের) নাটের গুরু হলো পোকা-মাকড়। এরা চুপচাপ উদ্ভিদে গিয়ে গা ঘষবে আর বেচারা নিথর গাছও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে। আবার এরা তিড়িং-বিড়িং করার কারণে যখন উদ্ভিদের পরাগায়ন হয়, তখনও অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাস সংক্রমিত পরাগরেণু সুস্থ উদ্ভিদে স্থানান্তরিত হয়। আবার কখনো কখনো নেমাটোডদের কারণে উদ্ভিদ ভাইরাসের শিকার হয়। এছাড়াও বীজ, যন্ত্রপাতি এবং অঙ্গজ প্রজননের কারণেই ভাইরাস চুপ করে উদ্ভিদদেহে ঢুকে যেতে পারে।
ভাইরাসের প্রভাব
ইবোলা, বার্ড ফ্লু, করোনা, এইচআইভি-এসব ভাইরাস আমাদের যে কী জ্বালিয়েছে, তা হয়ত বা এতো দিনে সবাই বুঝতে শুরু করেছে। বিশ শতকে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস কোটি কোটি মানুষকে কুপোকাত করেছিল। এরপর এইচআইভি কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো! বর্তমান পৃথিবীর প্রায় চার কোটি মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত। সমকামী, যৌনকর্মী, রক্তদাতা-সব ক্যাটাগরির মানুষের মধ্যেই এটা ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই ভাইরাসের আক্রমণে বিদ্ধস্ত ইউরোপ, আমেরিকা এবং আফ্রিকা। রক্ষা পায়নি বাংলাদেশ ও ভারতের মতো এশিয়ার দেশগুলোও। করোনা ভাইরাসের কথা আর কী বলবো? সবাই তো এর তান্ডব দেখলই। এসব ধ্বংসযজ্ঞ দেখলে ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বুঝাই যায়। একদম এটম বোমার মতোই!
কিন্তু ভাইরাস যে উপকারেও আসে, এটা কি জানেন? কিছুটা জুতা মেরে গরু দানের মতো ব্যাপার! প্রথমেই ভ্যাক্সিনের কথা বলতে হয়। বর্তমানে সংক্রমণ ক্ষমতাবিহীন জীবিত ভাইরাস হতে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক তৈরি করা হয়। বিজ্ঞানীরা জেনেটিক্স ও মলিকিউলার বায়োলজির গবেষণায় ভাইরাস ব্যবহার করে। আবার ব্যাক্টেরিওফাজ ভাইরাস বিভিন্ন প্যাথোজেনিক (রোগ সৃষ্টিকারী) ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে উদ্ভিদ ও প্রাণীকে রোগ থেকে রক্ষা করে। বর্তমানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের স্থানান্তরের বাহক হিসেবে ভাইরাস ভূমিকা রাখে।
শুধু কি তাই? এদের কিছু গোষ্ঠী যখন লাল টিউলিপ ফুলে আক্রমণ চালায়, তখন লম্বা সাদা দাগ পড়ে যায়। এর ফলে ফুলের সৌন্দর্য ও চাহিদা বৃ্দ্ধি পায়। আর এই সুযোগে ব্যবসায়ীরাও বেশি দামে ফুলগুলো বিক্রি করতে পারে। এছাড়াও জীবনের সূচনা, অভিব্যক্তি ও ক্রমবিকাশের ধারা সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য ভাইরাস একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম। বর্তমানে পতঙ্গ বা অন্য জীব নিয়ন্ত্রণেও ভাইরাস ব্যবহৃত হয়, যাকে বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল বলা হয়।
শেষ কথা
খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মানুষের মাথা খেয়ে ফেলে এমন এক সত্তা হলো ভাইরাস। ‘ভাইরাস’ লিখতে যতটা জায়গা লাগে, তার মধ্যেও হাজার হাজার ভাইরাস বসে থাকতে পারে। সৃষ্টির শুরু থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত এরা আছে এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও এরা থাকবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী শতাব্দীতে ভাইরাসের সংক্রমণে কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে। আর এর পেছনে প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখবে বিভিন্ন জৈব অস্ত্র, দুর্যোগ ও মানুষের আন্তর্জাতিক স্থানান্তর। আর তাই একে ‘আণুবীক্ষণিক এটম বোমা’ নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই যায়।
(লেখাটির কিছু অংশ ইতিপূর্বে কালের কণ্ঠে প্রকাশিতে হয়েছে)
তথ্যসূত্র–
- Virus | Definition, Structure, & Facts
- Structure and Classification of Viruses – Medical Microbiology
- The concept of virus-A Lwoff
- Intro to viruses-Khan Academy
- The Good that Viruses Do | Harvard Medicine Magazine
- The Lytic and Lysogenic Cycles of Bacteriophages
- The Origins of Viruses
- জীবনের গল্পঃ দ্বিতীয় খন্ড-সৌমিত্র চক্রবর্তী। পৃষ্ঠাঃ ১৭
Leave a Reply