সম্প্রতি একদল গবেষক ‘প্রচলিত’ বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অপর একটি বিস্ফোরণের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন।
মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং নামে এক বিকট মহাজাগতিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে যে আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সূচনা, তা বোধ করি আপনি পদার্থবিদ্যার ছাত্র না হলেও শুনে থাকবেন। ১৯২৯ সালে মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল ছায়াপথের দূরত্বের সাথে পশ্চাদপসরণ বেগের সম্পর্ক নির্ণয় করতে গিয়ে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পৃথিবী থেকে যে ছায়াপথ যত দূরে, সে ছায়াপথের পশ্চাদপসরণ বেগ তত বেশি। সহজ করে যদি বলি, দূরবর্তী ছায়াপথগুলো আরও দ্রুতবেগে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর বছর দুয়েক আগে বেলজিয়ামের মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ ও ক্যাথোলিক ধর্মযাজক জর্জ লেমাইটার সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণসমূহের সমাধান নির্ণয় করেছিলেন। লেমাইটার এবং হাবলের যুগপৎ অবদান আর্থার এডিংটন, উইলেম ডি সিটার এবং আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো প্রথিতযশা বিজ্ঞানী যারা মহাবিশ্বের স্থির ও অ-ঘূর্ণনশীল মডেল নিয়ে কাজ করছিলেন কিন্তু এটি নিয়ে সংশয়ে ছিলেন, তাঁদের সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আজ থেকে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পূর্বে মহাজগত বলতে ছিলো শুধু একটি অতি উত্তপ্ত এবং অসীম ঘনত্বসম্পন্ন বিন্দু, যাকে আজকের দুনিয়ার সকল পদার্থ এবং শক্তির ‘বীজ’ হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে। কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মুহূর্তে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের মাধ্যমে পদার্থ এবং শক্তি ‘ডালপালা মেলতে শুরু করে।’ সংঘটিত যে ভয়ানক বিস্ফোরণের মাধ্যমে জাগতিক প্রক্রিয়া ও সময় গণনার শুরু, তার একটি ভিডিও সিম্যুলেশন আপনি নিচের ভিডিওটিতে দেখে নিতে পারেন।
তবে এই ভিডিওতে আপনি যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটি শুনতে পেলেন, বিগ ব্যাং এর সময় এই রকম শব্দের সৃষ্টি হয়নি নিশ্চয়ই। আপনি যদি কেটলিতে পানি নিয়ে তা চুলায় গরম করতে করতে বুদবুদ সৃষ্টি পর্যন্ত অপেক্ষা করেন, তবে দেখবেন বুদবুদগুলো প্রসারিত হচ্ছে, ফেটে যাচ্ছে অথবা অপরটির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। আপনি বাষ্পীভূত পানির যে ‘হিস্’ শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, বিগ ব্যাং এর পর আদি মহাবিশ্বে এরকমই শব্দ বিরাজমান ছিলো।
বাষ্পীভূত পানি থেকে সৃষ্ট সংঘর্ষরত বুদবুদের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে একে মহাজাগতিক স্কেলে কল্পনা করে পদার্থবিদগণ এতদিন যাবত মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে আমরা যা জানতাম, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। তাঁদের মতে, বিগ ব্যাং এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অপর একটি বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে। আর এই বিস্ফোরণে দৈত্যাকৃতির কণা উৎপন্ন হয়ে থাকতে পারে যেগুলোর ভর প্রথম বিস্ফোরণে সৃষ্ট সাধারণ পদার্থ সৃষ্টিকারী ব্যারিওনিক কণার ভরের কয়েক ট্রিলিয়ন গুণ পর্যন্ত হতে পারে। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বে ছায়াপথগুলোকে আঠার ন্যায় ধরে রাখা ডার্ক ম্যাটার বা তমোপদার্থের রহস্যের সুরাহা হতে পারে। গবেষকদল প্রথম বিস্ফোরণকে সাধারণ বা তপ্ত মহাবিস্ফোরণ এবং দ্বিতীয় বিস্ফোরণকে ডার্ক বা তমোমহাবিস্ফোরণ বলে অভিহিত করেছেন।
ডার্ক ম্যাটার বা তমোপদার্থ কী?
মহাবিশ্বে ছায়াপথগুলো একে অপরকে যে বেগে প্রদক্ষিণ করা উচিৎ, বাস্তবে তার থেকে বেশি বেগে প্রদক্ষিণ করে। আবার স্বতন্ত্রভাবে প্রতিটি ছায়াপথের বাইরের দিকের অংশ কেন্দ্রস্থ অংশের তুলনায় অধিকতর দ্রুতবেগে ঘোরে। দ্রুতবেগে ধাবমান ছায়াপথগুলোকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে এক (অদৃশ্য) বৃহদাকার পদার্থগুচ্ছের বাড়তি মহাকর্ষ বলকে দায়ী করা হয়, যাকে বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটার বা তমোপদার্থ হিসেবে নামকরণ করেছেন। সাধারণ বা ব্যারিওনিক পদার্থের তুলনায় তমোপদার্থের ব্যাপ্তি পাঁচগুণের বেশি হলেও অদ্যাবধি এর গাঠনিক কণার অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। তমোপদার্থ সম্পর্কে আরও জানতে বিজ্ঞান ব্লগের এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
তমোপদার্থ গঠনকারী কণার অস্তিত্ব প্রতীয়মান না হলেও উইকলি ইন্টারেকটিং ম্যাসিভ পার্টিকেলকে (ডব্লিউআইএমপি) এর অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডব্লিউআইএমপি একটি অনুমাননির্ভর শব্দ, যা কোনো নির্দিষ্ট কণাকে বুঝায় না। তড়িৎচৌম্বকীয়ভাবে নিরপেক্ষ, ভারী এবং আলোর বেগের তুলনায় অনেক ধীরগতিসম্পন্ন কণাকেই ডব্লিউআইএমপি বলা হয়। তড়িৎচৌম্বকীয় নিরপেক্ষতা দ্বারা বুঝায় এরা আলোর (ফোটন কণা) শোষণ বা নির্গমন কোনটাই করে না। এরা পরস্পরের সাথে এবং অন্য কোনো ভরের সাথে দুর্বল বলের (মহাকর্ষ) মাধ্যমে মিথস্ক্রিয়া করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এ কারণেই এদের উইকলি ইন্টারেকটিং পার্টিকেল বলা হয়। ম্যাসিভ বলার কারণ হচ্ছে এদের ভর প্রোটনের ভরের চেয়ে বেশি। এরা যখন পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন ধ্বংস হয়, এবং এ সময় গামা রশ্মি নির্গত হয়। নিচের অ্যানিমেশন ভিডিওটিতে সংক্ষেপে ডব্লিউআইএমপির বৈশিষ্ট্য দেখে নিতে পারেন।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক চামকাউর ঘাগ বলেন, “এখন পর্যন্ত ডব্লিউআইএমপিই ডার্ক ম্যাটার কণার সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধি। কমপক্ষে আরও এক দশক লাগতে পারে অন্য কোনো তত্ত্ব ডব্লিউআইএমপিকে প্রতিস্থাপন করতে।” তবে ঘাগ এ ব্যাপারে মুক্তমনা যে দ্বিতীয় বিগ ব্যাং এর মতো কোনো তত্ত্ব বিকল্প হতে পারে। তিনি বলেন, “আপাতদৃষ্টে এ তত্ত্বে (দ্বিতীয় মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বে) কোনো ভুল নেই। প্রশ্ন হচ্ছে এটি পর্যবেক্ষণে টিকে থাকবে কি না বা আদৌ পরীক্ষণযোগ্য কি না?”
আরেকটি মহাবিস্ফোরণের প্রয়োজনীয়তা
“ডার্ক ম্যাটারের গাঠনিক কণার খোঁজে আমাদের ব্যর্থতা অস্বস্তিকর। তবে এমনও হতে পারে যে এই অসফলতা আমাদের কোনো প্রকৃত সত্যের দিকে ইঙ্গিত করতে চাইছে,” — বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অস্টিনের অধ্যাপক ক্যাথেরিন ফ্রিস। তাঁর মতে, যদি আমরা এখনও ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান না পেয়ে থাকি, তবে সময় এসেছে এটি কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কে আমাদের অনুমানকে পুনরায় পর্যালোচনা করার। তিনি বলেন, “সবার ধারণা একটি বিগ ব্যাং এর থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি, কিন্তু আসল ঘটনা কয়জনই বা জানে?”
২০২৩ সালে ফ্রিস এবং তাঁর সহকর্মী মার্টিন উইঙ্কলার ফিজিক্যাল রিভিউ ডি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে প্রস্তাব করেন, সাধারণ বিগ ব্যাং সংঘটিত হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মাথায় অপর একটি বিগ ব্যাং ঘটে থাকতে পারে। তাঁরা একে ডার্ক বিগ ব্যাং হিসেবে আখ্যায়িত করেন, কারণ, তাঁদের মতে দ্বিতীয় এই বিগ ব্যাং এর কারণেই ডার্ক ম্যাটার বা তমোপদার্থের সৃষ্টি হয়।
১৯৪৯ সালে বিগ ব্যাং কসমোলজির ধারণা সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হলেও এর স্বপক্ষে প্রমাণ মেলে ১৯৬০ এর দিকে। এসময় পদার্থবিদগণ একটি বিকিরণ সমুদ্র আবিষ্কার করেন, যা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউণ্ড (সিএমবি) নামে অভিহিত হয়। প্রসারমাণ এবং ক্রমশ শীতল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব একে ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু বিগ ব্যাং মডেল দ্রুতই সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। গরম পানির বাথটাবে ঠাণ্ডা পানি ছাড়লে যেভাবে সেটি পুরো বাথটাবে ছড়িয়ে পড়ে, ফোটন ঠিক সেভাবে মহাবিশ্বে সিএমবিতে তাপীয় সমতা আনয়নে তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে। কিন্তু মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তের কোনো অংশে তাপীয় সাম্যতা সৃষ্টিতে বিগ ব্যাং এর পরে যথেষ্ট সময় অতিবাহিত হয় নি। এই ধাঁধার সমাধানে পদার্থবিদগণ বিগ ব্যাং এর পরে চরম প্রসারণের অপর একটি বিস্ফোরণ সংযুক্ত করেন।
ডার্কজিলার খোঁজে
ব্যারিওনিক কণার ভরের কয়েক ট্রিলিয়ন গুণ পর্যন্ত হতে পারে বিধায় ডার্ক ম্যাটার কণাকে জাপানের রূপকথায় বর্ণিত কাল্পনিক এক দৈত্যের নামানুসারে ‘ডার্কজিলা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। তমোমহাবিস্ফোরণে সংঘর্ষরত বুদবুদ স্থান-কালে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের স্বতন্ত্র চিহ্ন রেখে যায়। ক্যাথেরিন ফ্রিস মনে করেন, আমরা এরই মধ্যে এ তরঙ্গ পর্যবেক্ষণে সক্ষমতা অর্জন করেছি। ২০১৬ সালে লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি (LIGO) সর্বপ্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তের ঘোষণা দেয়। এর ফলস্বরূপ LIGO গবেষকবৃন্দ ২০১৭ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
দুটি অতিঘন মহাজাগতিক বস্তুর (উদাহরণস্বরূপ কৃষ্ণগহবর ও নিউট্রন তারকা) মধ্যে সংঘর্ষে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। কিন্তু আরও এক প্রকার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ রয়েছে যার গঠন অনেকটা সিএমবির মতো। অনেকগুলো দূরবর্তী কৃষ্ণগহবরের সংঘর্ষে এটি উৎপন্ন হতে পারে, আবার আদি মহাবিশ্বের দশা পরিবর্তনের মাধ্যমেও এর সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে নর্থ আমেরিকান ন্যানোহার্টজ অবজারভেটরি ফর গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস (NANOGrav) এর জ্যোতির্বিদগণ এই দ্বিতীয় প্রকারের মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পটভূমি গুঞ্জন শনাক্ত করেন।
ক্যাথেরিন ফ্রিস বলেন, “ডার্ক বিগ ব্যাং এর জন্য আমরা যে শক্তির স্কেল সম্পর্কে বলছি তা বুদবুদ সংঘর্ষের জন্য যথেষ্ট, যা NANOGrav সিগনাল দেয়।” NANOGrav কনসোর্টিয়ামের সদস্য কাই শমিটজ বলেন, “বর্তমানে প্রচলিত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে ডার্ক বিগ ব্যাং নাকচ করার সুযোগ নেই।”
পরিশেষে
NANOGrav বিশ্বজুড়ে অন্যান্য পালসার টাইমিং অ্যারে যেমন স্কয়ার কিলোমিটার অ্যারের সাথে যুক্ত হচ্ছে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির লেজার ইন্টারফেরোমিটার স্পেস অ্যান্টেনা ২০৩৭ সাল নাগাদ চালু হতে যাচ্ছে। এর তিনটি স্পেসক্রাফটের মাধ্যমে পাঠানো লেজার বিম মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে আরও সূক্ষ্মভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হবে। ফ্রিস বলেন, এই টেলিস্কোপগুলো ডার্ক বিগ ব্যাং এর ভবিষ্যৎবাণীকৃত সংকেতগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারবে এবং ডব্লিউআইএমপি বা ডার্কজিলা — এই দুয়ের মধ্যে কোনটি ডার্ক ম্যাটার গঠনে ভূমিকা রাখে তা নির্ণয় করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, “আমাদের তথ্য উপাত্তের ওপর নজর রাখতে হবে এবং দেখতে হবে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় কি না।” আর ততদিন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছেই।
তথ্যসূত্র
- ডার্ক এনার্জি এবং ডার্ক ম্যাটারঃ মহাবিশ্বের রহস্যময় গঠনের অনুসন্ধানে; বিজ্ঞান ব্লগ
- Dark matter and gravitational waves from a dark big bang; Phys. Rev. D 107, 083522
Leave a Reply