গত শতকের তিরিশের দশকের আমেরিকা। প্রায় দশজনে এক জন আক্রান্ত হতো এক ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত যৌন-সংক্রামক রোগে। নাম তার সিফিলিস। সারা দেহে দেখা দেয় যন্ত্রণাদায়ক ঘা এবং র্যাশ। এই অবস্থা থাকতে পারে প্রায় দুই বছর। অন্তিম পর্যায়ে (Late-stage) সিফিলিস থেকে হৃদপিণ্ড-মস্তিষ্কসহ দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে সমস্যা দেখা দেয়, তৈরি হতে পারে অন্ধত্ব’ও। এই রোগের সংক্রমণ রোধ করা মারাত্মক কঠিন হয়ে উঠেছিলো। অনিরাপদ যৌন মিলন পরিহারের কথা বলছিলেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কিন্তু মা থেকে সরাসরি বাচ্চার সংক্রমণ এড়ানো যাচ্ছিলো না। পারদ এবং বিসমাথ ব্যবহার করে যে চিকিৎসা দেওয়া হতো, তাও ছিলো অনিশ্চিত, অনিরাপদ এবং বিষাক্ত। এখন আমরা এগুলোকে সম্ভাব্য ক্যানসার-সৃষ্টিকারী ভারী ধাতু হিসেবে জানি, কিন্তু তখন চিকিৎসাবিজ্ঞান এতদূর অগ্রসর হয় নি।
নানারকম অনিশ্চয়তার মধ্যে চিকিৎসকেরা দুটি প্রধান প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন: অন্তিম-পর্যায়ের সিফিলিসে কি বিদ্যমান নিরাময় পদ্ধতি অকার্যকর হয়ে পড়ে? এবং রোগীর বর্ণভেদে কি দেহে রোগের বিকাশ ভিন্ন রকম হয়? সে-কালে এই প্রচণ্ড বর্ণবাদী ধারণা চালু ছিলো যে সিফিলিস শ্বেতাঙ্গদের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে, আর কৃষ্ণাঙ্গদের সংবহনতন্ত্রকে। এই তত্ত্বের পক্ষে কোনো শক্ত প্রমাণ ছিলো না। কিন্তু আমেরিকার তদানীন্তন জনস্বাস্থ্য পরিষদ (US Public Health Service) চাইলো এই ব্যাপারে আরো গবেষণা হোক।
১৯৩২ সালে আলাবামা প্রদেশের টাসকিগি নামক এক জনবহুল শহরে তারা এক বৃহৎ গবেষণার সূত্রপাত ঘটায়। এর দালিলিক নাম ছিলো “Tuskegee Study of Untreated Syphilis in the Negro Male”। শহরটিতে একটা ছোটো হাসপাতাল ছিলো। এই হাসপাতালকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ডাক্তার এবং নার্সদের সাহায্যে শুরু হলো এই গবেষণা। প্রথমে তিনশো নিরানব্বইজন কৃষ্ণাঙ্গকে আনা হলো। এরা সকলে অন্তিম-পর্যায়ের সিফিলিসে ভুগছিলেন। আরেকটি দলে দুইশো এক জন সুস্থ স্বাভাবিক কৃষ্ণাঙ্গকে আনা হলো, যাদের সিফিলিস নেই। কিন্তু এই লোক-সংগ্রহের প্রক্রিয়ার পেছনে ছিলো এক ভয়ানক মিথ্যে।
এই গবেষণার আসল উদ্দেশ্য ছিলো এটা দেখা যে ন্যূনতম চিকিৎসা ছাড়া সিফিলিস কীভাবে দেহে বিস্তার লাভ করে। কিন্তু অংশগ্রহণকারীদের এই খবর জানানো হয় নি। তাদের বরং বলা হয়েছিলো তাদেরকে সরকার থেকে বিনে-পয়সায় খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ এবং চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। পরীক্ষার দিনে প্রথমদিকে গবেষণা-পরিচালকেরা কিছু আসল ওষুধ দিলেও ধীরে ধীরে দেওয়া হতে থাকলো প্লাসিবো। বিশেষ চিকিৎসার নাম করে অংশগ্রহণকারীদের ওপর চালানো হতে লাগলো নানা অনিরাপদ পরীক্ষা। এই রোগীরা মারা গেলে গবেষকেরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার টাকা দেওয়ার বদলে মৃতদেহের অটোপ্সি করে ফেলতেন। গবেষণা-প্রবন্ধে ওইসব মৃত রোগীদের স্বেচ্ছাসেবক হিশেবে তালিকা করা হতো। দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গেরা ঘুনাক্ষরেও জানতেও পারতেন না সিফিলিসে ধুঁকে ধুঁকে কীভাবে তাদের মৃত্যু হয় এবং তাদের মৃতদেহ কেটে-ছিঁড়ে ব্যাধির কী চিহ্ন পাওয়া যায় তা দেখা ছাড়া এই করুণ গবেষণার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।
এদিকে আলাবামা’র বাইরে সিফিলিসের নিরাময় পদ্ধতি আবিষ্কার থেমে থাকে নি। পরীক্ষাটি চালু হওয়ার এক দশক পরেই ক্লিনিকাল ট্রায়াল থেকে দেখা গেলো প্রথম আবিষ্কৃত অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের বিরুদ্ধে দারুণ কার্যকরী। জনস্বাস্থ্য পরিষদের পক্ষ থেকেই অন্যান্য এলাকায় সিফিলিস রোগীদের চিকিৎসার জন্য ‘জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্র’ খোলা হলো; কেবল থামলো না টাসকিগিতে সকলের চোখের আড়ালে ওই অনৈতিক পরীক্ষা। তাদের যুক্তি ছিলো সিফিলিসের দীর্ঘমেয়াদি রোগপ্রভাব পর্যবেক্ষণ করার এর চেয়ে ভালো ‘সুযোগ’ আর পাওয়া যাবে না। বর্ণভেদে রোগের ধরন নিয়ে তাদের ধারণা প্রমাণের কোনো অগ্রগতিই দেখা যাচ্ছিলো না। তবুও, গবেষণার নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিলো নতুন চিকিৎসার খবর তাদের রোগীদেরকে জানানো হবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গবেষকদল তাদের তালিকাভুক্ত ‘সাবজেক্ট’দেরকে যুদ্ধে পাঠানোর সুপারিশ করলো স্থানীয় নিয়োগ কমিটির কাছে। এতে করে যুদ্ধে লোকবল বৃদ্ধির আড়ালে তাদের যে স্বার্থ হাসিল হলো সেটি হলো এই মানুষগুলি পেনিসিলিন-প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হলেন। এই গবেষণা চললো পঞ্চাশের দশক-জুড়েও। ততদিনে পেনিসিলিন সিফিলিসের অন্তিম পর্যায়েও সমান কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আজকের গবেষণা-সংক্রান্ত নৈতিকতার মানদণ্ডে রোগীর সজ্ঞান অনুমতি (Informed consent) ব্যতিরেকে তার সঠিক চিকিৎসা আটকে রাখা গর্হিত অপরাধ। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বৃহৎ অংশজুড়ে এই চর্চা ছিলো মামুলি ব্যাপার। ১৯৪০’র দশকে গুয়াতেমালায় আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত এক গবেষণায় বহু কয়েদি, যৌনকর্মী, সৈনিক এবং মানসিক রোগীকে সিফিলিস-সহ বিভিন্ন যৌন-সংক্রামক ব্যধিতে আক্রান্ত করে সম্ভাব্য চিকিৎসার সন্ধান করা হয়েছিলো। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে গোপনে রোগীদেরকে এরকম উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে ভাইরাস-ঘটিত হেপাটাইটিস, এমনকি ক্যান্সার-সংক্রমণেরও নজির আছে।
তবে সময়ের সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক মহল থেকেই এই ধরনের অনৈতিক পরীক্ষার বিরুদ্ধে আপত্তি উঠতে থাকে। ষাটের দশকের শেষদিকে পিটার বাক্সটন নামে এক তদন্ত কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্য পরিষদকে এই পরীক্ষা বন্ধ করতে বলেন। সদর্থক কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তিনি মিডিয়ায় এই গোপন গবেষণার খবর ফাঁস করে দেন। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে টাসকিগি গবেষণার খবর দেশজুড়ে পত্রপত্রিকার হেডলাইনে উঠে আসে। জানাজানি এবং ব্যাপক শোরগোলের চাপে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়,আদালতে হয় মামলা’ও।
চল্লিশ বছর পর, ১৯৭২ সালে, অবশেষে বন্ধ হয় কুখ্যাত টাসকিগি সিফিলিস পরীক্ষা, বর্ণভেদে রোগের পৃথক আচরণের কোনো লক্ষণ ছাড়াই। পরীক্ষাটি যখন শেষ হয়, প্রাথমিকভাবে নিযুক্ত ওই ছয়শো কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের মধ্যে মাত্র চুয়াত্তর জন বেঁচে ছিলেন। তাদের স্ত্রী এবং সন্তানদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে সিফিলিস। এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মার্কিন কংগ্রেসে গবেষণায় নৈতিক মানদণ্ডের সুরক্ষায় বিশেষ বিল পাস হয়। গবেষণার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে বিশেষ অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে বিবৃতি দেন।
“ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠায় আমাদের যে অঙ্গীকার,তার বিরুদ্ধে এই ঘটনা এক চরম অপমান। দুর্গতদের যারা জীবিত আছেন,তাদের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের, সন্তানদের ও নাতি-নাতনিদের আমি বলতে চাই: পৃথিবীতে কোনো শক্তিই আর হারানো জীবনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে না, মুছতে পারবে না বছরের পর বছর ধরে সহ্য করা দুঃখ এবং যন্ত্রণা।…..আমেরিকার জনগণের সপক্ষে আমরা আপনাদের চোখে চোখ রেখে বলতে চাই, মার্কিন সরকার যা করেছে তা লজ্জাজনক এবং আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”
-বিল ক্লিনটন,সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট
তথ্যসূত্র:
- ‘You’ve got bad blood’: The horror of the Tuskegee syphilis experiment – The Washington Post
- Tuskegee Experiment: The Infamous Syphilis Study | HISTORY
- Public Health Service Study of Untreated Syphilis at Tuskegee and Macon County, AL – Timeline – CDC
- The Tuskegee Experiment: Crash Course Black American History #29
- Ugly History: The U.S. Syphilis Experiment – Susan M. Reverby
Leave a Reply