টার্ডিগ্রেডঃ এক আণুবীক্ষণিক সুপারহিরো’র গল্প


লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাজাখস্তানের একটি মহাকাশ গবেষণা  সংস্থা থেকে ‘ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি’র ফোটন-এম থ্রি (FOTON-M3) মিশন উড্ডয়ন করানো হয়। খুবই সাধারণ একটি মিশন। রকেটের ভিতরে ছিল মহাকাশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী। তবে সেগুলোর মধ্যে একটা জিনিস খুবই স্পেশাল ছিল। সুইডেনের ‘ক্রিস্টিয়ানস্টাড বিশ্ববিদ্যালয়’ এর একদল গবেষক সেই রকেটের ভেতরে রেখে দেন আট হাত-পায়ের কিম্ভূতকিমাকার একধরনের আণুবীক্ষণিক প্রাণী। সেই প্রাণীগুলোকে নিয়েই মহাকাশের উদ্দেশ্যে উড়ে যায় ফোটন-এম থ্রি (FOTON-M3) রকেট। মহাকাশে পৌঁছানোর পর প্রাণীগুলোকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় মহাকাশে। প্রায় ৩ হাজার আণুবীক্ষণিক প্রাণী ছিল সেই পরীক্ষণের অংশ। মহাকাশে উন্মুক্ত করে দেওয়ার দশ দিন পর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয় সেগুলোকে।

পরীক্ষা করে জানা যায় পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৬৮ শতাংশ জীব তখনো বেঁচে রয়েছে। এমনকি কিছু প্রাণী তো বাচ্চা’রও জন্ম দিয়েছে। ২০০৭ সালের সেই পরীক্ষা পুরো বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলকে অবাক করে দেয়। কারণ,এর আগে জানা ছিল শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া’র মতো কিছু আণুবীক্ষণিক জীবই মহাকাশের বায়ুশূন্যতা এবং তেজস্ক্রিয়তায় টিকে থাকতে পারে।  কোনো প্রাণী যে মহাকাশে টিকে থাকতে পারবে সে সম্পর্কে চিন্তাও করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। সেই সুপারহিরো প্রাণীটি হচ্ছে টার্ডিগ্রেড। (বলে রাখা ভালো, ২০০৭ সালের উক্ত পরীক্ষায় দুই প্রজাতির প্রায় ৩০০০ টি টার্ডিগ্রেড ব্যবহার করা হয়েছিল।)

অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে টার্ডিগ্রেড

এবার এই আণুবীক্ষণিক প্রাণীগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া যাক। টার্ডিগ্রেড হলো টার্ডিগ্রাডা পর্বের আট পা-বিশিষ্ট আণুবীক্ষণিক প্রাণী। সমুদ্র,পুকুর,নদী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্বতের চূড়া,বনজঙ্গল এমনকি এন্টার্কটিকা’র বরফের মাঝেও এদের খোঁজ পাওয়া যায়। এদের প্রায় ১৩০০ প্রজাতির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। জার্মান প্রাণীবিজ্ঞানী ‘জোহান অগাস্ট’ ১৭৭৩ সালে সর্বপ্রথম এই প্রাণীদের বর্ণনা দেন। সেসময় তিনি এদের নাম দেন ‘পানির ক্ষুদ্র ভাল্লুক’। এমন অদ্ভুত নামের পেছনে কারণ এদের দেহের আকার। আকারে এরা খুবই ছোট হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক টার্ডিগ্রেড এর দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১.৫ মিলিমিটার এবং সর্বনিম্ন ০.১ মিলিমিটার হয়ে থাকে। তবে বাচ্চা টার্ডিগ্রেড’রা ০.০৫ মিলিমিটার থেকেও ছোট আকৃতির হয়। ব্যারেল আকৃতির শরীরে এদের চার জোড়া পা রয়েছে। প্রতিটি পায়ে আবার ৪-৮ টি করে আঙুল রয়েছে। পরবর্তীতে ১৭৭৭ সালে আরেকজন ইতালীয় জীববিজ্ঞানী এদের টার্ডিগ্রেড নামকরণ করেন।

এদের এমন নামকরনের পেছনে কারণ এদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পা। এদের শরীরের বহিঃকঙ্কাল কাইটিন নির্মিত পদার্থ দিয়ে তৈরি। এই ক্ষুদ্র শরীরেও কিন্তু এদের প্রায় ৪০ হাজারের মতো কোষ রয়েছে। এদের দেখতে পোকার মতো হলেও অন্যান্য পোকাদের সাথে এর বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। শরীরের ১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে ছোট একটি মস্তিষ্ক দিয়ে; যা দিয়ে এরা শরীরের সব ধরণের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়াও শরীরের সামনের অংশে রয়েছে মুখ যার সাহায্যে বিভিন্ন গাছের কোষ,শ্যাওলা ও অন্যান্য আণুবীক্ষণিক জীবকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এরা।

টার্ডিগ্রেড এর দেহের বিভিন্ন অংশ

এই টার্ডিগ্রেড’দের প্রজনন প্রক্রিয়া অত্যন্ত বিস্ময়কর। প্রথমত,অন্যান্য প্রাণীদের মতো শুধু প্রজনন অঙ্গ দেখে এদের নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করা যায় না। নারী টার্ডিগ্রেড আকারে পুরুষ টার্ডিগ্রেড থেকে বড় হয়। এটুকু পার্থক্য দিয়ে সাধারণত বিজ্ঞানীরা এদের আলাদা করেন। যখন প্রজননের সময় হয় তখন নারী টার্ডিগ্রেড এক ধরণের রাসায়নিক নিঃসরণ করে (অনেকটা ফেরোমন এর মতো); যার গন্ধ পুরুষ টার্ডিগ্রেড’কে আকৃষ্ট করে। 

তারপর পুরুষ টার্ডিগ্রেড সেই গন্ধের আকর্ষণে নারী টার্ডিগ্রেড এর সাথে মিলিত হয়৷ টার্ডিগ্রেড’রা ‘ওভিপেরাস’ শ্রেণীর অর্থাৎ এরা ডিম পাড়ে এবং নিষেক হয় দেহের বাইরে। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার প্রায় ১৪ দিন পরে ছোট্ট টার্ডিগ্রেড শিশুর জন্ম হয়। এসব নিষিক্ত ডিম নারী টার্ডিগ্রেড এর শরীরের বাইরে আটকানো থাকে। তবে কিছু প্রজাতির টার্ডিগ্রেড এর মাঝে আবার অন্ত:নিষেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অর্থাৎ নিষেক প্রক্রিয়া নারী টার্ডিগ্রেড এর দেহেই সম্পন্ন হয়। যাহোক, ১৪ দিন পর বাচ্চা জন্ম হওয়ার পর এটি ধীরে ধীরে আকারে বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে কিন্তু কোষ বিভাজন হয় না; বরং প্রতিটি কোষ আলাদাভাবে আয়তনে বড় হতে থাকে। ফলে বাচ্চা টার্ডিগ্রেড এর আকারও বৃদ্ধি পায়!

টার্ডিগ্রেড এর জীবনচক্র

এবার আমরা যদি টার্ডিগ্রেড’দের বিবর্তনীয় ইতিহাসের দিকে নজর দিই, তবে আমরা দেখতে পাবো এদের অতীত সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি। এনিমেলিয়া রাজ্য এবং টার্ডিগ্রাডা পর্বের অন্তর্গত এই প্রাণীটির বর্তমানে প্রায় ১৩০০ প্রজাতি টিকে রয়েছে। এই প্রাণীটির বিবর্তন শুরু হয়েছিল এখন থেকে প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে, ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ (Cambrian explosion)  এর সময়। সেসময় কিছু খোলস বিহীন নরম শরীরের প্রাণী থেকে এদের উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। এরকম প্রাণীদের দলকে লোবোপোডিয়ান (Lobopodians) বলা হতো। এরপরই মিলনেশিয়াম সোলেন্সকি (Milnesium swolenskyi) প্রজাতির টার্ডিগ্রেডদের খোঁজ পাওয়া যায় ক্রিটেসাস পিরিয়ডের শেষ দিকের একটি অ্যাম্বার খণ্ডের মাঝে। সেটি প্রায় ন’ কোটি বছরের পুরোনো নমুনা ছিল। অ্যাম্বার খণ্ডের মাঝে এরকম আরো কিছু টার্ডিগ্রেড প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।  

প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার অদ্ভুত ক্ষমতা থাকার কারণেই মূলত এদের পরিবর্তন অনেক কম হয়েছে। হ্যাঁ,অত্যধিক তাপ-চাপ এবং তেজস্ক্রিয়তাও টার্ডিগ্রেড এর ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। পরম শূন্য তাপমাত্রায় এরা কয়েক মিনিট বেঁচে থাকতে পারে। এছাড়াও দেড়’ শ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও এরা বেঁচে থাকতে পারে। বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ১২০০-৬০০০ গুণ চাপেও এরা বেঁচে থাকতে পারে। যদিও এরা বেশিরভাগ সময় পানিতে থাকে, তবুও পানি ছাড়া প্রায় ১০ বছর টিকে থাকার ক্ষমতা রয়েছে এদের। আর, মহাকাশের প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয়তায় টিকে থাকার খবর তো প্রথমেই বলা হয়েছে। অনেকটা সুপারহিরোদের মতো এদের ক্ষমতা। আচ্ছা, তাহলে টার্ডিগ্রেড কি মারা যায় না? অবশ্যই মারা যায়। এরা সাধারণত ৩-৪ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এরপর মারা যায়। এছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশে বেশি সময় রাখলেও অনেক টার্ডিগ্রেড মারা যায়।

টার্ডিগ্রেড এতটাই পরিচিতি লাভ করেছে যে, বিভিন্ন মুভিতেও এদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মার্ভেল কমিকস এর ‘অ্যান্টম্যান’ মুভিতে এই টার্ডিগ্রেড’দের দেখানো হয়েছে। এছাড়াও, ‘স্টার ট্রেক’ এর একটি মুভিতেও বিশাল টার্ডিগ্রেড দেখানো হয়েছে। যদিও বিভিন্ন মুভিতে মহাকাশে এদের কার্যকলাপ দেখানো হয়েছে; তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে   টার্ডিগ্রেডের বিভিন্ন ক্ষমতা মানুষের কাজেও লাগতে পারে, যেমন: মহাকাশে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্য এদের ডিএনএ থেকে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্য কাজে লাগানো যেতে পারে। এছাড়াও রেফ্রিজারেশন ছাড়াই কিভাবে টিকা সংরক্ষণ করে রাখা যায় কিংবা প্রতিকূল পরিবেশেও কীভাবে মানবজাতি টিকে থাকতে পারবে…সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সাহায্য করতে পারে এই টার্ডিগ্রেড!

তথ্যসূত্রঃ

লেখাটি 80-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading