সুজলা-সুফলা-নয়নাভিরাম আমাদের এই পৃথিবী। চারিদিকে প্রাণের বিকাশে পরিপূর্ণ সে। নিয়মিত কিছু জীবের জন্ম হচ্ছে, আবার মৃত্যু হচ্ছে কিছু জীবের। পৃথিবীর চারিদিকে রয়েছে বায়ুমণ্ডলের সুরক্ষাস্তর। বাতাসে রয়েছে প্রচুর অক্সিজেন। রয়েছে পর্যাপ্ত খাদ্যের যোগান। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে পৃথিবীবাসীর। আমাদের চারপাশের এত সুন্দর পৃথিবীটা কিন্তু আগে এত সুন্দর ছিল না। আগে বলতে এখন থেকে প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর আগের কথা বলছি। তখন পৃথিবীর মাত্র জন্ম হয়েছে। ছোট্ট পৃথিবীর আকার তখন একেবারে ছোট। তবে আকার ছোট হলে কি হবে,মাথা প্রচুর গরম! প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ছে গ্রহাণুকণা,উল্কা প্রভৃতি মহাকাশীয় বস্তু; সাথে রয়েছে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত। পুরো হুলুস্থুল কারবার ঘটে চলছে পৃথিবী পৃষ্ঠে।
তারপর ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে পৃথিবী এবং আস্তেধীরে গঠন হয় বায়ুমন্ডল; শক্ত হয় পৃথিবী পৃষ্ঠ। প্রাণের বিকাশও শুরু হয় সেই আদিম পৃথিবীতে। অবশ্য কয়েক কোটি বছর লেগেছিলো সেই পরিবর্তন হতে। সে সম্পর্কেই বলবো আজ।
গ্রিক রূপকথা অনুযায়ী, দেবতা ক্রোনাস এবং রিয়ার পুত্র ‘হেডিস’ হলো মৃত্যুর দেবতা। সে বাস করে মাটির নিচের পৃথিবী অর্থাৎ নরকে। মৃত্যুর পর পাপীদের শাস্তি দেয় সে। জিউস এবং পসাইডন নামে তার আরো দুই ভাই রয়েছে। তারা তিন ভাই মিলে স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাল শাসন করছে। এখন থেকে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে পৃথিবীর অবস্থা ছিলো নরকতুল্য। চারিদিকে আগ্নেয়গিরির লাভা আর উল্কাপাতে পৃথিবী পৃষ্ঠ ছিন্নভিন্ন। তাই একজন আমেরিকান ভূতত্ত্ববিদ প্রেস্টন ক্লাউড পৃথিবীর সেই সময়কালের নামকরণ করেন নরকের দেবতা ‘হেডিস’ এর নামে। হেডিয়ান সময়কাল’কে বিজ্ঞানী ‘ডব্লিউ বি হারল্যান্ড’ অবশ্য ‘প্রিসকোন সময়কাল’(Priscoan period) হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।
তখনো পৃথিবী পৃষ্ঠ ঠিকভাবে গঠিত হয়নি। পৃথিবীর বাইরের পৃষ্ঠে টগবগ করে ফুটছে ম্যাগমা; পৃথিবীতে আছড়ে পড়ছে অসংখ্য ধূমকেতু,উল্কা আর গ্রহাণু। অবশ্য আছড়ে পড়ার সাথে সাথেই গলে যাচ্ছে সেগুলো। পৃথিবীর আকারও সেসময় তেমন বড় ছিল না। এত কিছু পড়ে মনে হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে, পৃথিবীর উদ্ভব হলো কীভাবে? সে অনেক বড় ঘটনা।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, এখন থেকে প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে আমাদের পুরো সৌরজগত ‘সৌর নীহারিকা’র অংশ ছিল। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল গ্যাস এবং ধূলিকণা। সেই নীহারিকা’র একটি অংশে সূর্যের গঠন শুরু হয়।যেসময়ের কথা বলা হচ্ছে সূর্যে তখনও পারমাণবিক ফিউশন শুরু হয়নি, সে তখনও ঘূর্ণায়মান গ্যাসের একটা কুণ্ডলিমাত্র। সূর্যের সেই অবস্থার নাম প্রোটোস্টার। আর সেসময় সূর্যের চারপাশে নানা ধরণের গ্যাস,ধূলিকণা এবং ধাতুর মিশ্রণ সূর্যের আশেপাশে অনেক জায়গায় ছোট ছোট গুচ্ছে গুচ্ছে জড়ো হয় এবং সেসব থেকেই সৌরজগতের গ্রহগুলোর জন্ম হয়েছে। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ এবং সূর্য,প্রায় একই সময়ে তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর জন্মও এই সৌর নীহারিকা থেকে হয়েছে। সর্বপ্রথম ভারী ধাতুর সমন্বয়ে পৃথিবীর কেন্দ্র গঠিত হয়েছিল। অধিক ঘনত্বের পদার্থ তৈরি করেছিল পৃথিবীর কেন্দ্র,অপরদিকে স্বল্প ঘনত্বের পদার্থ থেকে তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর পৃষ্ঠ। এরপর কয়েকশ কোটি বছর ধরে বিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবী এসেছে বর্তমান অবস্থায়।
হেডিয়ান মহাযুগের পরিচিতি
পৃথিবীর জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত সময়কে চারটা মহাযুগে ভাগ করা হয়েছে, তাদের নাম হেডিয়ান, আর্কিয়ান, প্রোটারোজয়িক আর ফ্যানারোজয়িক মহাযুগ। এই চারটি মহাযুগ এর মধ্যে হেডিয়ান মহাযুগ সবচেয়ে প্রাচীন। এই মহাযুগ শুরু হয় ৪৬০ কোটি বছর আগে এবং পৃথিবী পৃষ্ঠের ঘনীভূত হওয়ার মাধ্যমে প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে এই মহাযুগের সমাপ্তি ঘটে। সৌরজগতে খুঁজে পাওয়া কিছু প্রাচীন উল্কা’র বয়স নির্ণয় করে এই মহাযুগের বয়স নির্ধারণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এটা মোটামুটি মৃত মহাযুগ, আমাদের জানা কোনো জীবন সেই যুগে ছিল না বলে ধারণা করা হয়। এই মহাযুগের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা হলো থিয়া নামক গ্রহের সংঘর্ষে চাঁদের জন্ম, আদি বায়ুমন্ডল স্তরের গঠন,আদিম সমুদ্রের গঠন, টেকটোনিক প্লেটের গঠন এবং আদিম প্রাণের উদ্ভব!
চাঁদের জন্ম
হেডিয়ান মহাযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো চাঁদের উদ্ভব। চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। চাঁদের বয়স আর পৃথিবীর বয়স প্রায় একই। পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের উদ্ভব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা অনেকগুলো মতবাদ দিয়েছেন।
- পৃথিবীর একটি অংশ ভেঙ্গে চাঁদের জন্ম।
- চাঁদ অন্য কোথাও তৈরি হয়েছিল এবং একসময় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আবিষ্ট হয়ে পৃথিবীর চারপাশে ঘোরা আরম্ভ করে।
- পৃথিবীর উদ্ভবের সময়ই নীহারিকা’র ধুলাবালি থেকে চাঁদের জন্ম হয়।
- কোনো গ্রহের আঘাতে পৃথিবীর কিছু অংশ ছিটকে গিয়ে চাঁদের জন্ম হয়।
তবে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে ‘গ্রহের আঘাতে চাঁদের জন্ম’ মতবাদটিই বিজ্ঞানী মহলে সর্বাধিক গৃহীত হয়েছে। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর উদ্ভবের কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যেই ‘থিয়া’ নামক গ্রহের(কাল্পনিক) আঘাতে চাঁদের উদ্ভব হয়। হয়তো থিয়া ঘুরছিল পৃথিবীরই কক্ষপথে, পৃথিবী থেকে বহু দূরে। কোনো একটা গ্রহাণু ধাক্কা দিয়ে থিয়াকে সোজা পৃথিবী বরাবর পাঠিয়ে দেয় এবং সেটি মোটামুটি ৪৫ ডিগ্রি কোণে এসে পৃথিবীকে ধাক্কা দেয়। থিয়া’র আকৃতি ছিল অনেকটা মঙ্গলগ্রহের মতো। থিয়া যখন পৃথিবীকে ধাক্কা দেয় তখন প্রচণ্ড ধাক্কায় পৃথিবী আবার গলে যায় এবং পৃথিবীর একটি অংশ ছিটকে মহাশূন্যে এসে পড়ে। ধীরে ধীরে সেই অংশটি ঠান্ডা হয়ে মহাকর্ষের প্রভাবে গোলাকার আকার ধারণ করে এবং জন্ম হয় চাঁদের।
এপোলো মিশনের সময় চাঁদ থেকে সংগ্রহ করা পাথরের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা গিয়েছে এদের সাথে পৃথিবীর পাথরের অনেক মিল রয়েছে। এছাড়াও চাঁদের পাথর গুলোর বয়স নির্ণয় করে জানা গিয়েছে যে,এগুলো পৃথিবীর জন্মের পরেই তৈরি হয়েছিল। থিয়ার আঘাতে একদিকে যেমন চাঁদের জন্ম হয়, অপরদিকে এই আঘাতের ফলে পৃথিবীর ঘোরার গতি মোটামুটি ২৩ ডিগ্রি কোণে বাঁকা হয়ে যায় এবং একসময় পৃথিবীতে জন্ম হয় ঋতুর!
ধারণা করা হয় হেডিয়ান মহাযুগে পৃথিবীতে তরল পানি ছিল। হ্যাঁ, ২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও পানি তরল ছিল, তার কারণ প্রচণ্ড বায়ুমণ্ডলের চাপ। আর বিষাক্ত কালো আকাশ থেকে তখন নিয়মিত পড়ত বিরাট বিরাট উল্কা। অতি ঘন বায়ুমণ্ডলও তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারত না। এই উল্কা এবং ধূমকেতুর মাধ্যমেই পৃথিবীতে পানি এসেছিল বলে ধারণা করা হয়। হেডিয়ান মহাযুগের প্রথম দিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল জলীয়বাষ্প,মিথেন এবং অ্যামোনিয়া সহযোগে গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে পৃথিবীর পৃষ্ঠ ঠান্ডা হওয়া শুরু করলে সেই জলীয়বাষ্প আকাশ থেকে নেমে এসে বিশাল সাগরের সৃষ্টি করে,যেখানে পরবর্তীতে প্রাণের উদ্ভব হয়। সেই ৬০ কোটি বছর এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে, সেসময়ের সাধারণ কোনো পাথর পাওয়া যায়নি। তবে অস্ট্রেলিয়া,গ্রিনল্যান্ড এবং কানাডার কিছু অংশে জিরকন সমৃদ্ধ একধরনের পাথর পাওয়া গিয়েছে,যেগুলোকে সেসময়ের বলে ধারণা করা হয়। বয়স নির্ণয় করে জানা গিয়েছে সেগুলো প্রায় ৪৪০ থেকে ৪১০ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল। এর থেকে ধারণা করা হয় পৃথিবীর জন্মের ১০ কোটি বছরের মধ্যেই পৃথিবী পৃষ্ঠ শক্ত হতে শুরু করে।
প্রাণের বিকাশ
প্রাণের বিকাশ সম্পর্কে কিছু মতবাদের মধ্যে অন্যতম হলো ‘এবায়োজেনেসিস’ প্রক্রিয়া। রসায়নিক বিক্রিয়া’র মাধ্যমে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। এ সম্পর্কে অনেক তত্ত্ব ও হাইপোথিসিস রয়েছে। তবে প্রাণের উদ্ভব যেভাবেই হোক না কেন এটা সত্যি যে, এখন থেকে প্রায় ৩৫০-৪৫০ কোটি বছরের মাঝে আদিম প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল। বিভিন্ন প্রাচীন পাথর পর্যবেক্ষণ করে সেগুলোতে জীবনের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে ৪২০ কোটি বছর আগেও প্রাণের অস্তিত্ব ছিল পৃথিবীতে। প্রায় ৭০০ অণুজীব এর জিনোম পর্যবেক্ষণ এর মাধ্যমে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন গবেষকেরা। তবে সেই প্রাণ কিন্তু সরাসরি মুখ দিয়ে খাদ্য গ্রহণ করতো না বরং হাইড্রোজেন গ্যাস এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে শারীরবৃত্তীয় কাজ পরিচালনা করতো। এভাবে হেডিয়ান মহাযুগে বিভিন্ন সময় প্রাণের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে হেডিয়ানে প্রাণের উদ্ভব হলেও তা পূর্ণতা পায়নি! প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারেনি আদিম সেই জীবেরা।
হেডিয়ানের সমাপ্তি
এখন থেকে প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে শেষ হয় হেডিয়ান মহাযুগ। হেডিয়ানের শেষ দিকে পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড শক্তিশালী হতে শুরু করে,পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীরগতির হতে থাকে। এছাড়াও এসময় টেকটোনিক প্লেটের উদ্ভব হয়। ধারণা করা হয় হেডিয়ান এর মাঝামাঝি সময়ে ভূ-খণ্ডের উদ্ভব হয় এবং এই মহাযুগের শেষ দিকে পুরো পৃথিবী পানির নিচে তলিয়ে যায়। এছাড়াও এসময় Late Heavy Bombardment নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ঘটেছিল। অসংখ্য ধূমকেতু,উল্কা,গ্রহাণু এসময় পৃথিবী পৃষ্ঠে আছড়ে পড়েছিল। পাশাপাশি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ ও উপগ্রহগুলোতেও একই সময়ে একই ঘটনা ঘটেছিল বলে গবেষণায় জানা গিয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এসব গ্রহাণুর মাধ্যমেই পৃথিবীতে পানি এসেছিল।
হেডিয়ান মহাযুগের শেষেই শুরু হয় আর্কিয়ান মহাযুগ। পুরো পৃথিবী তখন পানির নিচে; কিছু আগ্নেয়গিরি আর পর্বত শুধু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই আর্কিয়ানের সমুদ্রেই পৃথিবীতে উদ্ভব হয় প্রথম প্রাণের; গঠিত হয় মহাদেশ। সে সম্পর্কে অন্য আরেকদিন আলোচনা করা যাবে!
তথ্যসূত্র–
Leave a Reply