স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বন্যা পরবর্তী করণীয়

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

প্রতি বছরই কম বেশি আমাদের দেশে বন্যা হচ্ছে। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে অনেকে জানে বেঁচে গেলেও বন্যা পরবর্তী সময়ে সঠিক স্বাস্থ্যসেবার অভাবে করুণ পরিণতির শিকার হতে হয়। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদেরকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে রোগ বা শারীরিক সমস্যাগুলো দেখা দেয়, সেগুলো হলো টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা, কৃমির সংক্রমণ, রেস্পাইরেটরি ট্রাক্ট ইনফেকশন ও চর্মরোগ। এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে হলে কী করতে হবে? আর যারা রোগাক্রান্ত, তাদেরকে কীভাবে কোন চিকিৎসা দিতে হবে? আজকে এই নিয়েই আলাপ হবে। চলুন, শুরু করা যাক!

বন্যার ঝড়-ঝাপটা দূর হলে প্রথমেই ৩টা জিনিস ঠিক করতে হবে- বসবাসের স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা বা খাওয়ার পানি বিশুদ্ধ করা এবং আহত ও রোগাক্রান্তদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা । দেখুন, বন্যার সময় তো বসতবাড়ির পরিবেশ দূষিত হয়ে যায়। এরপর আবার বিভিন্ন পশু-পাখির মল-মূত্র মিলে-মিশে ঘড়-বাড়িকে জীবাণুতে ভরিয়ে দেয়। যেমনঃ বিড়ালের মল থেকে টক্সোপ্লাজমোসিস এবং গবাদিপশুর মূত্র থেকে লেপ্টোস্পাইরোসিস হতে পারে। আর তাছাড়া পানি-কাদার সংস্পর্শে চর্মরোগ এবং দূষিত পানি পানে পেটের পীড়া দেখা দেয়। কোথায় পানি জমে থাকলে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ার আশঙ্কাও থাকে। 

আর তাই পরিবেশের জলাবদ্ধতা দূর করতে হবে। এরপর পানিতে প্লাবিত ঘর, খাবার পরিবেশনের সামগ্রী এবং আঙ্গিনা ডিটারজেন্ট বা ব্লিডিং পাউডার দিয়ে ধুতে হবে। তাছাড়াও কোনো শক্ত আবর্জনা বা অন্য কোনো ধরণের দূষিত পদার্থ থাকলে সেগুলো দেরি না করেই দূর করুন। কারণ বন্যা পরবর্তী সময়ে এমনিতেই শারীরিক সংকট দেখা দেয় বলে সামান্য পরিমাণ দূষিত বা ক্ষতিকর পদার্থ অনেক বড় রোগ যা জটিলতার কারণ হতে পারে। এমনকি গর্ভপাতের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। এছাড়াও যেসব ব্যবহার্য জিনিস ও খাদ্যদ্রব্য দূষিত পানির সংস্পর্শে এসেছিল, সেগুলো বাছাই করে ফেলে দিতে হবে অথবা পরিশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে।  

এরপর পানি বিশুদ্ধ করতে হবে। কীভাবে করা যায়? কল এবং ট্যাঙ্কারের পানি ব্যবহারের ৩ মিনিট আগে ভালো করে ফুটিয়ে নিতে হবে। আর এই পানি যদি নদী, পুকুর বা অন্য কোনো জলাশয়ের স্রোত থেকে সংগ্রহ করা হয়, তবে সেই পানি ব্যবহারের ৫ মিনিট আগে প্রথমে ফিল্টার করতে হবে, এরপর ফুটাতে হবে। আর এসবের সুবিধা না থাকলে, একটি বড় বালতি নিয়ে ২০-২৫ লিটার পানি এবং ১ চা চামচ (৫ মিলি) ব্লিচিং পাউডার যোগ করুন। এরপর ঐ পানি ৩০ মিনিট স্বাভাবিকভাবে রেখে দিয়ে ব্যবহার করুন। অবশ্যই পানি ফুটানোর সময় এবং বিশুদ্ধ পানি সংরক্ষণে পাত্রের উপরে ঢাকনা ব্যবহার করবেন। 

এর পাশাপাশি যারা বন্যায় কোনোভাবে শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করতে হবে এবং অবস্থা গুরুতর হলে দক্ষ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বন্যাকালীন কোনোভাবে যদি শরীরে ক্ষত তৈরি হয়, তবে সেখানে এন্টিসেপ্টিক ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। যদি ঘা বা এ ধরণের কোনো উপসর্গ ত্বকে দেখা যায়, তাহলে এন্টিফাঙ্গাল ক্রিম ব্যবহার করা অথবা দ্রুত পেশাদার সাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। কারণ এটি গুরুতর চর্মরোগের লক্ষণ হতে পারে। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত ঋতুবতী ও গর্ভবতী নারীদের যত্ন নেওয়া এবং নবজাতকের নিউমোনিয়ার সমস্যা হলে দ্রুত উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। একইভাবে গৃহপালিত পশুদেরও যত্ন নিতে হবে, যাতে তারাও সুস্থ থাকে এবং তাদের থেকে কোনো জীবাণু মানবদেহে সংক্রমিত হতে না পারে। 

তাছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমনঃ খাবার প্রস্তুত করার আগে, শৌচকার্য শেষে, বাচ্চাদের ডায়াপার পরিবর্তন ও অপরিষ্কার কিছু ধরার পরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। মাছি এবং জীবাণু দ্বারা দূষণ ঘটা থেকে বাঁচতে খাবার ও পানিকে ঢেকে রাখতে হবে। বন্যার পরে খাবার যাতে পচে না যায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে নিরাপদ থাকে, সেজন্য শীতল তবে পরিচ্ছন্ন স্থানে খাবার সংরক্ষণ করা উচিৎ। আর এক্ষেত্রে সবার আগে জরুরি খাবার, শিশুখাদ্য এবং ঔষধ সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রে একটা বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখবেন যে যদি তাজা ফল, শাকসবজি এবং অন্য কোনো খাবার বন্যার পানির সংস্পর্শে আসে, তাহলে সেগুলো ফেলে দিতে হবে। 

এরপর আসে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা। বন্যার বিভীষিকা দেখে কিংবা এই দুর্যোগে বাজে রকমভাবে আহত হয়ে অথবা আত্মীয়-সম্পত্তি হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ‘ইংলিশ ন্যাশনাল কোহর্ট স্টাডি অফ ফ্লাডিং অ্যান্ড হেলথ’ এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে যারা বন্যার সম্মুখীন হয় তাদের অনেকের মধ্যে পরবর্তী ৩-৬ বছরের মধ্যে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD), বিষণ্নতা এবং প্যানিক ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো বেশি ছিল। এমন মানুষ এবং সাধারণ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, সরকারী সংস্থা, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। 

বন্যা পরবর্তী সময়ে নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে নিরাপদ রাখতে হলে উপরের পরামর্শগুলো মেনে চলতে হবে এবং যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে হাতুড়ে ডাক্তার বা অনলাইন ভিত্তিক অনির্দিষ্ট আলোচনার উপর ভিত্তি না করে উপযুক্ত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এসময় পারিবারিক পর্যায়ে মানসিক সমর্থন ও সান্ত্বনা প্রদান এবং একে-অপরের যত্ন নেওয়া অত্যান্ত জরুরি। ধীরে ধীরে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে হতাশ না হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আর যথেষ্ট পরিমাণ সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান ও পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়াও যেহেতু বন্যার ধাক্কায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ইমিউন সিস্টেমে কিছু সমস্যা দেখা দেয়, তাই সে সময় মাদক গ্রহণ ভীষণ ভয়ঙ্কর হতে পারে। তাই নেশাজাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকতে হবে। 

তথ্যসূত্রঃ
১. How to recover from flooding – GOV.UK
২. HOW TO STAY HEALTHY AND SAFE AFTER A FLOOD – UNICEF
৩. Looking after your health after the floods

লেখাটি 113-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading