[আমার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিলো সমজীবিতা বা সিম্বায়োসিস। সেটার প্রথম প্রজেক্ট (বা চ্যাপ্টার) ছিলো লিগিউম-রাইজোবিয়া সিম্বায়োসিসে ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যকার যে প্রতিযোগিতা হয়, সেটা বোঝা। এই লেখাতে মূলত আমার সেই গবেষণার একটা প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছি। চলুন শুরু করা যাক।]
হেবার-বস পদ্ধতি কী গত শতাব্দীর সেরা আবিস্কার?
গত শতাব্দীর শুরুতে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল মাত্র দেড়শ’ কোটির মতো। মাত্র একশ বছরের মাথায় জনসংখ্যার আশ্চর্যজনক বৃদ্ধি ঘটে সূচকীয় হারে। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দুইটি প্রধান অনুঘটককে দায়ী করা যায়। একটা হলো চিকিৎসা ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি, যার কারণে আগের মতো মহামারী কিংবা সামান্য ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে আর মানুষ মারা যায় না। কিন্তু সুচিকিৎসাইতো যথেষ্ট নয়, বাড়তি জনসংখ্যাকে তো খাওয়াতে হবে। এমনকি উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ঘটে গেলেও বাড়তি খাদ্য উৎপাদন করা প্রায় অধরা স্বপ্নই ছিল। ম্যালথাসের মতো অর্থনীতিবিদরা ভাবতেন, যেহেতু কৃষিজমি সীমিত, তাই পৃথিবীর জনসংখ্যা একটা নির্দিষ্ট অঙ্কে গিয়ে ঠেকার পরে আর বাড়তে পারবে না। তখনকার কৃষিকাজে অন্যতম বড় সমস্যা ছিলো নাইট্রোজেন সারের কোন সুলভ ব্যবস্থা না থাকা। বাতাসের প্রায় ৭৮% নাইট্রোজেন গ্যাস হলেও সেখান থেকে জৈব অ্যামোনিয়া তৈরি করা প্রায় অসম্ভবই ছিল।
গত শতাব্দীতে পৃথিবীতে যে জনসংখ্যা-বিষ্ফোরণ হয়েছে, তার প্রায় ৪০%-কে বলা যায় হেবার-বস উদ্ভাবিত নাইট্রোজেন থেকে অ্যামোনিয়া তৈরি করার পদ্ধতির কারণে। কারণ এর ফলে কৃত্রিমভাবে অ্যামোনিয়া সার তৈরি করা গিয়েছে, যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে একটা বড় বিপ্লব ঘটে গিয়েছে, উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। একারণে অনেকে বিংশ-শতাব্দীর সেরা আবিস্কার হিসেবে এই পদ্ধতির নাম করেন (V. Smil, Nature 29(415), 1999) । এর আগে নাইট্রোজেন সারের একমাত্র উৎস ছিলো গুয়ানো বা পাখির মল। জার্মান বিজ্ঞান ফ্রিটজ হ্যাবার এবং কার্ল বস এই প্রক্রিয়াটি উদ্ভাবন করেন। ফ্রিটজ হেবার মূলত একটি রাসায়নিক অনুঘটক আবিষ্কার করেন, যার ফলে নাইট্রোজেন থেকে অ্যামোনিয়া তৈরি করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে কার্ল বসের ভূমিকা ছিল গবেষণাগারের এই প্রক্রিয়াকে শিল্প উৎপাদনের পর্যায়ে বিবর্ধিত করা। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, ফ্রিটজ হেবার ইতিহাসে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। হ্যাঁ, তার আবিষ্কৃত এই পদ্ধতিটি বহু-মানুষের খাদ্য সংস্থান করেছে, অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি হিটলারের পক্ষে কাজ করেছিলেন এবং বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস আবিষ্কার ও প্রয়োগে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এজন্য তার প্রচুর সমালোচনাও রয়েছে।
বিজ্ঞানী মানেই যে মানবতার পক্ষে অগ্রদূত হিসেবে কাজ করবেন এই ধারণাটা আসলে ভুল। কিন্তু হেবার-বসের এই উদ্ভাবনের জন্য তাদের আজও স্মরণ করা হয়। তবে হেবার-বস প্রক্রিয়াটির সমস্যাও আছে। কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার ব্যবহার ইউট্রোফিকেশন এবং পরিবেশ দূষণ ঘটায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন সার খুব একটা সাবধানতার সাথে নিয়ম মেনে কৃষিজমিতে প্রয়োগ করা হয় না। ফলে পানির সাথে ধুয়ে এ নাইট্রোজেন-সমৃদ্ধ রাসায়নিক আশেপাশের বাস্তুসংস্থানে ছড়িয়ে যায়, যা আবার মানব-স্বাস্থ্য ও পরিবেশ-প্রকৃতির জন্য হুমকি-স্বরূপ। কৃত্রিম নাইট্রোজেন সারের ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবহার কমানো তাই এখন আমাদের বর্তমান কৃষি পদ্ধতির জন্য চ্যালেঞ্জ।
অথচ প্রকৃতিতে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে কিছু ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন থেকে অ্যামোনিয়া তৈরি করছে। এই সব ব্যাকটেরিয়াদের ঠিক মতো কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারলে আমরা কৃত্রিম রাসায়নিক সারের ব্যবহার বহুগুণে কমাতে পারব। কিন্তু তার আগে এসব ব্যাকটেরিয়া ঠিক কীভাবে অ্যামোনিয়া সংশ্লেষণ করে, তা ভালোভাবে বোঝাটা জরুরি।
নাইট্রোজেন ফিক্সিং ব্যাকটেরিয়ারা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
আমরা জানি, প্রোটিন মানুষসহ সকল প্রাণীর শরীর-গঠনের জন্য মূল কাঁচামাল। প্রোটিন যে কেবল মাছ-মাংস বা বিভিন্ন প্রাণী থেকে আসে এমন নয়, গাছ থেকেও আমরা প্রোটিন পেতে পারি। যখন আপনি ডাল খান, তখন আপনি মূলত উদ্ভিজ্জ প্রোটিন উপভোগ করছেন। এজন্য ডালকে “গরীবের আমিষ” বলা হয়। শুধু ডাল নয়, মটরশুঁটি, শিমের তরকারি, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, এগুলো সবই উদ্ভিজ্জ আমিষের দারুণ উৎস। এসব গাছ মূলত লিগিউম পরিবারের সদস্য, যেখানে পড জাতীয় অঙ্গের মধ্যে প্রোটিন সমৃদ্ধ ফল বা বীজ থাকে। এসব উদ্ভিদ থেকে আজকাল বার্গারের প্যাটিও তৈরি করা হয়, যা খেতে একদম মাংসের মতো। যারা ভেজিটারিয়ান বা ভেগ্যান ভোজনপ্রণালী অনুসরণ করেন, তাদের অনেকেই হয়তো এই উদ্ভিজ্জ বার্গারের প্যাটি খেয়ে থাকবেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইম্পসিবল বার্গার ও বিয়ন্ড বার্গার, যেগুলো খেলে আসলে বোঝাই যায় না যে এগুলো প্রকৃতপক্ষে মাংস নয়!
আমরা জানি, প্রোটিন মূলত বিশ ধরনের অ্যামিনো এসিড দিয়ে তৈরি। আর অ্যামিনো এসিডের মূল উপাদান হলো অ্যামোনিয়া। যে কোন প্রাণীদেহ থেকে খাদ্য পরিপাকের পর রেচন প্রক্রিয়ায় যে মূত্র তৈরি হয়, তার অন্যতম উপাদান হলো অ্যামোনিয়া। মূত্রে বেশ ঝাঁঝালো একটা গন্ধ থাকে, এটা মূলত অ্যামোনিয়ার জন্যই তৈরি হয়। এর কটু গন্ধের জন্য আমরা অ্যামোনিয়াকে পছন্দ করি না, কিন্তু ঘটনাক্রমে প্রকৃতিতে অ্যামোনিয়া বেশ দামী একটা রাসায়নিক পদার্থ।
পৃথিবীর নাইট্রোজন চক্রের অ্যামোনিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদ্ভিদ বা প্রাণীর কোষ সমূহে বিভিন্ন প্রোটিন ছাড়া কোষগুলো কাজ করতে পারবে না। আর প্রোটিন যেহেতু অ্যামোনিয়া দিয়ে তৈরি বিভিন্ন অ্যামিনো এসিডের মাধ্যমে গঠিত, সেহেতু অ্যামিনো এসিড ছাড়া আসলে জীবজগত অচল। অন্যদিকে অ্যামিনো এসিড তৈরির ক্ষেত্রে এই লিগিউম জাতীয় উদ্ভিদ প্রধান ভূমিকা রাখে।
সমস্যা হলো লিগিউম জাতীয় গাছগুলো কিন্তু নিজে থেকে এসব প্রোটিন বানাতে পারে না। অ্যামোনিয়ার রাসায়নিক সংকতে যদি আমরা খেয়াল করি (NH3), তাহলে দেখবো একটি নাইট্রোজেন তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে সমযোজী বন্ধনে যুক্ত। নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন দুইটি বাতাসে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, নাইট্রোজেন গ্যাসে দুইটি পরমাণু (N2) যেহেতু তিনটি সমযোজী বন্ধনে যুক্ত, সেহেতু এরা ভীষণ নিষ্ক্রিয় ধরণের একটা গ্যাস। বায়ুমন্ডলে যদিও প্রায় 78% নাইট্রোজেন পাওয়া যায়, কিন্তু এই নাইট্রোজেন গ্যাসকে ভাঙ্গা ভীষণ রকমের কঠিন। একমাত্র যখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়, তখন ভীষণ শক্তিতে নাইট্রোজেন গ্যাস ভেঙ্গে ভৌতভাবে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হতে পারে। কিন্তু ভৌতভাবে তৈরি হওয়া অ্যমোনিয়া গ্যাস অপ্রতুল। এতো কম পরিমাণ বিভিন্ন প্রাণী-উদ্ভিদের প্রোটিন চাহিদা পূর্ণ করা সম্ভব না।
তাহলে লিগিউম-জাতীয় গাছগুলো অ্যামোনিয়া পায় কোথা থেকে?
আপনি যদি ঘরের বাইরে গিয়ে কোন সয়াবিন, বাদাম, শিম ইত্যাদি যে কোন লিগিউম গাছ শিকড় সহ তুলে ফেলেন, তাহলে দেখবেন যে এসব গাছের শিকড়ে অজস্র ছোট ছোট গুঁটি আছে, যেন এদের টিউমার হয়েছে। আসলে এই টিউমার স্বরূপ-গুঁটিগুলো একেকটা অ্যামোনিয়া বানানোর কারখানা। এসব গুঁটির যদি আপনি কোন অণুজীববিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে পরীক্ষা করেন, তাহলে দেখবেন গুঁটিগুলো মূলত ব্যাকটেরিয়াতে ভরপুর একটা বস্তু। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো বিশেষ ধরনের, এদেরকে আমরা অণুজীববিজ্ঞানে রাইজোবিয়া বলে ডাকি। এই গুঁটিগুলো আসলে একধরনের চুক্তি-বাস্তবায়নের জায়গা। চুক্তিটা হলো, উদ্ভিদ এই ব্যাকটেরিয়াদের একটা নিরাপদ পরিবেশ দিবে এবং কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ পুষ্টি দিবে। বিনিময়ে এসব ব্যাকটেরিয়া বাতাসে থাকা নাইট্রোজেন অণুকে ভেঙে অ্যামোনিয়ায় পরিণত করে উদ্ভিদকে সরবরাহ করবে। এই গুঁটিগুলোকে কিতাবী ভাষায় বিজ্ঞানীরা নডিউল বলে চেনেন। একেকটা নডিউল এসব ব্যাকটেরিয়াদের এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে দেয়, যেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ খুবই কম থাকে। এর কারণ হলো এই রাইজোবিয়ারা যে এনজাইমের মাধ্যমে নাইট্রোজেন সংশ্লেষণ করে অ্যামোনিয়া তৈরি করে, সেই এনজাইম আবার অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কাজ করতে পারে না।
এই লিগিউম জাতীয় উদ্ভিদের সাথে রাইজোবিয়ার যে পুষ্টি লেনদেনের সম্পর্ক, এটা মিথোজীবিতার একটা জনপ্রিয় উদাহরণ। এই সম্পর্কে দুই পক্ষেরই লাভ হচ্ছে। আমার পিএইচডি গবেষণায় আমি এই লিগিউম-রাইজোবিয়া সিম্বায়োসিস নিয়ে কাজ করেছিলাম। আমার গবেষণার মূল আগ্রহ ছিল এই মিথোজীবি সম্পর্কে যখন অণুজীবরা অংশীদার হয়, তখন তাদের মধ্যে কি প্রতিযোগিতা হতে পারে? বিভিন্ন রাইজোবিয়া যখন মিথোজীবি সম্পর্কে অংশ নেয়, তখন তারা কতটুকু “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা” প্রদর্শন করে পোষক-উদ্ভিদের সাথে? আজ চলুন সে বিষয় নিয়ে একটু গল্প করা যাক।
সমজীবিতা কি?
‘সিম্বায়োসিস’ (symbiosis) শব্দটির বাংলা খুঁজতে গিয়ে মিথোজীবী শব্দটি মাথায় চলে আসে। কিন্তু মিথোজীবিতা মূলত মিউচুয়ালিজম (mutualism) এর বাংলা, যেখানে একটি অংশীদারীত্ব সম্পর্কে অংশগ্রহণকারী দুইটি পক্ষেরই কোন না কোন উপকার হয়। সিম্বায়োসিস বলতেও দুইটা জীবের মধ্যে একটা অংশীদারীত্ব সম্পর্ক বোঝায়, কিন্তু সেই সম্পর্ক যে সব সময়েই উভয়পক্ষের জন্য ভালো হবে এমন কিন্তু নয়। বরং হতে পারে একপক্ষের জন্য ভালো, অন্যপক্ষের কিছু যায় আসে না (অনোন্যজীবিতা, commensalism)। কিংবা কোন পক্ষেরই কিছু যায় আসে না, তারা কেবল সহাবস্থান করছে। কিংবা এক পক্ষের জন্য খারাপ, অন্য পক্ষের জন্য ভালো (পরজীবিতা, parasitism)। সিম্বায়োসিসকে বাংলায় আমরা সমজীবিতা বলতে পারি। অর্থাৎ সমজীবিতা বলতে একটি সাধারণ দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্ক বোঝায়। মিথোজীবিতা, পরজীবিতা, অনোন্যজীবিতা মূলত সমজীবিতারই সুনির্দিষ্ট উদাহরণ যেখানে কোন পক্ষের লাভ হচ্ছে, কোন পক্ষের ক্ষতি হচ্ছে কিংবা উভয় পক্ষের লাভ হচ্ছে সেগুলো সংজ্ঞায়িত করা হয়।
সমজীবিতায় প্রতিযোগিতা
রাসায়নিক নাইট্রোজেন সার সমস্যায় ফেরত যাওয়া যাক। আমাদের কৃষিকাজে নাইট্রোজেন সার দরকার, কিন্তু রাসায়নিক নাইট্রোজেন সার পরিবেশ দূষণ করে। এটা এক ধরণের শাঁখের করাত, যার সমাধানের জন্য অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। আর এই সমস্যাটি বহুমাত্রিক, অর্থাৎ এখানে অনেকগুলো বিষয় সংশ্লিষ্ট আছে। তাই অনেকগুলো পদ্ধতি মিলিয়ে সমাধান করতে হবে। একটা উপায় হলো, অন্তত লিগিউম জাতীয় উদ্ভিদের উৎপাদনের জন্য কৃষিক্ষেত্রে যদি নাইট্রোজেন সার দেওয়া না হয়, কিংবা কম সার দেওয়া হয়, তাহলেও রাসায়নিক সার ব্যবহার অনেকটুকুই কমানো যায়, দূষণও অনেকাংশে কম হয়।
এজন্য গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করলেন ল্যাবে এমন কোন রাইজোবিয়া বানানো যায় কি না, যারা নাইট্রোজেন সংশ্লেষণের বেশ পটু। গবেষনাগারে তারা বেশ সফলও হলেন, কিছু রাইজোবিয়ার স্ট্রেইন তৈরি করা গেল যারা পোষক উদ্ভিদকে ব্যাপক হারে নাইট্রোজেন সংশ্লেষণ করে দেয়। এসব উদ্ভিদকে বাইরে থেকে নাইট্রেজেন সার না দিলেও তারা বেশ ভালো করলো। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী হয়ে উঠলেন যে এসব রাইজোবিয়াকে বায়োইনোকুল্যান্ট হিসেবে রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
বিপত্তি হলো যখন এই ল্যাবে তৈরি করা ‘সুপার রাইজোবিয়া’কে যখন ফসলের ক্ষেতে প্রয়োগ করা হলো। তখন কিছু মিশ্র ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, ল্যাবে বানানো এই সুপার রাইজোবিয়া আসল জায়গায় গিয়ে আর তেমন কাজ করতে পারে না। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, ফসলি-ক্ষেতের মাঠে ইতোমধ্যে থাকা বুনো রাইজোবিয়ারা নাইট্রোজেন থেকে অ্যামোনিয়া সংশ্লেষণে খুব একটা দক্ষ না হলেও এরা অন্যান্য রাইজোবিয়ার সাথে প্রতিযোগিতা করে গাছের শেকড়ে নডিউল তৈরি করার ব্যপারে ওস্তাদ। যে কারণে বায়োইনোকুল্যান্ট হিসেবে প্রয়োগ করা সুপার রাইজোবিয়া এদের সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠে না, কিংবা ল্যাবে পরীক্ষিত রাইজোবিয়ারা নডিউল তৈরি করলেও অন্যান্য বুনো রাইজোবিয়ারও ভালো সংখ্যক নডিউল তৈরি করে। এই প্রতিযোগিতার ফলে দিনের শেষ সমজীবিতা থেকে পোষক গাছের প্রাপ্ত পুষ্টি খুব একটা উল্লেখযোগ্য হয় না।
এই বিষয়টা বিজ্ঞানীদের একটা বড়সড় খটকায় ফেলে দিলো।
পোষকের নিয়ন্ত্রণ
বুনো রাইজোবিয়ারা ল্যাবে তৈরি বহগুণ বেশি নাইট্রোজেন সংশ্লেষণে সক্ষম সুপার রাইজোবিয়াকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেয়াটা বিস্ময়কর। কারন সেটা আপাতদৃষ্টিতে ডারউইনীয় বিবর্তনের (বা ধ্রুপদী বিবর্তন তত্ত্ব) পূর্বাভাস অনুসরণ করে না। ধ্রুপদী বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী, পোষক সেইসব রাইজোবিয়াকে সমজীবিতায় সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করবে, যারা কিনা সবচেয়ে বেশি নাইট্রোজেন ফিক্সেশন করে। কিন্তু ফসলী মাঠে এটা দেখা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই মাঝারী বা নিম্নমানের বুনো রাইজোবিয়ারা প্রতিযোগিতায় সুপার রাইজোবিয়াদের হটিয়ে দেয়। কিন্তু কেন এটা হবে?
পোষক উদ্ভিদ কিন্তু সব রাইজোবিয়াকে শিকড়ে নডিউল তৈরির অনুমতি দেয় না। এখানে বেশ জটিল এবং বিস্তৃত রাসায়নিক অণু বিনিময় হয়। পোষক যাচাই করার চেষ্টা করে যে, যেই রাইজোবিয়া নডিউল তৈরি করবে, সে আসলেই নাইট্রোজেন ফিক্সেশন করতে পারে কি না। কেননা এই নডিউল তৈরি ও সেখানে নিয়মিত শর্করা সমৃদ্ধ পুষ্টি দেওয়া পোষক উদ্ভিদের জন্য একটা বড় বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনার মতোই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ উদ্ভিদের জন্য প্রতিটি শর্করাকণাই বেশ দামী। যদি কোন রাইজোবিয়া নডিউল তৈরি করে কেবল সুবিধাই নেয়, কিন্তু কোন নাইট্রোজেন ফিক্সেশন না করে, তাহলে পোষক উদ্ভিদ বড়সড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
এই ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্যে পোষক উদ্ভিদ মোটা দাগে দুইটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে। প্রথমত, যে রাইজোবিয়া নাইট্রোজেন ফিক্সেশনের জন্য পোষকের সাথে সাশঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাদের নডিউল তৈরিতে বাধা দেওয়া। এটাকে বলে ‘সঙ্গী নির্বাচন বা পার্টনার চয়েস’। সমস্যা হলো, পোষক উদ্ভিদ প্রথম ধাপের ‘সঙ্গী নির্বাচন’-এর সময় কিন্তু জানে না যে আসলেই এই রাইজোবিয়াটি নাইট্রোজেন ফিক্সেশনের জন্য কতোটা উপযুক্ত হবে। এমনও হতে পারে রাইজোবিয়াটি প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সংকেত দিচ্ছে, কিন্তু নডিউল তৈরির পর আসলে সে খুব বেশি নাইট্রোজেন সংশ্লেষণ করবে না।
অন্যদিকে, নডিউল তৈরি করার পরেও যদি কোন রাইজোবিয়া নাইট্রোজেন ফিক্সেশন না করে, তাহলে পোষক উদ্ভিদ ওই নডিউলে পুষ্টি প্রবাহ কমিয়ে বা বন্ধ করে দিতে পারে। এটাকে বলা যায় এক ধরণে শাস্তি, বা পোষকের নিয়ন্ত্রণ।
কিন্তু দিন শেষে এই নিয়ন্ত্রণও যে অনেক কার্যকর, এমন নয়। জীববিজ্ঞানে যে কোন প্রাণী বা উদ্ভিদেরই একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, যে কোন বৈশিষ্ট্যের (ফেনোটাইপ) প্রকাশে প্রাকৃতিক প্রকরণ (variation) থাকবেই । অর্থাৎ ওই বৈশিষ্ট্য একই প্রজাতির উদ্ভিদ/প্রাণির ভিন্ন ভিন্ন একক-ব্যক্তিতে অনেক ধরনের মান পাওয়া যাবে। এ কারণে পোষক উদ্ভিদের সুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলেও সেটার কঠোরতায় পরিস্থিতি ও প্রজাতিভেদে ভিন্নতা দেখা দেবে।
খটকার উত্তর
উল্লিখিত বিবর্তনীয় খটকার একটা উত্তর গত কয়েক বছরে পরিস্কারভাবে বোঝা গেছে। আমরা এখন জানি, রাইজোবিয়ারা উদ্ভিদ-পোষকের জন্য কতটুকু পরিমাণ নাইট্রোজেন ফিক্সেশন করবে, এটা উদ্ভিদ প্রজাতি ভেদে বদলায়। আমরা এটাও জানি, নাইট্রোজেন ফিক্সেশনের কর্মদক্ষতা আর নডিউল-তৈরির সামর্থ্য দুইটি একদম ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্য দুইটি স্বাধীন মেন্ডেলিয়-বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিন্তা করা যায়, যারা বিবর্তনের খেলায় পৃথকভাবে নির্বাচিত হয়।
আমার করা গবেষণায় দেখা গেছে, দুইটি আলাদা রাইজোবিয়া যারা পৃথকভাবে পোষক উদ্ভিদের সাথে সমজীবি সম্পর্ক তৈরি করলে অনেক ‘সুবিধা’ দেয়, অর্থাৎ ভালো পরিমাণে নাইট্রোজেন ফিক্সেশন করে। অথচ এদেরকে একসাথে পোষক-উদ্ভিদে নডিউল তৈরি করতে দিলে দেখা যায় এরা সেই সুবিধার পরিমাণ অনেক কমিয়ে দেয়। এটা খানিকটা তুলনা করা যায় অর্থনীতির ‘ট্রাজেডি অব কমনস’ কিংবা ‘সরকারি-মাল, দরিয়াতে ঢাল’ মেটাফোরের সাথে। ট্রাজেডি অব কমনস বলে, যখন কোন সম্পদ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখন সেটার ব্যবহারকারীরা অযত্নে সেটাকে অতিব্যবহার করে ধ্বংস করে দেয়। দুইটি ‘ভালো’ রাইজোবিয়ার প্রতিযোগিতাতেও অনেকটা এ ধরণের ঘটনাই ঘটছে, তারা একা একা পোষকের জন্যে সর্বোচ্চ দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু যখনই তারা টের পাচ্ছে যে এই সমজীবি সম্পর্কে অন্য রাইজোবিয়া প্রতিযোগি হিসেবে আছে, তারা তখন যতটুকু নাইট্রোজেন ফিক্সেশন না করলেই না, ততটুকুই পোষককে দিচ্ছে।
আপাতত এই লেখাটা এখানেই শেষ করে দিচ্ছি। আমরা মূলত লিগিউম-উদ্ভিদ ও রাইজোবিয়া-ব্যাকটেরিয়া সমজীবিতার সাথে পরিচিত হলাম। এই চমৎকার সমজীবি প্রক্রিয়ার মধ্যে যেসব রহস্য নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে ধাঁধা আছে, তার সাথে পরিচিত হলাম। পরে কোন এক সময় আমরা দেখবো কিভাবে একাধিক ‘ভালো’ রাইজোবিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়, সে বিষয়ক আমার গবেষণার বিস্তারিত।
এই লেখার ফিচার ছবিতে দেখানো হচ্ছে মেডিকাগো গাছের নডিউলের মাইক্রোস্কপি। এখানে রাইজোবিয়াকে সবুজ রঙে দেখানো হচ্ছে। নডিউলকে নীল রঙে দেখানো হচ্ছে।(Photograph courtesy U. Mathesius)
আরো জানতে পড়ুন:
- এ বিষয়ে আমার গবেষণাপত্র: Rahman, Arafat, et al. “Competitive interference among rhizobia reduces benefits to hosts.” Current Biology 33.14 (2023): 2988-3001. https://doi.org/10.1016/j.cub.2023.06.081
- Study improves understanding of how bacteria benefit plant growth, phys.org
- Smil, Vaclav. Detonator of the population explosion. Nature 400, 415 (1999). https://doi.org/10.1038/22672
মূল লেখাটি বিজ্ঞান পত্রিকা ট্যকিয়নে প্রকাশিত। অর্ডার করতে পারেন এখান থেকে অর্ডারের নিয়ম।
Leave a Reply