একটা জীব একসময় বদলে দিয়েছিলো গোটা দুনিয়ার চেহারা। পৃথিবীর বুকে প্রাণের প্রথম গণবিলুপ্তি এদের কারণেই ঘটে,আবার এরাই প্রশস্ত করে দেয় জটিল জীবন উদ্ভবের রাস্তা। কীভাবে? পরিবেশে প্রথমবারের মতো অক্সিজেন অণু মুক্ত করে। বলছি এককোষী সায়ানোব্যাকটেরিয়ার কথা। নেই নিউক্লিয়াস এবং আরো বেশিরভাগ সুপরিচিত কোষ-অঙ্গাণুই; কিন্তু অতি সরল এই জীবটির গল্প পৃথিবীতে প্রাণের ইতিহাসের এক বড়ো অধ্যায় দখল করে আছে। এরা এক জ্বলন্ত নিদর্শন—’গুরুত্বপূর্ণ’ হতে ঠিক ‘জটিল’ হওয়ার প্রয়োজন নেই!
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সবসময় আজকের মতো যথেষ্ট অক্সিজেন ছিলো না। প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগে,বায়ুমণ্ডলে ছিলো কেবল নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেন। অক্সিজেনের পুরোটাই আবদ্ধ ছিলো পানিতে, মোটেই বাতাসে ভাসমান নয়। এই পরিবেশকে বিজারণধর্মী গণ্য করা হয়। ভূপৃষ্ঠের মাত্র ২-৩% ছিলো তখন শুকনো ভূমি,আর বাকি সমস্তটুকু সমুদ্র। প্রচুর ফেরাস আয়রনের (Fe+2) উপস্থিতির কারণে সেই সমুদ্রের রঙ ছিলো সম্ভবত সবুজ। সমুদ্রে তখন বাস করতো সরলতম অবায়বীয় প্রাণ। সরল, এককোষী এসব অণুজীব অক্সিজেন ছাড়াই নিজেদের জীবনধারণের ব্যবস্থা করতো। এরা ছিলো ‘কেমোট্রফ’(Chemotroph)। অর্থাৎ সমুদ্রে বিদ্যমান খনিজ উপাদান দিয়েই তাদের পুষ্টিসাধন হতো।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন মোটামুটি আড়াই থেকে সাড়ে তিন বিলিয়ন বছরের মাঝামাঝি একটা সময়ে এই অণুজীবদের একটি দল সালোকসংশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন করে। তাদের কোষঝিল্লিতে কিছু বিশেষ গঠন বিকশিত হয়,যা সূর্যের আলোকশক্তিকে ব্যবহার করে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং পানির জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া করে শক্তি-সঞ্চয়ী জৈব অণু তৈরি করতে পারে। এই প্রক্রিয়ারই উপজাত হিশেবে তৈরি হয় অক্সিজেন। এরাই আজকের সায়ানোব্যাকটেরিয়ার পূর্বপুরুষ। সূর্যালোক-শোষণকারী নীলাভ-সবুজ পিগমেন্টের উপস্থিতির কারণে এদের বর্ণ ছিলো নীলাভ। সালোকসংশ্লেষণের ক্ষমতা এই আদিম ব্যাকটেরিয়াগোষ্ঠীকে অন্যান্য জীবাণুদের চেয়ে অনেকদূর এগিয়ে দিলো। প্রায় অসীম উৎসের কাঁচামাল ব্যবহার করে তারা নিজেদের খাদ্য তৈরি করতে লাগলো,ঘটলো জনসংখ্যার বিস্ফোরণ। তখন ঘটলো আরেক মজার ঘটনা।
সালোকসংশ্লেষণের উপজাত মুক্ত অক্সিজেন সমুদ্র থেকে ছড়িয়ে যেতে শুরু করলো বাইরেও। এই অক্সিজেন প্রথমে বিক্রিয়া করলো সমুদ্রে থাকা ফেরাস যৌগের সাথে, তৈরি হলো লালচে ফেরিক যৌগ। এভাবে কয়েক মিলিয়ন বছর চলার পর দেখা গেলো যতটুকু অক্সিজেন বিক্রিয়া করছে বা শোষিত হচ্ছে,তার চেয়ে বেশি অক্সিজেন তৈরি হচ্ছে সমুদ্র থেকে। উদ্বৃত্ত অক্সিজেন জমা হতে থাকলো বায়ুমণ্ডলে। ভূতত্ত্ববিদেরা এই ঘটনাকে বলেছেন মহা অক্সিজেনায়ন পর্ব (The Great Oxygenation Event)। কেউ কেউ আবার একে চিহ্নিত করেছেন ‘অক্সিজেন বিপর্যয়’(The Oxygen Catastrophe) হিশেবে, কারণ অবায়বীয় জীবদের জন্য এটা ছিল এক মারাত্মক দুঃসংবাদ। অক্সিজেন একটা ভীষণ জারক গ্যাস এবং বিষাক্তও। জলবায়ু এবং বায়ুমণ্ডলীয় রসায়নের নিদারুণ পরিবর্তনের ফলস্বরূপ প্রায় ২.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী সাক্ষী হয় প্রথম গণবিলুপ্তি’র। সায়ানোব্যাকটেরিয়ারাও এই বিপদ থেকে রক্ষা পায় নি। উপযুক্ত জীবাশ্ম-প্রমাণ না থাকায় কারা সেসময় ছিলো,কারাই বা লোপ পেলো চিরতরে সেসব জানা দুষ্কর।
এখানেই শেষ নয়। প্রাগৈতিহাসিক বায়ুমণ্ডলে মিথেন শক্তিশালী গ্রিন হাউজ গ্যাস হিশেবে পৃথিবীকে উষ্ণ রাখছিলো। কিন্তু এখন অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে এই মিথেন রূপান্তরিত হলো কার্বন ডাইঅক্সাইডে। কার্বন ডাইঅক্সাইডের গ্রিন হাউজ ক্রিয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল,যার দরুন পৃথিবীর তাপমাত্রা গেলো ভীষণ কমে! পৃথিবী প্রবেশ করলো ইতিহাসের প্রথম এবং সম্ভবত দীর্ঘতম বরফযুগে,যাকে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন হুরোনীয় বরফযুগ (The Huronian Glaciation/The Huronian Ice Age)। প্রায় তিনশো মিলিয়ন বছর জুড়ে পৃথিবী ছিল একটা আস্ত বরফের গোলা।
জীবনের অভিব্যক্তি অবশ্য থেমে থাকে নি। বিবর্তন ঘটলো নতুন ধরনের জীবের,যারা অক্সিজেন ব্যবহার করে নিজেদের বিপাক ক্রিয়া সম্পাদন করতে লাগলো। এদের ব্যবহারে অতিরিক্ত অক্সিজেন কমতে শুরু করলো; বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনে পৌঁছোলো আজকের সাম্যাবস্থায়(যে ২১% আমরা আজও দেখি)। পৃথিবীকে ঘিরে তৈরি হলো ওজোন গ্যাসের স্তর। সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির প্রবেশ বাধা পেলো তাতে। নতুন ধরনের বায়বীয় বিপাকে অনেক বেশি শক্তি তৈরি হতে লাগলো। বৈচিত্র্যময় প্রাণের বিকাশ ঘটলো এসময়। এখানেও সায়ানোব্যাকটেরিয়া’র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রাগিতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণে আরেক বড় অণুজীব একটা সায়ানোব্যাকটেরিয়াকে গ্রাস করে ফেলে; কিন্তু হজম হয়ে যাওয়ার বদলে সেটি পরিণত হয় অন্তঃমিথোজীবী’তে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘এন্ডোসিম্বায়োসিস’। এভাবে ঐ বড় কোষটি নিজের ভেতর পুরোদস্তুর সালোকসংশ্লেষণের এক কারখানা পেয়ে গেলো। এই কোষটিই আধুনিক উদ্ভিদকোষের পূর্বপুরুষ বলে মনে করা হয়,আর ওই গ্রাসকৃত সায়ানোব্যাকটেরিয়া নিজের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে পরিণত হয় ক্লোরোপ্লাস্টে।
এই প্রাগৈতিহাসিক মহাকাব্যের সম্পূর্ণ রহস্য-উন্মোচন করতে বিজ্ঞানীরা বেশ হিমশিম খেয়ে থাকেন। ধ্বংস ও সৃষ্টির এই দ্বন্দ্বমুখর গল্পের সূত্র বিজ্ঞানীরা খোঁজার চেষ্টা করেন ভূতাত্ত্বিক এবং জীববৈজ্ঞানিক উৎসে, যেমন পাথরের গায়ে স্তরীভূত আয়রনের আইসোটোপ পরীক্ষা কিংবা সায়ানোব্যাকটেরিয়ার জিনোম-গবেষণা। তবে জীবনের ইতিহাসের এই মহাপর্বকে বোঝায় বেশ কিছু ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা সে-কথা নিঃসংকোচেই স্বীকার করে থাকেন। যেমন অবায়বীয় অণুজীবদের নিয়ে প্রকাশিত একটি গবেষণা-প্রবন্ধ শুরুই হচ্ছে এই কৌতুককর স্বীকারোক্তি দিয়ে:
“পুরাকালের অণুজীবদের বিবর্তন নিয়ে লিখতে বসা যারপরনাই চ্যালেঞ্জিং তারপরও যে আমরা এই কাজ করতে সম্মত হয়েছি,সম্ভবত সেটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হলো না…”
(Early Microbial Evolution: The Age of Anaerobes,William F. Martin and Filipa L. Sousa)
সায়ানোব্যাকটেরিয়া কিন্তু এখনো বহালত তবিয়তে টিকে আছে, পৃথিবীর প্রায় সবধরনের পরিবেশেই: সাগর, মিঠাপানি, মাটি, মেরুরবফ এমনকি শ্লথের লোমেও! এখনো বায়ুমণ্ডলের বেশিরভাগ অক্সিজেনের যোগানদাতা তারাই। কেউ কেউ আবার নাইট্রোজেন সংবন্ধন (Nitrogen fixation) করে মাটির উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে। আজকে আমরা সসম্ভ্রমে বলতেই পারি এদের ছাড়া পৃথিবীতে জটিল এবং আধুনিক প্রাণের বিকাশ সম্ভব ছিলো না; আবার একটু ঠাট্টা করেও বলা চলে, আরেকটু হলেই দিয়েছিলো দুনিয়াটাকে প্রাণহীন করে!
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply