আপনি সমাবেশে গেলেন। সমাজকে আবর্জনামুক্ত করতে সংগ্রাম করছেন, মিছিল করছেন, কিন্তু এই বিশাল যাত্রায় কীভাবে স্বাস্থ্যকে ঠিক রেখে এগিয়ে যেতে হবে, অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে কী কী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, সেগুলো যদি জানা না থাকে, তবে কিন্তু শরীর আর মন দুটোকেই মাশুল দিতে হবে। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন মানবাধিকার সংঘটন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে একারণে এই বিষয়টা গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। কিন্তু আমরা বাংলাদেশীরা কেন পিছিয়ে থাকব? চলুন, আমরাও জেনে নিই যে মিছিল-সমাবেশে কীভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রাখা যায়।
কী কী থাকবে, থাকবে না?
মিছিল বা আন্দোলনে গিয়ে অনেকেই পানিশূন্যতায় ভোগেন, কেউ বা ধুলোবালির মধ্যে পড়ে অ্যালার্জিতে কষ্ট পান। এছাড়াও রয়েছে আরও অনেক ধরণের ক্ষতির আশঙ্কা। এমন পরিস্থিতিতে আপনাকে প্রথমেই পানি, মাস্ক, সানগ্লাস আর টিস্যু সাথে রাখতে হবে। দেহের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা, রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং টিয়ার গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পানির বিকল্প নেই। মাস্ক, ক্যাপ আর সানগ্লাস বেশ কিছু কারণে দরকার। যেমন ধরুন, রাস্তার ধুলো খাওয়া থেকে বাঁচতে পারবেন, রোদের তীব্র অত্যাচার থেকেও কিছুটা রেহাই পাওয়া যাবে এবং টিয়ার গ্যাসের প্রভাবও খানিকটা এড়ানো যাবে।
ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের একটি নির্দেশনা বলছে যে সম্ভব হলে সাথে সামান্য খাবার (জলপানীয়) এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখাও ভালো। দীর্ঘ সময় খাবার ছাড়া থাকলে যাদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে, তাদের জন্য এটা অত্যাবশ্যকীয় হলো কিছু খাবার সাথে রাখা। আবার কোনো জায়গায় ক্ষত হলে কিংবা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা সুনিশ্চিত করতে হলে এন্টিব্যাকটেরিয়াল ক্রিম এবং স্যানিটাইজারের বিকল্প নেই। এছাড়াও আত্মরক্ষা কিংবা চলাচলের সুবিধার জন্য পা থেকে কোমড় পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের লাঠি সাথে রাখতে পারেন।
পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও কিছু বিষয় খেয়াল করা দরকার। যেমনঃ টিয়ার গ্যাস বা পিপার স্প্রের মতো রাসায়নিক এজেন্ট থেকে আপনার ত্বককে রক্ষা করতে হলে লম্বা হাতার জামা বা ফুল প্যান্ট পরা সুবিধাজনক। এছাড়াও আরামদায়ক এবং প্রতিরক্ষামূলক জুতা পরতে হবে, যাতে করে একদিকে কোনো আঘাত থেকে পা দুটোকে রক্ষা করা যায়, অন্যদিকে রক্ত সঞ্চালনও ঠিক থাকে। এক্ষেত্রে সাধারণ স্যান্ডেল বা ফ্লিপ-ফ্লপ ধরণের জুতা না পরে কেটস বা সাধারণ সু পরিধান করা ভালো। ভুল জুতা নিয়ে মিছিলে অনেক পথ হাঁটার প্রভাবে পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা হওয়া থেকে শুরু করে গোড়ালি ফুলে পর্যন্ত যেতে পারে।
আর আন্দোলনে আসতে গেলে অবশ্যই অলংকার এবং প্রসাধনী সামগ্রী বাদ দেওয়া উচিৎ। কারণ অনাকাঙ্খিত অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে অলংকারের সাথে কোনো কিছু বেঁধে গিয়ে অথবা দেহে ফুটে গিয়ে আঘাত লাগতে পারে। এটি নিজের এবং অন্যদের-উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। আর প্রসাধনী ব্যবহার করলে টিয়ার গ্যাস বা অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের ক্রিয়া বেশি কার্যকর হয়, ফলে দ্রুত ত্বকে জালাপোড়া শুরু হয়ে যেতে পারে। একই কারণে কন্ট্যাক্ট লেন্স পরেও মিছিল-সমাবেশে যাওয়া উচিৎ নয়। এছাড়াও সাথে মাদকদ্রব্য না রাখাই উত্তম বলে অনেকে মনে করেন।
আন্দোলনের সময়
এই অংশটা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বহু মানুষ দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন বা মিছিলে পানিশূন্যতায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। আশঙ্কা থাকে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার বা হিট স্ট্রোক হওয়ার। তাই সময়ের ব্যবধানে প্রয়োজনমতো স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি পান করুন। সম্ভব হলে ঘন ঘন মুখ ধুয়ে ফেলুন এবং হালকা করে গলা-ঘাড় মুছে রাখুন। কিন্তু সরাসরি মাথায় পানি ঢালবেন না। এতে করে মস্তিষ্কের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে স্ট্রোক বা রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে ব্রেইন হেমোরেজ বা ইন্ট্রাক্রানিয়াল হেমাটোমা হতে পারে।
মিছিলে হুলস্থূল না বাঁধিয়ে শৃঙ্খলার সাথে এগোতে হবে। তা না হলে অনেক সময় আন্দোলনকারীদের ধাক্কাধাক্কিতে বড়সড় আঘাত লাগতে পারে। যদি কোনো ধরণের আঘাত বা গুলি লেগে রক্তপাত শুরু হয়, তাহলে দেরি না করেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অবলম্বন করতে হবে। যেমনঃ ক্ষত স্থান কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলা, আঘাতের স্থানে সরাসরি স্প্রিট ব্যবহার না করা, অবস্থা বেগতিক হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আহত ব্যক্তির গ্রুপ অনুসারে রক্ত প্রদান করা (রক্তের গ্রুপ জানা না থাকলে বা নির্ণয় করার মতো যথেষ্ট সময় না থাকলে ও-নেগেটিভ রক্ত সরবরাহ করা) ইত্যাদি।
এছাড়াও আরেকটি বিষয় সতর্কতার সাথে খেয়াল করতে হবে। যখন ধমনি কেটে রক্ত বের হয়, তখন লাল রঙের রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে। তাই এরকম কিছু দেখলে দ্রুত সেই স্থান চেপে ধরে বা কাপড় দিয়ে বেঁধে অন্য কিছুর অপেক্ষা না করে সরাসরি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। নতুন যেকোনো মুহূর্তে রোগী মারাও যেতে পারে। তাছাড়াও টিয়ার গ্যাস যদি ছড়িয়ে পড়ে, তবে দৌড়াদৌড়ি না করে বা অস্থির না হয়ে স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করুন, যদি চোখ জ্বলে বা ঝাপসা হয়ে যায়, তাহলে দ্রুত ১০-১৫ মিনিটের জন্য চোখ পানি দিয়ে ক্রমাগত ধুতে থাকুন এবং পোশাকে লাগা টিয়ার গ্যাস বা পাউডার তৎক্ষণাৎ না ধুয়ে পরে শুকায়ে গেলে পুরো ধুয়ে ফেলতে হবে, যাতে করে পরবর্তীতে সেটি কারও দেহে প্রভাব ফেলতে না পারে।
মাঠ ছাড়ার পরে
যদি আপনি আহত হন, তবে আঘাতের স্থানে অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম ব্যবহার করুন। গায়ে ব্যাথা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ঔষধ সেবন করুন। প্রয়োজন অনুসারে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বা ইনজুরি টেপ লাগাতে হবে। এছাড়াও প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লে ফলের জুস বা সাধারণ শরবত পান করুন। আগেই বলেছি যে টিয়ার গ্যাস বা পাউডার পোশাকে লাগলে সেটা ধুয়ে ফেলতে হবে। এছাড়াও জামা-কাপড়ে অন্য কোনো রাসায়নিক পদার্থ লেগে থাকলে বাসায় গিয়ে সেটাও দ্রুত ধুয়ে ফেলতে হবে। আর না ধুয়ে সেই পোশাক পুনরায় পরা অনুচিৎ। কারণ এতে করে অ্যালার্জি থেকে শুরু করে ত্বকের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।
এছাড়াও ঠিকমতো গোসল করতে হবে, যাতে করে জীবাণুর সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পারেন। এরপর ঘুমের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে ব্যাথা নিরসন, মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন ক্ষরণ এবং রক্ত চলাচল স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে পারে। তাছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে। আন্দোলন বা মিছিলের কোনো ঘটনা বা সহিংস ঘটনা যাতে মানসিকভাবে আপনাকে দুর্বল না করে দেয়, সে দিকে নজর রাখতে হবে।
শেষ কথা
সামাজিক আন্দোলন বা রাষ্ট্র সংস্কারের লড়াই স্বভাবতই কঠিন হয়। এক্ষেত্রে মনোবল নিয়ে নিজের শরীরকে ঠিক রেখে এগিয়ে যাওয়াটা সবচেয়ে জরুরি। আপনি যদি আপনার আত্মরক্ষার ব্যাপারে সচেতন না থাকেন, তবে এর প্রভাব একদিকে যেমন আপনার শরীরের উপর পড়বে, তেমনি আন্দোলনকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তাই সর্বোপরি সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন এবং নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিশেষভাবে নজর রাখুন।
তথ্যসূত্র
১. Safety Tips for Protesters
২. What Is Hemorrhage?
৩. How to stay safe during a protest
৪. How to Protest Safely
৫. How to Take Care of Your Body After a Day of Protesting
Leave a Reply