কগনিটিভ ডিজোনেন্স: মানুষ কেনো সহজে তার মত বদলায় না

লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

“A man with a conviction is a hard man to change. Tell him you disagree and he turns away. Show him facts and he questions your sources. Appeal to logic and he fails to see your point.”

~Leon Festinger

১৯৫০’র দশকে যুক্তরাষ্ট্রের এক কাল্ট-দল প্রচার করেছিলো চার বছর পর,মানে ১৯৫৪ সনের ২১শে ডিসেম্বর হবে পৃথিবীর শেষ দিন। এক মারাত্মক বন্যায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এই দলের সদস্যরা এতোটাই আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে তাদের অনেকে নিজ নিজ চাকরিও ছেড়ে দেন এবং নিজেদের সম্পদ’ও বিলিয়ে দেন। কিন্তু.. পৃথিবীর কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই চার বছর পর ২১শে ডিসেম্বর পার হয়ে ২২শে ডিসেম্বর এলো। কাল্টের সদস্যদের মধ্যে দেখা গেলো দ্বিধা এবং অসন্তোষ। কাল্ট-প্রধান বললেন, দুনিয়াকে বাঁচানো গেছে কেবল সদস্যদের সম্মিলিত ‘শুভশক্তি’র জোরে। এই অদ্ভুত, হেঁয়ালিপূর্ণ কৈফিয়তের পরেও বহু মানুষ প্রধানের কথা মেনে নিলো।

এই দলের সদস্যদের ওপর কাজ করেন তিনজন সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক (Social Psychologist) । তারা শনাক্ত করেন মোটাদাগে তিনটি কারণে সদস্যরা কাল্টের চরম ব্যর্থতা সত্ত্বেও সেখান থেকে বের হতে পারেন নি। যেমন:

  • কাল্ট-সদস্য হিশেবে এমন বহু বিশ্বাস ও অভ্যাস তারা আত্মস্থ করেছিলেন যা তার দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছিলো;
  • ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক তারা ইতোমধ্যেই এমনসব কাজ করেছিলেন যেগুলো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়;
  • দলভুক্ত বাকিদের কাজ থেকে তারা বিপুল সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন পাচ্ছিলেন।

তিনজন মনস্তাত্ত্বিকের একজন, লিওন ফেস্টিঙ্গার, ২১শে ডিসেম্বর পরবর্তী সময়ে কাল্ট-সদস্যদের মানসিক দ্বন্দ্বকে বর্ণনা করতে ১৯৫৭ সাল নাগাদ একটি নতুন প্রত্যয় হাজির করেন: কগনিটিভ ডিজোনেন্স। মনস্তত্ত্ববিদ্যায় এ এক বিরাট গবেষণার ক্ষেত্র। জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে আপনারও এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। বোঝা কঠিন নয় এহেন পরিস্থিতি একধরনের মানসিক পীড়া এবং চাপ তৈরি করে।

কগনিটিভ ডিজোনেন্স কোনো চিকিৎসাযোগ্য মানসিক সমস্যা না। বরং এটা একধরনের অস্বস্তিকর মানসিক অবস্থা। পারস্পরিক অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য বা চিন্তা যখন আপনি ধারণ করেন বা আচরণ করেন তখন এর উদ্ভব হয়। মানুষের মন তার ধারণকৃত যাবতীয় তথ্য-জ্ঞান-ধারণা এসবের সুসঙ্গতি (consistency) চায়। কেউ যদি এমন কোনো নতুন তথ্য বা ধারণার সম্মুখীন হন যা তার বহুদিনের লালিত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে,তখন তার মধ্যে কগনিটিভ ডিজোনেন্স তৈরি হতে পারে। একই ঘটনা ঘটতে পারে কেউ যদি আবিষ্কার করে তার কোনো আচরণ তার আত্মপরিচয়, দর্শন বা আদর্শকে লঙ্ঘন করছে। অস্বস্তির চরম রূপ দেখা যেতে পারে যখন ব্যক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিশ্বাস বা তার নিত্য আচরণের ভিত্তি নতুন কোনো ঘটনা বা তথ্যপ্রাপ্তির ফলে নড়বড়ে হয়ে যায়।

আমেরিকান মনস্তাত্ত্বিক লিওন ফেস্টিঙ্গার

ধরা যাক, কেউ হয়তো নিজেকে অত্যন্ত যুক্তিবাদী, কুসংস্কারমুক্ত ব্যক্তি মনে করেন। কিন্তু কোনো মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা বা পারস্পরিক আলোচনার পর দেখা গেলো তার মধ্যেও কিছু সংস্কার,পক্ষপাত এবং বিশ্বাসগত ঝোঁক (bias) আছে। তখন ওই ব্যক্তি কগনিটিভ ডিজোনেন্স বোধ করতে পারেন। কগনিটিভ ডিজোনেন্সের অস্বস্তি বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হতে পারে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে ডিজিটাল প্রক্রিয়াতেও এই অনুভূতি শনাক্ত করা যায়। যেমন মস্তিষ্কের যে অংশ আমাদের চিন্তায় এবং কাজে ভুলচুক দেখে থাকে, যে অংশ যুক্তি-বুদ্ধির প্রয়োগের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং যে অংশ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে তারও কিছু কিছু অংশ।

মস্তিষ্কের কোন অংশে অস্বস্তির ছাপ ফুটে ওঠে তা দিয়ে অবশ্য অস্বস্তির উপশম হয় না; ব্যক্তি তার মত বা কৃতকর্ম’ও সহজে বদলাতে চান না। কোনো বিষয়ে আপনার মত বা ধারণা বা আচরণ পরিবর্তন করা কতোটা কঠিন হবে এটা কয়েকটা নির্ণায়কের ওপর নির্ভর করে।

যেমন:

  • আপনি কতোটা শক্তভাবে আপনার বিশ্বাস ধারণ করেন
  • আপনার বিশ্বাস/আচরণ কতোটা সন্তুষ্টি বিধান করে
  • আপনার বিশ্বাস/আচরণ বদলানোর ওপর আপনার কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা আছে কী না

একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যাক। ধরুন, আপনি নিজেকে একজন পরিবেশবাদী মনে করেন। আপনি জানতে পারলেন আপনি যে কোম্পানিতে চাকরি করেন,তারা মারাত্মক রকমের পরিবেশ দূষণ করে এবং এখান থেকে তাদের সহজে সরে আসার কোনো লক্ষণ নেই। ফলে কগনিটিভ ডিজোনেন্স তৈরি হবে। এখন, আপনার যদি চাকরিটা আর ভালো না লাগে এবং আপনার অন্যত্র কাজ করার যথেষ্ঠ সুযোগ থাকে, আপনি হয়তো খুব সহজেই চাকরিটা ছেড়ে দেবেন। এখানে নিজের আচরণ তথা কাজ পরিবর্তনের ব্যাপারে আপনাকে তেমন কোনো অসুবিধায় পড়তে হলো না।

ধরা যাক, আপনি সেখানে বহু বছর ধরে দায়িত্বশীল কাজ করছেন এবং কোম্পানির সাথে বেশ গভীরভাবে যুক্ত। তখন কিন্তু আপনার কাজ বদলানোটা এতো সহজ হবে না। এখানে আপনার ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। যেটা হতে পারে তখন, আপনি মানসিক এবং আদর্শিকভাবে আপনার কঠোর পরিবেশবাদী অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেন। আপনার মন আপনাকে বোঝাবে পরিবেশের চেয়ে কোম্পানির লাভের খতিয়ানটাই বেশি জরুরি। অথবা, আপনার মস্তিষ্ক অন্য উপায়ে কগনিটিভ ডিজোনেন্স’কে প্রশমিত করার চেষ্টা করবে। দেখা যাবে আপনি কোম্পানির ভালো দিকগুলো খুঁজে বের করে আপনার কোম্পানিতে থাকার ভাবনাকে যৌক্তিক প্রতিপন্ন করতে চাইছেন অথবা অন্য কোম্পানির সাথে তুলনা করে বলছেন ওদের চেয়ে আপনার প্রতিষ্ঠান অনেক ‘কম খারাপ’ করছে। আপনি ভাববেন আপনার কোম্পানি পরিবেশের ‘কিছুটা’ ক্ষতি করলেও বহু লোকের কর্মসংস্থান এবং উন্নত জীবনযাপনের ব্যবস্থা তো করছে! কিংবা, অন্য কোম্পানির বন উজাড় করা, সমুদ্রে প্লাস্টিক এবং রাসায়নিক বিসর্জনের রিপোর্ট পড়ে নিজেকে প্রবোধ দেবেন আপনার কোম্পানি অন্তত এদের মতো নয়! ফলে নৈতিকভাবে আপনার অবস্থান ঠিকই আছে।

এটা একটা উদাহরণ মাত্র যেখানে কগনিটিভ ডিজোনেন্স আমাদের দিয়ে পরস্পর বিপরীতধর্মী কাজের পক্ষে সম্মতি আদায় করিয়ে নেয়। আরো বিভিন্ন উপায়ে এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেমন সবরকম ‘ফ্যাক্ট’ বা ‘ইনফরমেশন’ সর্বদাই হাজির থাকলেও ‘কগনিটিভ ডিজোনেন্স’-এর অস্বস্তি এড়াতে মানুষ ওইসব সূত্রের কথাই শোনে,মানে এবং প্রচার করে যেগুলো তার নিজের পূর্বানুমানকে বৈধতা দেয়। উল্টোভাবে, মানুষ এড়িয়ে চলে (Avoidance) এবং ক্ষেত্রবিশেষে খারিজ করে দেয় (Delegitimizing) ওইসব সূত্র যেগুলো তার পূর্বানুমানকে নড়বড়ে করে দেয়‌। একে বলা হয় ‘কনফার্মেশন বায়াস’।  অনেক সময় এসব সূত্রকে মিথ্যা ও সন্দেহজনক প্রতিপন্ন করতে নানারকম কুযুক্তি বা ফ্যালাসি’র আশ্রয় নেওয়া কিংবা নানারকম ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস আনাও ব্যতিক্রম নয়। মজার ব্যাপার, কগনিটিভ ডিজোনেন্সের অস্বস্তি কাটাতে আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের স্মৃতিকে’ও ঘোলাটে করে দিতে পারে।

বোঝা গেলো, আমাদের আদর্শ/চেতনার সাথে আমাদের চিন্তার বা আমাদের আচরণের সাথে আমাদের চিন্তার ‘অসঙ্গতি’ আমরা কোনোমতেই সহ্য করতে পারি না এবং সঙ্গতিবিধানের নানারকম সচেতন এবং অচেতন চেষ্টা করি। তবে কগনিটিভ ডিজোনেন্স’ সবসময় খারাপ নয়। আশার ব্যাপার,কগনিটিভ ডিজোনেন্স কাটাতে সকলেই উপর্যুক্ত পথগুলো বেছে নেন না। অনেকে আসলেই তাদের অসঙ্গতিপূর্ণ মত বা কাজকে পরিহার করেন। অনেক সময় এই অস্বস্তির অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা পরিণত হতে এবং তুলনামূলক ভালো সিদ্ধান্ত নিতে শিখি।

মনস্তাত্ত্বিকেরা বলে থাকেন এই অস্বস্তি কাটাতে নজর দিতে হবে নতুন তথ্য বা ধারণার (যা আমাদের চ্যালেঞ্জ করে) প্রতি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার দিকে। এই প্রতিক্রিয়ার ধরন বিবেচনা করলেই বোঝা যাবে যে আমরা নিজেদের যা ভাবি তার চেয়ে বেশি ‘বায়াসড’ কি-না। এরপর নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে এই প্রতিক্রিয়ার আসলেই কোনো যৌক্তিক ভিত্তি আছে কি?  এবং অবশ্যই আপন কার্য ও মত-পথ ঠিক করার আগে তার পাটাতন যাচাই করে নিতে হবে যতোটা সম্ভব যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে!

তথ্যসূত্র-

লেখাটি 57-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading