এখন থেকে প্রায় ৫০ বছর পরের কথা। বাংলাদেশী কিছু বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে পৃথিবীর প্রথম টাইম মেশিন আবিষ্কার হয়েছে। কিছু পশু পাখির ওপর পরীক্ষা করে সফল হয়েছে এই প্রজেক্ট। তাই এখন তারা ‘হিউম্যান ট্রায়াল’ এর চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিশাল অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে হিউম্যান সাবজেক্ট এর জন্য। অফারটি লোভনীয়! তাই আপনি আবেদন করে ফেললেন। এর কিছুদিন পর আপনার ডাক আসলো। চলে গেলেন তাদের পরীক্ষাকেন্দ্রে!
‘আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে অতীতে ভ্রমণ করবেন আপনি। ভাগ্য আপনার সহায় হোক!’ যান্ত্রিক কণ্ঠ ভেসে আসলো কম্পিউটারের ভেতর থেকে। বিজ্ঞানীরা আপনাকে একটা বিশাল কাঁচের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দিয়েছে। প্রায় মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর মনে হলো আপনার চারপাশে কিছু একটা ঘটছে। কাঁচের ঘরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। পাশে থাকা মিটারের সবগুলো রিডিং বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরমধ্যেই বাইরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে শোরগোল বেঁধে গেলো। কী হয়েছে তা জানার জন্য উঁকি দিলেন আপনি! কিন্তু তার আগেই কাঁচঘেরা পুরো ঘরটা ঘুরতে শুরু করলো। চেয়ারের সাথে বাঁধা না থাকলে আপনার হাড়গোড় হয়তো আস্ত থাকতো না। এরমধ্যেই দেখলেন, মিটারে রিডিং খুব দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলেছিল আপনাকে পাঁচ হাজার বছর পেছনে পাঠানো হবে…পিরামিডের গঠন সম্পর্কে জানার জন্য। কিন্তু মিটারে সেই ৫০০০ বছর অনেক আগে পেরিয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে সংখ্যাটা বাড়ছে। ৫ হাজার….১০ হাজার…১ লক্ষ….১০ লক্ষ….হঠাৎ চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলো!
মাথায় প্রচণ্ড ব্যাথা নিয়ে ঘুম ভাঙলো আপনার। আশেপাশে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বুঝার চেষ্টা করলেন আসলে কী ঘটেছে আপনার সাথে! হঠাৎ চোখ পড়লো পাশে থাকা মিটারের ডায়ালে। সর্বনাশ! জুরাসিক পিরিয়ডে তথা ডাইনোসরদের আমলে এসে পড়েছেন আপনি। এমন সময় যান্ত্রিক কণ্ঠে ভেসে এলো একটা এনাউন্সমেন্ট ‘Welcome to Jurassic Period.’ আতঙ্কে আবারও জ্ঞান হারালেন আপনি!
জুরাসিকের ঘন জঙ্গল! হাজার হাজার পাইন গাছ, সাইকাসের ঝাড়, নানা জাতের আর রঙের ফার্ন। এর মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছেন আপনি। হাতে একটা টর্চ আর একটা পঞ্চাশ ক্যালিবারের ‘ডেজার্ট ঈগল’। যদিও এটার গায়ে লেখা থেকে জানতে পেরেছেন, প্রতিটি বুলেটের সাথে পরিমাণমতো ‘বোটুলনিয়াম’ মেশানো রয়েছে। তবে সেই পরিমাণ কতটুকু তা নিয়ে আপনার মনে ঠিকই সন্দেহ রয়েছে। কারণ, সামনে হয়তো বিশাল কোনো ডাইনোসরের সামনে পড়তে হবে আপনাকে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কিছুক্ষণ আগের কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আপনার। টাইম মেশিন’টার গায়ে একটা বার্তা ফুটে ওঠেছিল ‘ যন্ত্রটা তার আগের সময়ে ফিরে যাচ্ছে। ঠিক এক দিন পর ফিরে আসবে!’ এরপরই আপনাকে চেয়ার থেকে নামিয়ে কাঁচের ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দেয় দুটো রোবোটিক হাত। আর সেসময় বিশাল এক ফড়িং তাড়া করে আপনাকে..আর তাই ছুটছেন আপনি!
জুরাসিকের রাত। অনেকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন আপনি। তাই এখন একটা গাছের উপর আশ্রয় নিয়েছেন। অবশ্য তার আগে নাম না জানা এক মিষ্টি ফল দিয়ে সন্ধ্যার আহার সম্পন্ন করেছেন। যদিও এই অচেনা জায়গায় পরখ না করে ফল খাওয়া ভীষণ বিপজ্জনক ছিল। তবুও ক্ষুধার কাছে সব হার মেনেছে। গাছের ওপর বসে থাকতে থাকতে অলসতা ভর করেছিল আপনার মধ্যে। কখন যে চোখ লেগে গিয়েছে বলতেও পারবেন না। গাছের নিচে বিশাল কিছুর নড়াচড়ার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো আপনার। ঠিকমতো সজাগ হওয়ার সময়ও পেলেন না, তার আগেই ঠিক গাছের নিচ থেকে এক অজানা প্রাণীর মরণ চিৎকার ভেসে আসলো আপনার কানে। তৎক্ষণাত দু’কান চেপে ধরলেন আপনি। চাঁদের আলোয় চল্লিশ ফুট লম্বা দেহটা দেখতে পেলেন আপনি। ডাইনোসর অ্যালোসরাস তার বিশাল চোয়ালের মাঝে চেপে ধরেছে আরেকটি ডাইনোসরকে। ছোটবেলা থেকেই ডাইনোসর নিয়ে অনেক জানাশোনা থাকার কারণে সহজেই চিনতে পারলেন আপনি জন্তু টাকে!
অ্যালোসরাস থেরাপড ডাইনোসরদের একটি বিলুপ্ত প্রজাতি। এরা এখন থেকে প্রায় পনেরো কোটি বছর আগে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াতো। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং আফ্রিকার কিছু অংশে এদের ফসিল পাওয়া গিয়েছে। ১৮৭৭ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ ওথনিয়েল চার্লস মার্শ (Othniel Charles Marsh) সর্বপ্রথম অ্যালোসরাস এর ফসিল খুঁজে পান। অ্যালোসরাস শব্দের অর্থ ‘অন্য রকম টিকটিকি’(different lizard)। অ্যালোসরাস’রা মূলত মাংসাশী। এরা সাধারণত বিভিন্ন তৃণভোজী ডাইনোসর যেমনঃ স্টেগোসরাস,বারোসরাস খেয়েই বেঁচে থাকতো।
বিজ্ঞানীরা পরিমাপ করে দেখেছেন,একটা পূর্ণবয়স্ক অ্যালোসরাস এর ওজন প্রায় ১৫০০ কেজি ছিল। এদের বাইট ফোর্স প্রায় সাড়ে তিন হাজার নিউটন (মানুষের বাইট ফোর্স মাত্র ৭২০ নিউটন, বাঘের বাইট ফোর্স সাড়ে চার হাজার নিউটন)। যদিও অ্যালোসরাস সিংহের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বড়! এরা ঘন্টায় ২১ মাইল বেগে দৌড়াতে পারতো।
কয়েক মূহুর্তের মধ্যে অ্যালোসরাস এর সকল বৈশিষ্ট্য আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। তবে সরাসরি অ্যালোসরাস দেখার পর চক্কর দিয়ে উঠলো আপনার মাথা। জ্ঞান হারালেন আপনি। বেল্ট দিয়ে গাছের ডালের সাথে বাঁধা না থাকলে নির্ঘাত ডাইনোসরটির পরবর্তী শিকার হতেন!
খুব ভোরে জ্ঞান ফিরলো আপনার। গাছ থেকে নেমে হাঁটা দিলেন একটু দূরের ঘাসের জমির দিকে। ঠিক তখনই আপনার থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে দেখতে পেলেন বিশাল জন্তু টাকে। প্রায় ৭০ ফুট লম্বা ডাইনোসর জিরাফোটাইটান! হঠাৎ না নড়লে সাবধান হতে পারতেন না আপনি। এর পায়ের নিচে পড়ে ভর্তা হয়ে যেতেন এতক্ষণে!
জিরাফোটাইটান ‘সরোপড’ ডাইনোসরদের একটি বিলুপ্ত প্রজাতি। এদের উদ্ভব হয়েছিল জুরাসিক পিরিয়ডের একেবারে শেষের দিকে। তৃণভোজী এই প্রাণীগুলো লম্বায় ৭০ ফুটের চেয়ে বেশি হতো। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন,এদের ওজন প্রায় ৪০ হাজার কেজি পর্যন্ত হতো! এরা বর্তমানের আফ্রিকার তাঞ্জানিয়া’য় বসবাস করতো। তবে আকারে বড় হলে কী হবে, এদের মস্তিষ্কের আকৃতি ছিলো মাত্র ৩০০ ঘন সেন্টিমিটার! (একজন মানুষের মস্তিষ্কের গড় আকৃতি ১৪০০ ঘন সেন্টিমিটার)। এই ছোট মস্তিষ্ক নিয়েই এরা বেঁচে ছিল জুরাসিক আমলে। তবে এরা কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা ডাইনোসর নয়। সবচেয়ে লম্বা ডাইনোসর হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছে পাতাগোটাইটান(প্রায় ১২২ ফুট লম্বা) এবং আরজেন্টিনোসরাস( প্রায় ১৩০ ফুট লম্বা)।
আরজেন্টিনোসরাস’রা প্রায় ১ লক্ষ কেজি পর্যন্ত হতো বলে ধারণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। এসব ভাবতে ভাবতে আপনি এগিয়ে চললেন সামনের দিকে।(ডাইনোসরদের প্রধানত দুটি গণে ভাগ করা হয়। লম্বা গলার ডাইনোসরদের ডাকা হয় সরোপড। আর খাটো গলার ডাইনোসরদের ডাকা হয় থেরোপড। থেরোপড ডাইনোসরের থেকেই বর্তমানের পাখিরা বিবর্তিত হয়েছে। সরোপড থেরোপড ছাড়াও আরো অনেক “গণ” এর ডাইনোসর ছিল।)
কিছদূর এগিয়ে দেখতে পেলেন অভাবনীয় দৃশ্য। ঘাসের জমি যেখানে শেষ হয়েছে,সেখানে অস্বাভাবিক লম্বা লেজ নেড়ে ডালপালা খাচ্ছে তিনটা বাসের সমান লম্বা ডিপ্লোডোকাসরা। ডিপ্লোডোকাস সরোপড গণের একটি প্রজাতি ছিল। ১৮৭৭ সালে Samuel Wendell Williston এদের ফসিল আবিষ্কার করেন উত্তর আমেরিকা থেকে। অনেক শান্তশিষ্ট এই ডাইনোসররা গাছের পাতা খেয়েই জীবনধারণ করতো,আর ওদের খেয়ে জীবনধারণ করতো অন্যান্য মাংসাশী ডাইনোসররা। প্রায় ৮৫ ফুট লম্বা এই ডাইনোসরগুলোর ওজন ২২ হাজার কেজি পর্যন্ত হতো। এদের লেজ দেখার মতো একটা জিনিস ছিল। সব ডাইনোসরদের মধ্যে লম্বা হলো এদের লেজ।
আপনার ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটালো এক কর্কশ চিৎকার। আপনার মাথার উপর থেকে ভেসে আসছে সেটি। একটিবার মাত্র উপরে তাকানোর সুযোগ পেলেন আপনি। তারপর লাগালেন এক ছুট! অবশ্য ভাগ্য আপনার সহায় ছিলো। কাছেই একটা গাছের নিচে ঘন জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নিলেন আপনি। এতক্ষণ আপনার মাথার উপরে যেই প্রাণীটি ঘুরে বেড়ালো সেটির নাম ‘কোয়েটজালকোয়াটল’। এরাও ডাইনোসরদের একটি প্রজাতি। সাপের দেবী কোয়েটজালকোয়াটলের নামে এদের নাম। এদের উড়ার গতি সাংঘাতিক। ঘন্টায় প্রায় ৯০ কিলোমিটার। মাটিতে বসে থাকলে আকারে জিরাফের সমান হয়। প্রায় ৪০ ফুট চওড়া হতো এরা। তবে ওজন ছিল আড়াইশো কেজির মতো। এরা এদের মাথা প্রায় ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘোরাতে পারতো এবং ছোট ছোট ডাইনোসর কিংবা স্তন্যপায়ী শিকার করে খেতো!
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আপনার খোঁজ না পেয়ে চলে গেল উড়ন্ত বিভীষিকা! এদিকে আপনি কিন্তু বেশ উপভোগ করছেন ডাইনোসরগুলোকে। ভয় ইতোমধ্যে কেটে গিয়েছে। আরো কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলেন আপনি। আরো অনেক প্রজাতির ডাইনোসরের দেখা পেলেন। প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। আপনারও ফেরার সময় হয়েছে। হাতে থাকা ঘড়িটা বিপ বিপ শব্দে জানিয়ে দিল আর আধঘন্টা পর ফিরে আসবে টাইম মেশিন! তবে বিপ বিপ আওয়াজটা আপনার কাছে সুখদায়ক মনে হলেও পাশে থাকা বিশাল টি-রেক্স এর কিন্তু ভালো লাগলো না। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে টি-রেক্স এর একেবারে কাছে চলে এসেছিলেন,খেয়াল করেননি আপনি। যখন এটি উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো,তখনই আপনার ভুল ভাঙলো।
এক ছুট লাগালেন আপনি। এখন দৌঁড়ানো ছাড়া বাঁচার কোনো উপায় নেই। টি-রেক্সের গতি ঘন্টায় মাত্র ৩২ কিলোমিটার। যেখানে মানুষের দৌড়ের গতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৪৩.৯৯ কিলোমিটার(এই রেকর্ড উসাইন বোল্টের)। আপনার দৌড় দেখে মনে হচ্ছে সর্বোচ্চ দৌড়ের গতির রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলবেন! যাহোক,এবার একটু টি-রেক্স এর দিকে নজর দেওয়া যাক। ডাইনোসরদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো এই টিরেনোসরাস রেক্স বা টি-রেক্স। এরা থেরাপড গণের অন্তর্ভুক্ত মাংসাশী ডাইনোসর। এরা এখন থেকে প্রায় ৭০ মিলিয়ন বছর বা ৭ কোটি বছর আগে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াতো। লম্বায় ৪০ ফুট আকৃতির এই ডাইনোসরদের ওজন ছিল ৮ হাজার কেজি। এদের বাইট ফোর্স ছিলো মারাত্মক!প্রায় ৩৫ হাজার নিউটন। এই রেকর্ড মাটির প্রাণীদের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদের শিকারের দেহ(ডাইনোসর) শক্ত বর্ম দিয়ে ঢাকা থাকতো; তাই এত বেশি বাইট ফোর্স নিয়ে বিবর্তিত হয়েছিল এরা। টি-রেক্স এর চোয়ালের আরেক নাম বোন ক্রাশার!
আপনার পিছনে যেই টি-রেক্স টা এসেছিল সেটার ভাগ্য ততটা ভালো ছিল না। কারণ আপনার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে একটা জলাভূমি’র কাছে আসার পর হঠাৎই পানির দানব ‘ডেইনোসূচাস’ ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
৫০০০ কেজি ওজনের ডাইনোসরের এই প্রজাতিটির বাইট ফোর্স প্রায় ১ লাখ ২ হাজার নিউটন। টি-রেক্স’টির কী অবস্থা হয়েছিল তা জানার আর অবকাশ রইলো না! দ্রুত ছুটে পালিয়ে এলেন আপনি। আরো কিছুক্ষণ দৌড়ে অবশেষে আপনি এসে দাঁড়ালেন টাইম মেশিনের ল্যান্ডিং সাইটে। কিছুক্ষণ পর স্বয়ং দেবদূতের মতো উপস্থিত হলো সেটি। ২৪ ঘন্টার এডভেঞ্চার শেষে আপনি ফিরে চললেন আপনার চিরচেনা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে!
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply