ওয়াবি সাবিঃ ত্রুটিপূর্ণ সৌন্দর্য-বন্দনার জাপানি দর্শনে বিজ্ঞানের অগ্রগতি

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

এ দর্শনের মূল শিক্ষা হচ্ছে আপনি যেমন আছেন ঠিক তেমন সত্ত্বাটিকেই আলিঙ্গন করুন। আপনার অপূর্ণতা ও খুঁতগুলোকে লুকানোর চেষ্টা করবেন না। এগুলোই আপনার স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ সম্প্রতি এক্স-রে ন্যানোইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কঠিন ইলেক্ট্রোলাইটের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম আবিষ্কার করেন যা ওয়াবি সাবির শিক্ষাকেই প্রতিফলন করে।

(এই লেখায় কোনো শব্দের পাশে [↓] চিহ্ন শব্দটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা নির্দেশ করে, যা লেখার শেষে ‘তথ্য সমৃদ্ধি’ অনুচ্ছেদে পাওয়া যাবে।)

বাম পাশের চায়ের কাপটি নিশ্চয়ই ডানের কাপটি থেকে মনোহর ও আকর্ষণীয় (!)

উপরের দুইটি কাপ থেকে যদি যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয় আপনাকে, তাহলে আপনি অবধারিতভাবেই হয়তো বামের কাপটিকে বেছে নিবেন। এর কারণ বামের কাপটি দেখতে মনোমুগ্ধকর, রুচিশীল এবং চিত্তাকর্ষক, এতে নান্দনিকতা ও আধুনিকতার পরশ রয়েছে। অন্যদিকে ডানের কাপটি দেখতে পুরাতন, সেকেলে এবং মরচে ধরা বিধায় এটি বেছে নেয়ার পেছনে কোনো আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক। এই তুলনাটি রূপকার্থে পাশ্চাত্যের সাথে জাপানের দর্শনের পার্থক্য তুলে ধরে। পাশ্চাত্য দর্শনে সর্বদা নিখুঁত, সামঞ্জস্য ও প্রতিসম প্রতিরূপের কীর্তন করা হয়। সেখানে সবাই নিরন্তর ছুটে চলে অনবদ্য ও অনিন্দ্য সৌন্দর্যের এক অলীক ধারণাকে আবর্তন করে। বিপরীতে জাপানি দর্শন অনুসারে যা প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক, তাই সৌন্দর্য। সময়ের আবর্তে কুঁচকে যাওয়া চামড়ার মাঝে, ধূলিমলিন রোদে পোড়া মুখমণ্ডলে সৌন্দর্যের প্রকৃত প্রতিরূপ ফুটে ওঠে। আজকের দুনিয়ার উচ্চাভিলাষী জীবনধারা, উৎকর্ষ সাধনের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা এবং পার্থিব ধন-সম্পদ কুক্ষিগতকরণের সামাজিক ধারণার বিপরীতে জাপানি ওয়াবি সাবি দর্শন আমাদের শেখায় জীবনের মূল্য অনুধাবন করতে, ছোট ছোট প্রাপ্তিগুলোকে উদযাপন করতে এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যকে মূল্যায়ন করতে।

ওয়াবি সাবি (わび・さび) দর্শন

ওয়াবি সাবি হলো একটি মার্জিত জীবনদর্শন যা আমাদেরকে প্রকৃতি ও আত্মার সাথে আরও গভীরভাবে সংযুক্ত হতে শিক্ষা দেয়। ওয়াবি সাবি এমন একটি দার্শনিক ধারণা যা আমাদের অপূর্ণতার মধ্যে কমনীয়তা খোঁজার অনুপ্রেরণা যোগায় এবং জীবনের স্বাভাবিক চক্রকে গ্রহণ করতে শেখায়। এই দর্শন আমাদের শেখায়, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সৌন্দর্যসহ সবকিছু, এমনকি আমরা নিজেরাও অস্থায়ী, অসম্পূর্ণ এবং অপরিপূর্ণ। সুতরাং পরিপূর্ণতা হচ্ছে একটি অলীক ধারণা এবং অস্থায়িত্বই হচ্ছে একমাত্র স্থায়ী। ওয়াবি সাবির তিনটি মূলনীতি হলো–

  • কিছুই নিখুঁত হয় না (Nothing is perfect)
  • কিছুই নিঃশেষ হয়ে যায় না (Nothing is finished)
  • কিছুই চিরতরে স্থায়ী হয় না (Nothing lasts forever)

ওয়াবি সাবি হচ্ছে ওয়াবি () এবং সাবি () নামে দুটি আন্তঃসম্পর্কিত অথচ ভিন্ন ধারণার সমন্বয়ে গঠিত জাপানি দর্শন। ওয়াবির মূল কথা হচ্ছে বিনম্র, আটপৌরে, সাদাসিধে সারল্যে লালিত্য খুঁজে নেয়া। এটি আমাদের হৃদয় উন্মুক্ত করার এবং ভোগবাদী পার্থিব বস্তুবাদের অসারতা ঝেড়ে ফেলে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে আহ্বান জানায়। অন্যদিকে, সাবি হচ্ছে সময়ের পরিক্রমার সাথে সম্পর্কিত একটি ধারণা। ব্যাপারটি অনেকটা এরকম — কোনো কিছুর যেভাবে সময়ের সাথে বয়োবৃদ্ধি ঘটে, একসময় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায়, তা বস্তুর বা ব্যক্তির অবয়বে সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। আমরা আসলে খালি চোখে যতখানি দেখি, সৌন্দর্য তারও অনেক গভীরে লুক্কায়িত থাকে, একে উদঘাটন করা অনেকটা সাগরবক্ষ থেকে মণি মুক্তা আহরণ করার মতো। যুগলভাবে এই দুটি ধারণা আমাদের জীবন ও এই বিশ্বজগতের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির একটি ধরন। এর মূলভাব হচ্ছে অপরিপূর্ণতা ও অসম্পূর্ণতাকে সাদরে গ্রহণ করা। ওয়াবি সাবি আমাদের শিক্ষা দেয় জীবনে যা কিছুই আসুক না কেনো, তাকে সেভাবে গ্রহণ করা; শুধু বর্তমানকে ধ্যান জ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা; জীবনের অতি সাধারণ ও ক্ষণস্থায়ী বিষয়গুলোর প্রশংসা করা। একে অসম্পূর্ণতা, অপরিপূর্ণতা এবং অস্থায়িত্বের নন্দনতত্ত্ব বলা চলে।

জাপানি কাউকে ওয়াবি সাবি ব্যাখ্যা করতে বললে তিনি শব্দযুগলের অর্থ বুঝলেও সংজ্ঞা দাঁড় করাতে পারবে না। অনেক সময় সংজ্ঞায়িতকরণকে ভাষার প্রতি অসম্মান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাপানিরা ভাষার, এবং একই সাথে জীবনের প্রতি দ্ব্যর্থবোধক দৃষ্টিভঙ্গি পছন্দ করে।

গ্রহণ করার মধ্যে স্বাধীনতা নিহিত, গ্রহণযোগ্যতার বাইরে বৃদ্ধি বা বিকাশের অবস্থান

জাপানের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত দেওয়া সানজান [↓] (Dewa Sanzan) পর্বতশ্রেণি (মাউন্ট হাগুরো, মাউন্ট গাসান এবং মাউন্ট ইউডোনোর তিনটি পবিত্র পর্বত) ৮ম শতক থেকে ইয়ামাবুশি [↓] সন্ন্যাসীদের কাছে তাঁদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে তাঁরা তাদের মন, শরীর এবং আত্মার জন্য পুনর্জন্ম এবং জ্ঞানার্জনের জন্য বার্ষিক আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। তাঁদের প্রশিক্ষণের মূল দর্শন হচ্ছে ইউকেটামো (Uketamo — আমি বিনয়াবনত চিত্তে উন্মুক্ত হৃদয়ে গ্রহণ করি)। ইউকেটামো মানে হলো অন্তরের অন্তঃস্থল হতে মেনে নেওয়া। ইয়ামাবুশি সন্ন্যাসীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে জীবন আপনাকে যে পরিস্থিতির সামনেই দাঁড় করাক না কেনো, আপনি যদি তা উন্মুক্ত হৃদয়ে গ্রহণ করে নিতে পারেন, আপনি হালকা অনুভব করবেন। ওয়াবি সাবি দর্শনের প্রথম শিক্ষা কৃতজ্ঞতা এবং গ্রহণের অভ্যাস অনুশীলন করা। এটি শিখায় হাল ছেড়ে না দিয়ে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে। জীবনের কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করতে।

‘আমর ফাতি (amor fati)’ একটি ল্যাটিন শব্দগুচ্ছ, যার ইংরেজি রূপ হচ্ছে ‘love of fate’, অর্থাৎ অদৃষ্টের প্রতি অনুরাগ। এই দর্শনের শিক্ষা হচ্ছে ভালো কিংবা মন্দ যা কিছুই ঘটুক না কেনো, তা গ্রহণ করা। একটি পরিতৃপ্ত জীবনের জন্য ভাগ্যকে ভালোবাসা অপরিহার্য।

ইউকেটামো অনেকটা বৈরাগ্যবাদ (Stoic) দর্শনের আমর ফাতি তথা অদৃষ্টের প্রতি অনুরাগের ধারণার মতো — আপনি শান্তি অনুভব করবেন এবং সমৃদ্ধির পথে পা বাড়াবেন যদি আপনি জীবনের অপূর্ণ প্রবাহের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। নিচের গ্যালারিতে দেওয়া সানজান পর্বতশ্রেণিতে অবস্থিত ইয়ামাবুশি সন্ন্যাসীদের কয়েকটি স্থাপনা তুলে ধরা হলো।

জগতের প্রত্যেকটি উপাদানই রয়েছে অসম্পূর্ণ ও খুঁতযুক্ত অবস্থায়

প্রকৃতির সবকিছু পরিবর্তনশীল বিধায় কোনো কিছুই পরিপূর্ণ নয়। ওয়াবি সাবি দর্শন আমাদের শেখায় যে আমাদের জীবন সহ সমস্ত জিনিসই অস্থায়ী, অসম্পূর্ণ এবং অপূর্ণ। সমাজ নিখুঁত বলতে যে রকম একটি সংজ্ঞা দাঁড় করায়, আমরা কায়মনোবাক্যে সে রকম একটি নিখুঁত দেহ প্রত্যাশা করি। আমরা অপরের সংজ্ঞায় আমাদের নিখুঁত ক্যারিয়ার এবং নিখুঁত সঙ্গী বেছে নেয়ার অভিপ্রায় পোষণ করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরিপূর্ণতার কোনো অস্তিত্ব নেই, বরং অপূর্ণতাই জীবনের স্বাভাবিক অবস্থা। আপনি যেমন, ঠিক তেমনটাতেই আপনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ কারণে পরিপূর্ণতার জন্য নয়, বরং শ্রেষ্ঠত্বের জন্য চেষ্টা করাটাই শ্রেয়।

প্রথিতযশা তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং এর মতে, জগতের একটি মৌলিক নিয়ম হচ্ছে এর কোনো কিছুই নিখুঁত নয়। চরম উৎকর্ষ তথা শতভাগ পরিপূর্ণতার কোনো স্থান এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই। অসম্পূর্ণতা ব্যতীত আপনি কিংবা আমি কেউই বিরাজ করতে পারতাম না। আসলে এই বিশ্বজগত পরিপূর্ণতাকে অনুমোদন করে না।

লেখক এবং দার্শনিক নবুউ সুজুকির বইয়ে উল্লিখিত একটি হাইকি [↓]

এক ধাপের পরে আরেক,
পরের ধাপে কিসের নাগাল?
শেষটা কোথায়?

সৌভাগ্যবশত আমাদের তা জানা নেই। শেষটা অনিশ্চিত, এবং এর একটি রোমাঞ্চকর দিক হচ্ছে, যে কোনো কিছুই সম্ভব। আমাদের প্রতিনিয়ত সর্বোত্তম অপরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। অনিশ্চয়তার মাঝে সুখী হওয়ার স্পর্ধা থাকা উচিত আমাদের সবার মধ্যে। প্রকৃতির রহস্যময় স্পন্দনের মাঝে যদি নিজেকে স্থিতিস্থাপকরূপে গড়ে তোলা যায়, তবে উত্তম ফলাফল প্রত্যাশা করা সম্ভব।

সমস্ত জিনিসের মধ্যে সৌন্দর্যের প্রশংসা

কিন্টসুগি (Kintsugi) নামে একটি প্রাচীন নন্দনতত্ত্ব রয়েছে যেখানে ভাঙা পাত্রকে সোনালী রঙ দ্বারা মেরামত করা হয়, একে বলা হয় সোনালী উপশম (golden healing)। কিন্টসুগি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভাঙা জিনিসগুলোতে এক অসাধারণ ও দুর্দান্ত সৌন্দর্য রয়েছে, কারণ দাগগুলি একেকটা নির্বাক গল্পের আঁচড়। এগুলো দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা এবং স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করে, যা সময়ের সাথে সাথে অর্জিত হয়।

ধারণাটি খুবই সাদামাটা — আপনার জীবনে এমন অনেক সময় আসবে যখন আপনি ভেঙে পড়বেন। এমন কিছু ঘটনা ঘটবে যা আপনাকে মানসিক বা শারীরিক দাগ দিয়ে চলে যাবে। তখন নিজেকে রোদের ছায়ায় লুকিয়ে না রেখে, মেঘের আঁধারে নিজের আলোকে ম্লান হতে না দিয়ে সেই দাগগুলো সোনা দিয়ে পুনরায় আঁকা হোক। কিন্টসুগির এই ধারণাটিকে নিজের মধ্যে ধারণ করা শুরু করুন — ভাঙা বস্তুগুলো লুকিয়ে না রেখে সেগুলোকে গর্বের সাথে প্রদর্শন করুন। আপনি ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করবেন যে আপনি কীভাবে সেই পরিপূর্ণতার চিত্রটি অঙ্কন করছেন। সৌন্দর্যের ধারণাই হচ্ছে আপনার স্বকীয়তা।

সৌম্য শান্ত এবং সারল্যই হচ্ছে জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগের একমাত্র উপায়

ওয়াবি সাবির শিক্ষা হচ্ছে বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি অনুরক্ত না হয়ে অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের পূজা করা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করা এবং জীবনকে যথাসম্ভব সরল করে তোলা। তাড়াহুড়োর ছন্দে বেঁচে থাকার প্রতিষেধক হল স্থিরতা। আর জীবনকে সরলীকরণ করা একটি জটিল জীবনযাপনের অস্বস্তির প্রতিষেধক।

“সারল্যই হচ্ছে চূড়ান্ত জটিলতা”

— লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

ধীর-স্থিরতা আমাদেরকে আশেপাশের পরিবেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে। আর এতে প্রকারান্তরে স্ব-সচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়। কারণ, ধীর-স্থিরতা আমাদের ব্যস্ততার মাঝে অবকাশ গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করে, আর এতে নিজের চিন্তা-ভাবনাকে শৃঙ্খলিত করে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। জীবনের এক পর্যায়ে এসে সংযোজনের তুলনায় বিয়োজনের ধারণা বড় হয়ে দাঁড়ায়। এর থেকে স্বল্পবাদ (Minimalism) এর ধারণা পাওয়া যায়।

এক কথায় স্বল্পবাদ বলতে সবকিছুতে ‘অল্পই শ্রেয়’ এই মতবাদকে বুঝায়। সহজ করে বলতে গেলে, ঠিক যতটুকু ছাড়া আপনার জীবন ধারণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, ততটুকুতে পরিতৃপ্তি সহকারে জীবন ধারণকে স্বল্পবাদী জীবনশৈলী বলে।

স্বল্পবাদ ধারণার শিক্ষা হচ্ছে ‘অল্পই অধিক’

নিজের অবস্থানে যা কিছু আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা সুখী জীবনের শর্ত

আধুনিক সমাজ সুখের সন্ধানে আচ্ছন্ন। আবার সমাজে সুখের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় বিত্ত-বৈভব, ক্যারিয়ার প্রভৃতির নিরিখে। এখানেই একটি আপাত বিরোধী ধারণা গড়ে উঠেছে। একদিকে সুখের সন্ধান, অন্যদিকে সুখের বিপরীত স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা। প্রকৃতপক্ষে, জীবনে সুখী হতে হলে সর্বপ্রথম যে জিনিসটি দরকার তা হলো গ্রহণ করার (acceptance) মানসিকতা। নিজের অবস্থান, নিজের চেহারা, নিজের ক্যারিয়ার, নিজের পারিপার্শ্বিক বলয় নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারলেই কেবল প্রকৃত সুখের সন্ধান পাওয়া যাবে।

১৭শ শতকে জাপানের টোকিওর রিওয়ানজি উপাসনালয়ে সুকুবাই (tsukubai) নামে একটি পাথুরে জলের বেসিন ছিলো, যার পৃষ্ঠের কেন্দ্রে একটি বর্গাকৃতির সিঙ্ক এবং চারপাশে চারটি কাঞ্জি [↓] খোদাই করা ছিলো।

যদি প্রতিটি কাঞ্জির সাথে বর্গাকৃতি 口 (kuchi) যুক্ত করে পড়া হয়, তবে ঘড়ির কাঁটার দিকে অক্ষরগুলো দাঁড়ায় 吾 (ware = আমি), 唯 (tada = কেবল), 足 (taru = প্রাচুর্য) এবং 知 (shiru = জানা); যার সম্পূর্ণ অর্থ হচ্ছে ‘আমি শুধু প্রাচুর্য জানি।’ এর মর্মার্থ হচ্ছে একজনের যতটুকু আছে ততটুকুই তার প্রয়োজন, এবং এ থেকে সবকিছুতে সন্তুষ্ট থাকার শিক্ষা পাওয়া যায়।

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা

এ গবেষণার সারসংক্ষেপ তুলে ধরার পূর্বে তড়িৎ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক।

দুটি তড়িৎ সুপরিবাহী দণ্ডের একপ্রান্ত ব্যাটারির (কোষ) সাথে সংযুক্ত করে অপর প্রান্তদ্বয় তড়িৎ বিশ্লেষ্য (ইলেক্ট্রোলাইট) পদার্থে প্রবেশ করিয়ে তড়িৎ বিশ্লেষণ কোষ প্রস্তুত করা হয়।

২০২১ সালে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণের নেতৃত্বে আবিষ্কৃত হয় যে, কঠিন ইলেক্ট্রোলাইটের স্ফটিক খাদ (crystal defects) এবং বিন্যাসচ্যুতি (dislocations) এর শক্তি সঞ্চয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল Nano Letters শীর্ষক জার্নালে প্রকাশ করা হয়। গবেষণায় সিনক্রোট্রন বিকিরণ ব্যবহার করে খাদ এবং চ্যুতি নির্ণয় করা হয়। আমরা জানি ইলেক্ট্রোলাইট হিসেবে সাধারণত তরল পদার্থ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু দেখা যায় এতে ক্যাথোড ও অ্যানোডের মাঝে সূক্ষ্ম ডেনড্রাইট সৃষ্টি হয়ে ব্যাটারির কার্যকারিতা হ্রাস করে। এ কারণে উক্ত গবেষণায় কঠিন ইলেক্ট্রোলাইট বেছে নেয়া হয়, কারণ এটি দাহ্য নয়। তবে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তরল ইলেক্ট্রোলাইটের মতো আয়ন পরিবহনে সহায়তা এবং ক্যাথোড-অ্যানোড সংযোগ।

স্ফটিক খাদ এবং বিন্যাসচ্যুতি কঠিন ইলেক্ট্রোলাইটকে উচ্চতর শক্তি সঞ্চয়কে পরিণত করতে পারে।

গবেষকদের একজন মন্তব্য করেন, এক্ষেত্রে আশীর্বাদ হতে পারে অতিক্ষুদ্র স্ফটিক খাদ, যা আয়নের পরিব্যাপ্তিতে সহায়ক হয়ে এর পরিচলন গতি বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়া ভঙ্গুরতা রোধেও ভূমিকা রাখতে পারে পারমাণবিক স্কেলের এই খাদসমূহ। গবেষণায় লিথিয়াম ল্যান্থানাম জিরকোনিয়াম অক্সাইডের (LLZO) স্ফটিকে বিভিন্ন ঘনমাত্রায় অ্যালুমিনিয়াম মিশিয়ে ডোপায়িত [↓] করা হয়। এরপর মাইক্রন আকৃতির (১ মাইক্রন = ১/১০০০ মিলিমিটার) একটি ডোপায়িত স্ফটিকে ব্র্যাগ কোহেরেন্ট ডিফ্র্যাকটিভ ইমেজিং প্রযুক্তিতে কলাম আকৃতির এক্স রশ্মি ফোকাস করা হয়, আর এতে একটি ত্রিমাত্রিক চিত্র গঠিত হয় যেখানে স্ফটিক খাদ এবং বিন্যাসচ্যুতি স্পষ্ট হয়ে ধরা পরে।

গবেষণা থেকে ওয়াবি সাবির শিক্ষা

Matter জার্নালের প্রধান সম্পাদক স্টিভ ক্র্যানফোর্ড একটি সম্পাদকীয় লেখায় বর্ণনা করেন, ত্রুটি, খাদ এবং দুর্বলতা সর্বদা খারাপ নয়। গ্রাফিনের তথাকথিত ৫ – ৭ খাদ, ৫ – ৮ – ৫ খাদ ইত্যাদি সক্রিয় প্রভাবকের ভূমিকা পালনে সহায়তা করে।

গ্রাফিনের স্ফটিক খাদ

ইস্পাত হচ্ছে লোহা ও কার্বনের একটি সংকর ধাতু যাতে মান ভেদে মোট ওজনের ০.২% থেকে ২.১% কার্বন খাদ হিসেবে মিশ্রিত থাকে। জীববিজ্ঞানে হাইড্রোজেন বন্ধনের মতো দুর্বল পদার্থকে এমনভাবে সজ্জিত করা হয় যেনো তা থেকে সর্বোচ্চ স্থিতি ও শক্তি লাভ করা যায়। তাপগতিবিদ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে এনট্রপি (entropy), যা কোনো সিস্টেমের বিশৃঙ্খলার মান নির্দেশ করে। যত বেশি বিশৃঙ্খলা, তত বেশি এনট্রপির মান। এই বিশ্বজগতের এনট্রপি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর এটি অনিবার্য। হাত থেকে একটি গ্লাস মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেলে এর এনট্রপি বৃদ্ধি পায়। আমরা খুব দ্রুত তা সরিয়ে স্থানটি পরিষ্কার করে নিই। মনোবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে, মানব মন এনট্রপির বৃদ্ধি পছন্দ করে না। কিন্তু আমাদের জন্য এটি মেনে নেয়া মঙ্গলজনক যে এনট্রপির বৃদ্ধি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।

উপসংহার

প্রাচীন চীনা তাওবাদ [↓] (taoism) এবং জেন [↓] (zen) বৌদ্ধধর্মের শিকড়ে প্রোথিত ওয়াবি সাবি জাপানের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে জেন ধর্মযাজক মুরাতা জুকোর (১৪২৩ – ১৫০২) সময় থেকে। এই মতবাদ মানুষকে তার ক্ষণস্থায়িত্ব এবং অপূর্ণতা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওয়াবি সাবি থেকে লব্ধ শিক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি পরিতৃপ্ত ও সুখী জীবন গড়ে তোলা সম্ভব। অন্তত বিজ্ঞান আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে নিখুঁত মানেই একঘেয়ে।

তথ্য সমৃদ্ধি

দেওয়া সানজান

প্রাচীন দেওয়া প্রদেশে (বর্তমানে ইয়ামাগাতা প্রশাসনিক অঞ্চল) অবস্থিত তিনটি পর্বতের গুচ্ছকে দেওয়া সানজান বলে। এই স্থান শিন্তৌ ধর্মাবলম্বীদের নিকট অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে বিবেচিত।

ইয়ামাবুশি

‘ইয়ামাবুশি’ শব্দের অর্থ পাহাড়কে শ্রদ্ধা করা। শুগেনডো মতবাদে বিশ্বাসী ইয়ামাবুশি সন্ন্যাসীরা পাহাড়ে বাস করে এবং সেখানেই তাঁদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

হাইকি

হাইকি (বহুবচনঃ হাইকু) হচ্ছে অতি স্বল্প আয়তনের জাপানি কবিতা। তিন পংক্তিতে ৫ – ৭ – ৫ এই সংখ্যায় অক্ষর বিন্যস্ত হয়। এর সাথে একই বিষয়ে দুটো ভিন্ন চিত্র বর্ণিত হয় এবং চিত্র দুটো একটা ‘কিরেজি‘ বা ছেদক-শব্দ (অনেকটা বাংলা যতি বা ছেদ চিহ্নের মতো) দিয়ে সংযুক্ত হয়।

কাঞ্জি

জাপানি ভাষায় তিন প্রকার লিপি ব্যবহৃত হয় — হিরাগানা, কাতাকানা ও কাঞ্জি। হিরাগানা এবং কাতাকানা যেখানে উচ্চারণভিত্তিক, সেখানে কানজি হচ্ছে ভাবচিত্রভিত্তিক।

তাওবাদ

লাওৎসি (Lao Tzu) নামক একজন চৈনিক দার্শনিককে তাওবাদের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ‘তাও তে চিঙ (Tao Te Ching)’ নামক গ্রন্থে তাওবাদের ভাবধারা ব্যক্ত করেন। যে কোনো ঘটনাকে বিনা হস্তক্ষেপে তার আপন গতিতে পরিবর্তন, বিবর্তন ও পরিণতির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তাওবাদের মূল বিষয়। 

জেন

মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি শাখা হচ্ছে জেন। এ শব্দটি সংস্কৃত ধ্যান (ध्यान) থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। কঠিন তপস্যা, ধ্যানচর্চা, বোধিদেবসাধনা ইত্যাদির ওপর জোর দেয়া হয় জেন শিক্ষায়।

ডোপায়ন

ডোপায়ন বা ডোপিং বলতে বুঝায় অর্ধপরিবাহী পদার্থ উৎপাদনে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি অত্যন্ত খাঁটি অর্ধপরিবাহীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় খাদ মিশিয়ে এর তড়িৎ গুণাবলির পরিবর্তন করা। খাদের পরিমাণ অর্ধপরিবাহীর ধরনের উপর নির্ভর করে।


এই আর্টিকেলে ব্যবহৃত ছবি সমূহ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।


তথ্যসূত্র

লেখাটি 92-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading