১৮১৬ সাল। ন্যাকার হাসপাতাল। প্যারিস, ফ্রান্স।
জনসাধারণের আনাগোনায় লোকে-লোকারণ্য হাসপাতালের সবুজ আঙিনা। কেউ কেউ হাসিমুখে বিদেয় হচ্ছেন, কেউ-বা আতঙ্কিত নয়নে, ভয়ার্ত মনে, ধীর পায়ে প্রবেশ করছেন। ডাক্তার লেনেক ন্যাকার হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ সার্জন। নিজের রুমে বসে ঝাঁঝালো রোদ্দুরে বাইরের পানে আপন মনে তাকিয়ে আছেন তিনি। অপেক্ষা করছেন রোগীর আগমনের।
শুভ্র পা-যুগল এলিয়ে দিয়ে এক নির্মল নারীমূর্তি প্রবেশ করলো লেনেকের চেম্বারে। পেছন পেছন এগিয়ে এলেন একজন দীর্ঘদেহী যুবকও। কথা বলার একফাঁকে জানতে পারলেন, যুবকটি তার (নারীর) বাগদত্তা স্বামী। রোগীর সমস্যা, হৃদ-যন্ত্রণা!
হাসপাতালের ডাক্তারদের গলায় সর্বদা একটি সর্পিল যন্ত্র পেঁচিয়ে থাকতে দেখা যায়। একটি টিউব, যার একপাশ গোলাকার, অন্যপাশ ভাগ হয়ে গেছে দু’মাথায়। রোগী এলেই ডাক্তাররা মাথাদ্বয় কানে গুঁজে গোলাকার অংশটি রোগীর বুকে-পিঠে চেপে ধরেন, শোনার চেষ্টা করেন পেটে লাগিয়েও। রোগীকে বলেন, “জোরে জোরে শ্বাস নিন তো দেখি নিই” অথবা, কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করুন জোরে!
এতকিছু কেন বলেন? কারণ একটাই– হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ও পাকস্থলীর ধুকপুকোনি, ডুপ ডুপ শোনার জন্য। দেহের ভেতর থেকে অবিরাম ধেয়ে আসা এসব শব্দধ্বনির কম্পন শুনেই বিজ্ঞ ডাক্তারেরা অভিজ্ঞতার বলয়ে আঁচ করে ফেলতে পারেন রোগীর সমস্যা। বুঝতে পারেন কি চলছে অন্ধকার দেহ-গহ্বরে! কখনো ধ্বক ধ্বক, কখনো গুড়গুড়, কখনো-বা চিকন বাঁশির সুর, আবার কখনো-বা মেঘের অকস্মাৎ গর্জন! এ সবগুলো শব্দের মাঝেই লুকিয়ে আছে হাজার রকম তথ্য। কী বলছে তারা?
কোনোটি বলছে, ভেতরে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে জনাব। আবার কোনোটি– না, কোথাও একটু গোলমাল পাকিয়েছে নিশ্চয়ই। ডাক্তারবাবু চোখ-কান বুঁজে এসব শব্দের রেশ বোঝার চেষ্টা করেন। বুঝেও ফেলেন, কোথায় কী গণ্ডগোল, কোথায় বেধেছে সমস্যা! আর যে যন্ত্রটি এই কাজে সাহায্য করে তার নাম স্টেথোস্কোপ।
কিন্তু যে সময়ের কথা বলছি, তখন তো স্টেথোস্কোপ ছিল না। তখন কীভাবে এসব চেকআপ করা হতো? সে বড় যন্ত্রণার বিষয় বাপু! সে সময় ডাক্তার মশাইকে সরাসরি কান পেতে শুনতে হতো রোগীর বুকে। এটি এক মহা অস্বস্তিকর বিষয় ছিলো বটে।
কীভাবে? চলুন বুঝিয়ে বলছি।
ধরুন, পালোয়ান গোছের এক লোক তার নববিবাহিতা সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এলো। শুরুতেই ডাক্তার তার (স্ত্রীর) বুকে কান চেপে শব্দ শোনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ফুসফুসের অবস্থান তো একেবারে বুক বরাবর। তাহলে? এসব ক্ষেত্রে রোগীর আপনজন অতিমাত্রায় রক্ষণশীল আচরণ দেখান। বেচারা ডাক্তারও তো নিরুপায়, তারও তো কিছুই করার থাকে না।
আগের ঘটনায় ফিরে যাই
ডাক্তার লেনেকও পড়লেন একই বিড়ম্বনায়। আগত রোগিনী ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে। স্বাস্থ্যবতী, বিন্দুমাত্র খুঁত নেই শরীরজুড়ে। একে তো তরুণী, তার উপর সুদর্শনা, অপরূপ রূপবতী। বেশ দারুণ যন্ত্রণায় পড়া গেলো তো- মনে মনে বললেন লেনেক। কিন্তু হৃৎপিণ্ডের আওয়াজটাও তো শোনা খুবই জরুরি। তাই রোগীকে বুঝতে না দিয়ে আপন মনে ভাবতে লাগলেন কী করা যায়? তখনই তার মাথায় উঁকি দিলো এক অতীতের স্মৃতি।
একদিনের ঘটনা, কনকনে ঠাণ্ডায় নির্জন মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। অদূরে দেখতে পেলেন, খেলায় মেতে উঠেছে দুরন্ত কিশোরের দল। শৈশবের স্মৃতিকে তাজা করতে মাঠের একপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লেন আনমনে দেখতে লাগলেন তাদের কাণ্ডকারখানা।
একটি সরু ফাঁপা কাঠের চোঙ্গার একপাশে কান ঠেসে বসে আছে একজন, অন্যপাশ থেকে কথা বলছে আরেকজন। শব্দ করছে ঠকঠক, ঝনঝন। তা শুনেই আনন্দে ফেটে পড়ছেন ওপাশের শ্রোতা। লেনেকের মনে পড়লো পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র- কঠিন মাধ্যমে শব্দ-তরঙ্গ দ্রুত প্রবাহিত হয়!
চেম্বারে বসে ভাবতে থাকা লেনেক আচমকাই চেঁচিয়ে উঠলেন। বলে উঠলেন– আরে তাই তো! তার মাথায় আগে আসে নি কেনো এটা? যেই ভাবা, সেই কাজ। হসপিটালের টেবিল থেকে একটি শক্ত-মোটা নোটপ্যাড হাতে তুলে নিলেন তৎক্ষণাৎ। তারপর গোলাকার চোঙা বানিয়ে আলতো করে ঠেসে ধরলেন রোগিনীর বুকে, ঠিক ফুসফুসটা যেখানে। অন্যপ্রান্ত লাগালেন নিজ কানে। পরমুহূর্তেই চমকে উঠলেন লেনেক, মুখে ফুটে ওঠলো হাসির রেখা। সরাসরি কান পেতে শুনলে যেমন শব্দ শোনা যায়, তার চেয়েও অনেক স্পষ্ট আর নিখুঁত শব্দ শুনতে পেলেন তিনি।
ব্যস, আপাতত কার্যসিদ্ধ হলো! নির্ণয় হলো রোগিনীর যন্ত্রণা। দেওয়া হলো যথাযথ পথ্য ও নির্দেশনা। রোগিনী বিদেয় হতেই নিজ চেম্বার থেকে ভৌ-দৌড়ে ছুটতে লাগলেন বহির্বিভাগের পানে। একে একে বেডে লেপ্টে থাকা সকল রোগীকে পরখ করে দেখতে লাগলেন। ফলাফল– এক ও অভিন্ন। এসময়ই তিনি এর নাম দেন Immediate Auscultation বা তাৎক্ষণিক শ্রবণ!
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ
কয়েকদিন পর, প্রথাগত ডাক্তারেরা লেনেকের এই আবিষ্কারের প্রতি হয়ে উঠলো ঘোর বিরোধী, ঈর্ষান্বিত। বলতে লাগলো– এটি হাস্যকর ও অবৈজ্ঞানিক যন্ত্র। আখ্যা দিলো অনির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসেবেও। কিন্তু না, লেনেক দমে যাবার পাত্র নন। ধীরে ধীরে নেশায় পেয়ে বসলো তাকে এটা। ভাবতে লাগলেন, কীভাবে এর আরেকটু উন্নত সংস্করণ বের করা যায়?
ব্যস, যেমন ভাবনা তেমন কাজ। একাই নেমে পড়লেন গবেষণার মাঠে। অসংখ্য রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে ফলাফল লিপিবদ্ধ করতে লাগলেন নোট খাতার পরতে। চলতে থাকলো ডাটা কালেকশনের নিরলস প্রচেষ্টা। দেহের অভ্যন্তরে চলমান বিভিন্ন শব্দের উৎস, তাদের বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য নির্ণয় করতে সমর্থও হলেন তিনি। এসব নিয়েই চালালেন দীর্ঘ গবেষণা।
পরবর্তীতে নোটপ্যাডের পাতা ছেড়ে কাঠের তৈরি একপ্রকার মোটা যন্ত্রও বানিয়ে নিলেন লেনেক। এ দিয়েই চালতে লাগলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নতুন এ যন্ত্রের নাম রাখলেন স্টেথোস্কোপ। লেনেকের তৈরি সে স্টেথোস্কোপের আকৃতি ছিল দৈর্ঘ্যে ২৫ সেন্টিমিটার আর প্রস্থে ২.৫ সেন্টিমিটার। দেখতে অনেকটা সরু, লম্বাটে ও নলকার।
এর পরের গল্প
সেদিনের সেই সাদামাটা স্টেথোস্কোপ থেকে আজকের চমকপ্রদ স্টেথোস্কোপ হয়ে উঠার পেছনে রয়েছে অজস্র শ্রম। রয়েছে নানান জনের আরাধ্য পরিশ্রম। পাড়ি দিতে হয়েছে লম্বা পথ। অপেক্ষা করতে হয়েছে সুদীর্ঘ সময়। প্রায় একশত পয়ষট্টি বছর!
১৮৪০ সালে, প্রফেসর গোল্ডিং বার্ড স্টেথোস্কোপ তৈরিতে কাঠের পরিবর্তে মজবুত প্লাস্টিকের ব্যবহার আনয়ন করেন। আইরিশ ডাক্তার আর্থার লিয়ার্ডের হাত ধরে স্টেথোস্কোপ পায় দুই কানের প্রথম স্পর্শ। এর বছরখানেক পর, ১৮৫২ সালে জর্জ ক্যামানও এই মডেলটির আরো সংস্কার করেন। নিয়ে আসেন উন্নততর সংস্করণ! এভাবেই সময়ের ঘূর্ণাবর্তে পরিবর্তন এসেছে স্টেথোস্কোপের গঠন-আকৃতিতে। তৈরি হয়েছে রকমফের।
বর্তমানে ব্যবহৃত স্টেথোস্কোপগুলো রকমফের অনেকটা এরকম-
- ইলেকট্রনিক স্টেথোস্কোপ: এ ধরণের স্টেথোস্কোপ দেহ থেকে আগত শব্দ-তরঙ্গকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপ দেয়। অতঃপর সেটিকে পাল্টে দেয় শক্তিশালী ও পরিষ্কার শব্দে।
- অ্যাকুইস্টিক স্টেথোস্কোপ: বেশিরভাগ ডাক্তারেরা মূলত এই স্টেথোস্কোপটিই অধিকতর ব্যবহার করেন। গোলাকার, মসৃণ চেস-পিসের মাধ্যমে কানে প্রবাহিত হয় রোগীর ভেতরকার স্পন্দন।
- নয়েজ রিডাকশন স্টেথোস্কোপ: নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এর কাজ কী- তাই না? হ্যাঁ, ঠিক তাই। এর মাধ্যমে চারপাশের অপ্রয়োজনীয় শব্দ আলাদা করা হয়। গ্রহণ করা হয় কেবল যথাযথ শব্দতরঙ্গ।
- রেকর্ডিং স্টেথোস্কোপ: এ স্টেথোস্কোপের সাহায্যে রোগীর হৃৎস্পন্দন রেকর্ড করা যায়, সংরক্ষণ করা যায় পরবর্তীতে চেকআপের জন্য।
- ফিটাল স্টেথোস্কোপ: মাতৃগর্ভের জরায়ুতে সদ্য ফোটা শিশুর মিহি স্পন্দন শুনতে খুবই চমৎকার কাজ করে এই স্টেথোস্কোপ!
পরিশেষে
১৯৬০ সাল। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষক ডেভিড লিটম্যানের হাত ধরে আসে সর্বশেষ নকশাকৃত উপযোগী স্টেথোস্কোপ, যার নামকরণও করা হয় তার নামেই– লিটম্যান স্টেথোস্কোপ। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য– এটি ওজনে হালকা, বহন করে আরো স্বচ্ছ ও নিখুঁত শব্দ। জানা যায়, এখন অবধি তুমুল জনপ্রিয় লিটম্যানের এই নান্দনিক স্টেথোস্কোপটি! সদ্য মেডিকেল কলেজে প্রবেশ করা শিক্ষার্থী এবং বয়োবৃদ্ধ ডাক্তারদের কাছেও সমান জনপ্রিয় শখের এই লিটম্যান স্টেথ।
সময় গড়িয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির সংস্পর্শে হাতে এসেছে নতুন ও আকর্ষণীয় স্টেথোস্কোপের পসরা। পালাবদল ঘটেছে এর নির্মাণশেলীতেও। ডাক্তার লেনেকের এই অনবদ্য সৃষ্টি আজও বয়ে চলছে মহানুভবতার অনন্য নিদর্শন। তার সৃষ্টি করে যাওয়া মহতী এই আবিষ্কার আজও সমানতালে কাজে লাগছে মেডিকেলের পরীক্ষণ দুনিয়ায়।
তার সম্মানে ১৯৪৯ সালে নির্মাণ করা হয় ছোট্ট এক বায়োপিক। যেখানে দেখানো হয়, তার নানাবিধ গবেষণাধর্মী কলাকৌশল, অতীতের সফল কর্মপ্রচেষ্টা। এমনকি এখনো আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহৃত বেশকিছু টার্ম লেনেকের সৃষ্টি। যেমন– Rhonchi, Egophony, Crepitance, Rales ইত্যাদি। ডাক্তার লেনেক দু’শো বছর আগেই করে গিয়েছেন এদের ব্যাখা-বিশ্লেষণ।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply