ইউটিউবে “মর্নিং রুটিন” ঘরানার ভিডিওগুলো অনেক জনপ্রিয় যেখানে ক্রিয়েটররা দেখান যে সকালে উঠে তারা ব্যায়াম করেন, ধ্যান করেন, নাস্তা করে পড়তে বসেন, কাজে যান – অর্থাৎ তারা সকালটা কতো প্রোডাক্টিভভাবে কাটান – এ কারণেই তারা জীবনে (ইউটিউবে) এতো সফল।
আমাদের সমাজে কম ঘুমিয়ে বেশি পরিশ্রম করাকে প্রশংসা করা হয়, হাসল কালচার (huscle culture) এর অংশ হিসেবে দেখা হয়। অন্য দিকে যারা প্রাকৃতিকভাবে দেরি করে ঘুমায়, দেরি করে ঘুম থেকে উঠে, তাদেরকে তীর্যক দৃষ্টিতে দেখা হয়। আমারা তো এই প্রবাদ জানিই, “Early to bed and early to rise/ Make a man happy, wealthy and wise”। তার মানে সমাজ ধরেই নিয়েছে যারা দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে, তারা আসলে অলস, এদের সমস্যা আছে।
অথচ আমাদের সবার সার্কাডিয়ান চক্র এক সময়ে শুরু হয় না। কারো কারো ক্ষেত্রে পূর্ণ সজাগ অবস্থা দিনের শুরুর দিকে আসে। একই কারণে তাদের আগে ঘুম পায়। এদেরকে আমরা “ভোরের পাখি” হিসেবে চিনি। তারা সকালে উঠেই কাজে নেমে পড়তে পছন্দ করেন। জনসংখ্যার প্রায় চল্লিশ শতাংশ মানুষই আসলে ভোরের পাখি। অন্যদিকে কিছু মানুষ একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠতে পছন্দ করেন, এ কারণে তারা রাত জাগেন। সমাজে এদেরকে “রাতের পেঁচা” হিসেবে ডাকা হয়। জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষই মূলত রাত জাগতে পছন্দ করেন। এদেরকে ভোরে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলেও দেখা যাবে তাদের মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। সমাজের বাকি ত্রিশ শতাংশ মানুষ আসলে ভোরের পাখি ও রাতের পেঁচার মাঝামাঝি জায়গায় পড়েন।
এই যে একজন পূর্ণবয়ষ্ক মানুষ কখন ঘুম থেকে উঠে, এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় ক্রোনোটাইপ। একজন মানুষের ক্রোনোটাইপ নির্ভর করে তার বংশগতির উপর। আপনি যদি রাতের পেঁচা হয়ে থাকেন, খুব সম্ভবত আপনার পিতা-মাতার মধ্যে অন্তত একজন (বা দুইজনই) রাত জাগতে পছন্দ করেন। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের সমাজ রাতের পাখিদের অন্যায্যভাবে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে।
প্রথমত, এদেরকে অলস বলে ট্যাগ দেয়া হয় কারণ তারা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে চায় না।
দ্বিতীয়ত, এদের এই ঘুম থেকে দেরিতে ওঠার বিষয়টা অন্যরা একটা “ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত” হিসেবে দেখে, যেন রাতের পাখিরা ইচ্ছে করেই দেরি করে ওঠে।
কিন্তু বিষয়টাতো এরকম নয় যে “রাতের পেঁচা” ক্রোনোটাইপেরা ইচ্ছে হলেই সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারবে! ডিএনএর বংশগতি সংকেত অনুযায়ী তাদের সার্কাডিয়ান ক্লকের পর্যায়কাল দেরিতে শুরু হয়। দেরিতে ঘুমানো আর দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং বংশগতির “ললাট-লিখন”।
সমস্যা হলো, আমাদের সমাজে কাজের শিডিউলটা তৈরি করেছে ভোরের পাখিদের জন্য। যেহেতু সমাজ ধরেই নিয়েছে সবাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়বে, তাই স্কুল-কলেজ অফিস-আদালত সব জায়গাতেই কাজের সময় আগে আগে শুরু হয়। এর ফলে ভোরের পাখিরা সুবিধা পেলেও সমস্যা হয় রাতের পেঁচাদের, বিশেষ কর সকালে তাদের কাজের কর্মক্ষমতা অনেক কম থাকে, মাথা তখনো খুলে নাই। ফলশ্রুতিতে একটু বেলা গড়িয়ে গেলে যখন তাদের কর্মক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকার কথা, তখনও তারা সকালের ঘুম ঠিক না হওয়ার সমস্যায় ভোগান্তিতে পড়েন। পাশাপাশি অফিসিয়াল শ্রমঘন্টাও তখন শেষের পথে। এসব কারণে রাতের পাখিরা ক্রমাগত ঘুম-বঞ্চনায় ভোগেন। তাদের ঘুম থেকে আগে উঠতে হয়, কিন্তু চাইলেও তারা আগে আগে ঘুমাতে পারেন না। এটা যেন একটা মোমবাতির দুইপাশে আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার মতো, তারা দিনের শুরু ও শেষ দুই সময়েই ভোগান্তিতে পড়েন। এ কারণে তাদের মধ্যে ডিপ্রেশন, টেনশন করা, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ ও স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকিও বেশি।
তবে এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নয়ন হচ্ছে। বিশেষ করে কোভিড অতিমারীর পর অফিসে বা ঘরে কাজের সময় নিয়ে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, অনেকেই নিজের মতো করে কাজের সময় ঠিক করার স্বাধীনতা পাচ্ছেন। তবে এখনো এই বৈষম্য দূর করতে আমাদের বহুপথ পাড়ি দিতে হবে।
কিন্তু আপনার মনে কি এই প্রশ্ন এসেছে যে কেন আমাদের ঘুমের সময়ের এতো বৈচিত্র্য তৈরি হলো? সবাই একসময়ে ঘুম থেকে উঠতে পারলেই তো মানুষের জন্য ভালো হতো, তাই না? হ্যাঁ, গত দুইশ বছর ধরে তৈরি হওয়া শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সমাজে সবাই একই সময়ে ঘুম থেকে উঠতে পারলে প্রোডাকশন সবচেয়ে বেশি হবে। কিন্তু কারখানা বা কৃষি বিপ্লবের অনেক আগ, বিবর্তনের বহু সময় ধরে মানুষ চরে বেড়িয়েছে বনে-জঙ্গলে-গুহায় শিকারী-সংগ্রাহক হিসেবে।
প্রথম বিশ্বের মানুষ তো বটেই, বাংলাদেশ সহ প্রায় সব জায়গায় একসাথে বিছানায় কেবল স্বামী-স্ত্রী কিংবা ভাই-বোন সর্বোচ্চ দুইজন ঘুমানোর রীতি। কিন্তু প্রস্তর-যুগের শিকারী-সংগ্রাহকের সময়ে আমরা ছোট ছোট গোত্রে একসাথে থাকতাম। মধ্যখানে হয়তো এক জায়গায় আগুন জ্বলতো, আর আশেপাশে অনেক মানুষ একসাথে ঘুমাতো। যদি আমরা ওই পরিস্থিতি চিন্তা করি, তাহলে সবাই একসাথে ঘুমাতে গেলে সেটা গোত্রের সবার জন্যই বিপদজ্নক। হিংস্র শ্বাপদ এসে কখন কাকে মেরে তুলে নিয়ে যায় সেই ভয় তো ছিলোই, পাশাপাশি শত্রু-গোত্রও আক্রমণ করতে পারে রাতের আঁধারে। এ কারণে, কিছু মানুষ আগে ঘুমাতে গেলে, আর কিছু মানুষ দেরিতে ঘুমালে পুরো গোত্রের জন্যই সেটা উপকারী। সবাই যদি গড়পড়তা আটঘন্ট করে ঘুমায়, কেউ একদম ভোরে উঠে, অন্যেরা যারা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছিলো তারা দেরিতে ঘুম থেকে উঠলেও রাত্রে আর ভোরে অন্তত চার থেকে ছয় ঘন্টা পাওয়া যাচ্ছে যখন কেউ না কেউ জেগে থাকছে। এই বিষয়টা ওই গোত্রের উপরে আক্রমণের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় অন্তত ৫০%। ঠিক এ কারণেই আমাদের ক্রোনোটাইপ আলাদা।
আমাদের এখন সময় এসেছে মানুষের মধ্যে ঘুমাতে যাওয়ার সময়ের যে বৈচিত্র্য, সে বিষয়ে সচেতন হওয়ার।
তথ্যসূত্র
Genetic Basis of Chronotype in Humans: Insights From Three Landmark GWAS. Sleep. 2016 Dec 9;40(2):zsw048. doi: 10.1093/sleep/zsw048
Why We Sleep: Matthew Walker
Leave a Reply