সমুদ্রের কোলে প্রথম প্রাণের স্পন্দন 


লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

পৃথিবীতে প্রথম সমুদ্র বা মহাসাগরের উৎপত্তির ধারণা পেতে আমাদের আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে চলে যেতে হবে। এই লেখায় মিলিয়ন এবং বিলিয়ন শব্দগুলো প্রায়শই আসবে। তাই সামনে আগানোর আগে তাদের ব্যাপ্তি সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা প্রয়োজন।  এক হাজারটি এক হাজার এ হয় এক মিলিয়ন, বা সহজ ভাষায় ১ মিলিয়ন = ১০ লক্ষ। একইভাবে এক হাজারটি এক মিলিয়ন এ হয় এক বিলিয়ন, বা অন্যভাবে ১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি। আমাদের মস্তিষ্ক সাধারণত এতো বড় মান নিয়ে সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারেনা। আমরা ১০ থেকে ১০০ মিটার, ১ থেকে ১০ কিলোমিটার, ৫ থেকে ৩০ মিনিট, ৩০ থেকে ৬০ বছর, কিংবা ৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ব্যাপারগুলো সহজে ধরতে পারি কেননা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই পরিমাপগুলো ঘুরে ফিরে বারবার চলে আসে। 

কিন্তু পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাস প্রায় অপরিমেয় বড় মাত্রায়। আবারো ফিরে যাই প্রথম মহাসাগর সৃষ্টির সময়ে। আমরা আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগের কথা বলছি। সময়ের হিসেবটা ঠিক কত? বোধগম্য তুলনা এভাবে দেয়া যায়, ধরা যাক, আপনি প্রতি সেকেন্ডে এক ডলার উপার্জন করছেন। এই হারে এক মিলিয়ন ডলার উপার্জন করতে আপনার সময় লাগবে প্রায় ১১ দিন। এবং এক বিলিয়ন ডলার উপার্জন করতে সময় লাগবে প্রায় ৩২ বছর! এবার চিন্তা করুন এক একটি ডলার আসলে এক একটি বছর এবং ঠিক এতো গুলো বছর পেছন ফিরে যান। অতীতের এই পৃথিবীতে আপনি দেখবেন এক বিশাল জলরাশি। উত্তাল, প্রমত্ত, অশান্ত, ক্ষুব্ধ। ভারী বর্ষণ। তপ্ত মাটি, তবে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যে ঠান্ডা। যেন তরল পানি জমা হতে পারে। 

কিশোর পৃথিবী

এই পানি পৃথিবীর তলদেশে জমা হতে শুরু করলে প্রথমদিকের সাগর এবং মহাসাগরের জন্ম হয়। ধীর প্রক্রিয়া, তবে নিশ্চিতভাবেই মহাদেশ এবং মহাসাগরগুলি একটি নির্দিষ্ট রূপ পাওয়া শুরু করেছিলো। এই সময়কালে টেকটোনিক প্লেটগুলোর ক্রিয়াশীলতার ফলে পৃথিবীর প্রাচীন মহাদেশগুলো বারবার একত্রিত ও বিভাজিত হয়। টেকটনিক প্লেট নিয়ে আমি পরবর্তী কোনো এক ব্লগে বিস্তারিত লিখবো। প্রায় তিন শ কোটি বছর আগে (৩ বিলিয়ন) বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট হ্রদ, জলাধার, এবং মহাসাগর একত্রিত হয়ে এক বিশাল জলরাশি গঠন করে। বিজ্ঞানীরা এই বিশাল জলরাশিকে নাম দিয়েছেন প্যানথালাসা (Panthalassa) [1]। প্যানথালাসা একটি গ্রিক শব্দ। শব্দটি এসেছে “প্যান (pan)”, যার অর্থ ‘সকল’ এবং “থালাসা (thalassa)”, যার অর্থ ‘সমুদ্র’। ১৯১২ সালে স্যার আলফ্রেড ভেগেনার তাঁর এক ক্লাস লেকচারে [2] প্রথমবারের মতো প্যানথালাসা এর ধারণা উপস্থাপন করেন (বলে রাখা ভালো, এই ক্লাস লেকচারটি তৎকালীন ভূতত্ত্ববিদদের পৃথিবী সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে। পরবর্তী ব্লগে এই লেকচারটি নিয়ে বিস্তারিত লেখা হবে)।    

প্যানথালাসা তখন কিশোর পৃথিবীর একমাত্র মহাসাগর। ৩০০ কোটি বছর আগে এখনকার মতো পাঁচটি মহাদেশ ছিল না [3]। বরং একটি একত্রে আবদ্ধ মহাদেশ ছিল যারা নাম “প্যানজিয়া”। প্যানজিয়াকে বলা হয় সুপার কন্টিনেন্ট। প্যানজিয়াই পরবর্তীতে ভেঙ্গে আজকের প্রচলিত মহাদেশগুলো (এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা) সৃষ্টি করে। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের জানাশোনা এই পাঁচটি মহাদেশও কয়েক কোটি বছরের মধ্যে অন্যরকম রূপ নিবে। কারণ পৃথিবীর উপরিভাগ স্তর (টেকটনিক প্লেট) সর্বদা গতিশীল। প্যানজিয়া ছিল একটি “একক মহাদেশ” এবং প্যানথালাসা মহাসাগর একে ঘিরে পৃথিবীর প্রায় ৭০-৮০% পৃষ্ঠতল দখল করেছিল। সারমর্ম এই যে,  প্যানথালাসার সৃষ্টি পৃথিবীর টেকটনিক গতিশীলতা এবং আদিযুগের জলবায়ুর স্বাভাবিক বিবর্তনের ফল।

ছবি- আজ থেকে ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে পিছে ফিরে গেলে আমরা পৃথিবীর এক সম্পূর্ণ নতুন ভৌগোলিক অবস্থা লক্ষ্য করবো। প্যানজিয়া হলো সেই সুপার কন্টিনেন্ট যেখানে সকল মহাদেশ (ভূ-স্থল) একত্রিত ছিল। আজ থেকে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর পরে আবারো সবগুলো মহাদেশ একত্রিত হয়ে নতুন একটি প্যানজিয়া সৃষ্টি করবে। ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অ্যালেক্সান্ডার লুইস।

 এই নতুন পৃথিবীতে এই সময়ে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে! প্রথমবারে মতো পাওয়া যায় প্রাণের স্পন্দন! প্রাণ সৃষ্টির জন্য অবশ্যই এক বিশাল জলরাশির প্রয়োজন হতো [4]। পানি তাপমাত্রা ধরে রাখে, তাপমাত্রাকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে। পানি একটি অসাধারণ দ্রাবক। জীবন সৃষ্টির জন্য দরকারি রাসায়নিক দ্রব্য পানিতে সহজে মিশ্রিত হতে পেরেছিল। পানি আকর্ষণীয় সব রাসায়নিক বিক্রিয়ার আঁতুড়ঘর। পুষ্টি থেকে শুরু করে বর্জ্য, সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ঘটার জন্য যে নিখুঁত পরিবেশ দরকার, সে সময়ের সমুদ্রে তা ছিল। এ যেন জীবনের উল্লাসধ্বনি শোনার জন্য প্রহর গুনতে থাকা মমতাময়ী ঢেউ এর অপেক্ষা। 

পৃথিবীর অবস্থান

প্রাণ সৃষ্টির গল্পের আগে আরেকটি ব্যাপারে আমাদের মনোযোগ রাখা প্রয়োজন। তা হলো সৌরজগতে পৃথিবীর অবস্থান। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ১৫ কোটি কিলো। পৃথিবীর অবস্থান যদি একটু কাছে শুক্র গ্রহের অবস্থানে (গড় দূরত্ব ১১ কোটি কিলোমিটার) হতো তাহলে সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে সকল পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যেতো। ভয়ংকরভাবে বিষিয়ে ওঠা বায়ুমণ্ডল, কঠোর পরিবেশ, তীব্র বায়ুচাপ, এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রাধান্যতায় জীবন টিকে থাকা সম্ভব হতো না। একইভাবে একটু দূরে মঙ্গল গ্রহের কাছে (গড় দূরত্ব ২৩ কোটি কিলোমিটার) পৃথিবীর অবস্থান হলেও প্রচণ্ড ঠান্ডা, ভৌগোলিক চৌম্বকক্ষেত্রের অনুপস্থিতি, বিষাক্ত গ্যাস, এবং প্রখর জলবায়ুর কারণে জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব হতো না। পৃথিবীর অবস্থানকে বিজ্ঞানীরা তাই বাসযোগ্য অঞ্চল বা গোল্ডিলক জোন হিসেবে অভিহিত করেছেন [5]। তার সবচেয়ে বড় কারণ, পৃথিবী উপহার দিতে পারে জীবনের জন্য  উপযুক্ত পরিবেশ এবং দিগন্ত বিস্তৃত তরল পানির জলধি। 

ছবি- গোলডিলক জোনের ধারণা। মহাবিশ্বে পৃথিবীর মতো আরও অগণিত গ্রহ আছে যারা এই বসবাসযোগ্য অঞ্চলের মধ্যে থেকে তার সূর্যকে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা আজও জানি না তাদের মাঝে কত সহস্র গ্রহে জীবনের আনন্দময় কোলাহলের গুঞ্জন আছে।

পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি, বিকাশ এবং বিবর্তন, খুব সম্ভবত, সমুদ্রেই সর্বপ্রথম পরিলক্ষিত হয়। আণবিক পর্যায়ে, এখানে প্রাণের ভিত্তি হলো কার্বন (পর্যায় সারণির ষষ্ঠ মৌল)। কার্বনের বেশ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য একে প্রাণের মৌলিক ভিত্তি ধরা হয় [6]। উদাহরণস্বরূপ, কার্বন স্থিতিশীল। কার্বন অন্যান্য পরমাণুর সাথে ভেঙ্গে না গিয়ে দীর্ঘ শিকলাকার জটিল যৌগ তৈরি করতে পারে। প্রাণ সৃষ্টির মূল মালমশলা হচ্ছে প্রোটিন, ডিএনএ, শর্করা, লিপিড (চর্বি)। এই জটিল জৈবযোগগুলোর ভিত্তি আসলে কার্বন সৃষ্ট যৌগ। সহজ ভাষায়, আমরা যাদের এবং যা খাই, এবং আমাদের খাদ্যের খাদ্যরা – সবাই মূলত কার্বনভিত্তিক।

প্রশ্ন আসে, এতো কার্বন পৃথিবীতে কোত্থেকে এলো? সাম্প্রতিক গবেষণা বলে, কোটি বছর আগে ধূমকেতু, গ্রহাণু, উল্কা, এবং মহাজাগতিক ধুলিকণার মাধ্যমে পৃথিবীতে বেশিরভাগ কার্বন যৌগ আসে। তরুণ সমুদ্র তখন যেন জৈব এবং অজৈব যৌগের সমুদয় প্রণালীর এক রান্নাঘর।

ছবি- শিল্পীর তুলিতে প্রায় ৪ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়া এক গ্রহাণু। অনেক বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, প্রাণ এর রেসিপি (প্রণালি) এই পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে। দার্শনিকভাবে, তাহলে আমরা সবাই কি “এলিয়েন”? 

গবেষণাগারে “প্রাণ” 

এবারে পাঠকের কাছে একটি প্রশ্ন, যদি আমরা একটি অত্যাধুনিক গবেষণাগারে পৃথিবীর অতীত অবস্থার বিভিন্ন জৈব গ্যাস, দ্রব, দ্রাবকের মিশ্রণ রেখে, সেই সময়ের আবহাওয়া, আলো, তাপ, ঝড়ো পরিবেশ, বজ্রপাত যোগ করি, তাহলে কী জীবদেহের মূল মালমশলাগুলো তৈরি করা সম্ভব?   

মজার ব্যাপার হলো, এই গবেষণা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে! ১৯৫৩ সালে স্ট্যানলি মিলার এবং হ্যারল্ড ইউরি জীবনের উৎপত্তি নিয়ে আমাদের ধারণা দিতে এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেন [7]। তাঁরা একটি পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান যে প্রাথমিক পৃথিবীর পরিবেশে বিদ্যমান অজৈব যৌগ থেকে কিছু “সহজ” জৈব যৌগ তৈরি সম্ভব। বিখ্যাত এই “ইউরি-মিলার পরীক্ষা” আমাদের ধারণা দেয় যে অজৈব কিছু মৌল থেকে উপযুক্ত পরিবেশে শর্করা এবং প্রোটিন (অ্যামিনো অ্যাসিড) সংশ্লেষণ সম্ভব। 

ছবি- রসায়নবিদ স্ট্যানলি মিলার তার নকশাকৃত ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম এর সামনে। ছবিটি ১৯৮০ সালে তোলা। ছবি কৃতজ্ঞতাঃ রজার রেসমেয়ার।

কিন্তু এই যুগান্তকারী পরীক্ষা কি “প্রাণ” সৃষ্টি করতে পেরেছে? না। বরং সর্বোচ্চ তাঁরা কিছু রাসায়নিক যৌগ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর মাত্র। তার মানে কি এই পরীক্ষাটি (বা এ ধরনের সকল গবেষণা) মূল্যহীন? অবশ্যই না! সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ যেই ধারণাটি আমরা পাই তা হলো, জীবনের সৃষ্টি রসায়ন এবং পদার্থবিদ্যা দিয়ে আবদ্ধ। এমন কোনোভাবে জীবন সৃষ্টি হবেনা যা গতিবিদ্যা, স্থিতিবিদ্যা, গণিত, এবং ভৌত রসায়নের সীমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এককোষী অ্যামিবা থেকে শতকোষী হাইড্রা, ছোট্ট বিড়ালছানা থেকে বৃহদাকায় আফ্রিকান হাতি, সবাই জীবনসূত্রের এক ছাতার নিচে। এই পরীক্ষা থেকে আমরা আরও ব্যাখ্যা করতে পারি যে সহজ, জীবন্ত, নিজেই নিজের সংখ্যা বাড়াতে পারে এমন অণুসমষ্টি অতীত সমুদ্রের কোনো এক প্রান্তরে পৃথিবীর প্রায় সকল প্রাণের আদিমতম “পূর্বপুরুষ”।   

সমুদ্রের অগভীর তলে আলোর স্পর্শে ধুঁকতে থাকা এককোষী জীবন থেকে আজ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র জীবনের কোলাহল। এই বিবর্তনের সূত্রপাত এক ধরনের বিশেষ জৈব-সংশ্লেষণ থেকে। গ্রহবিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, সম্ভবত সেই সময়ে ঘন অস্বচ্ছ মেঘের জন্য সূর্যের বেশিরভাগ অতিবেগুনী রশ্মি বাধাপ্রাপ্ত হতো। যার ফলে জটিল অণু গঠন সম্ভব হয়েছিলো, যা পরবর্তীতে খুব প্রাথমিক স্তরের জীবনের রূপ নেয়। এটা ধারণা করা হয়ে থাকে যে, একদম প্রথম দিকের জীবন শুরু হয়েছিলো কর্দমাক্ত এলাকায় কিংবা পাইরাইট ক্রিস্টাল (স্ফটিক) সমৃদ্ধ ভূমিতে। কারণ এই জায়গাগুলোতে প্রচুর খনিজ (মিনারেল) পদার্থের উপস্থিতি ছিল [8]।   

সরল প্রাণ 

প্রশ্ন হলো, বর্তমানে ঠিক একই উপায়ে উপরে উলেখিত জায়গাগুলোতে কি প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব? এই প্রশ্নটি গুরত্বপূর্ণ কেননা যদি আমরা দেখি আজও এই পরিবেশ পৃথিবীর আনাচ-কানাচে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবন সৃষ্টি করে যাচ্ছে, তাহলে জীবন রহস্য সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অতীতের সেই জৈব-সংশ্লেষন আজকের দিনে ঘটা প্রায় অসম্ভব। এর তিনটি প্রধান কারণ আছে। প্রথমত, আজকের পৃথিবীর সবুজ গাছ-গাছড়া বায়ুতে প্রচুর অক্সিজেন যোগ করেছে। অতীতের পৃথিবী এতোটা অক্সিজেন-সমৃদ্ধ ছিলোনা। দ্বিতীয়ত, এই অক্সিজেনের (O2) একটি রূপান্তর ওজোন (O3) গ্যাস হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে একটি প্রতিরক্ষামূলক ওজোন স্তর সৃষ্টি করেছে, যেটা অতীতে অনুপস্থিত ছিল [9]। এবং তৃতীয়ত, যদি বা প্রাথমিক স্তরের প্রাণ সৃষ্টি হয় ও, এটা জানা আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে কারণ ছোট অন্যান্য এককোষী বা বহুকোষী জীবকণা তাদের প্রায় তৎক্ষণাৎ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবে। 

ছবি- একটি ব্যাকটেরিয়া-সদৃশ জীবের জীবাশ্ম (শিল্পীর পুনর্গঠনের সাথে)। এরা আলোক সংশ্লেষণ করত এবং বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন মুক্ত করত। এটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম জীবাশ্মগুলোর মধ্যে একটি। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুত্রাকৃতি জীবাশ্মটি উত্তরপশ্চিম অস্ট্রেলিয়া থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এর বয়স প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর।

ঠিক কবে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল? এই প্রশ্ন অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং তা আজও বহাল। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াতে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন ফসিল (জীবাশ্ম) এর সন্ধান মিলেছে। প্রায় সাড়ে তিন শ কোটি বছর আগে এখানে ব্যাকটেরিয়ার মতো বহুকোষী জীবন (স্ট্রোমাটোলাইট) স্বাধীনভাবে বসবাস করতো [10]। এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে, আরও সরল প্রাণ এরও বহু আগে থেকে পৃথিবীতে বিদ্যমান। খুব সাম্প্রতিক সময়ের আরেক গবেষণায় গ্রিনল্যান্ডের আকিলা দ্বীপে প্রাগৈতিহাসিক কিছু পাথরে কার্বন-ভিত্তিক অবশিষ্টাংশের চিহ্ন মিলেছে। গবেষকদের মতামত হলো প্রায় ৩.৮৫ বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হওয়া এই জৈব স্বাক্ষর একমাত্র জীবনের উপস্থিতিতেই সম্ভব। 

ছবি- প্রায় ৪৮৮ মিলিয়ন বছর আগে ক্যাম্ব্রিয়ান যুগ পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিবর্তনীয় বিস্ফোরণের সময় হিসেবে পরিচিত। এই যুগে বিবর্তনের এমন অবিশ্বাস্য গতি দেখা দেওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ—উষ্ণ জলবায়ু, সাগরে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি, এবং বিস্তৃত অগভীর সমুদ্র-ভূমি সৃষ্টি। এই সময়টায় প্রায় সমগ্র পৃথিবী জুড়ে প্রাথমিক স্তরের সামুদ্রিক প্রাণী এবং উদ্ভিদের দেখা মিলে। ছবি কৃতজ্ঞতাঃ স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশন।

পৃথিবী এবং জীবন – একই সাথে বড় হয়েছে। শুধু তা-ই না, একজন আরেকজনকে নিগূঢ়ভাবে প্রভাবিত করেছে। সত্যি বলতে আমরা আজও জানি না ঠিক কবে, কোথায়, কেন, এবং কীভাবে জীবন সৃষ্টি হলো। তবে সকল গবেষণালব্ধ ফলাফল আঙুল তোলে সমুদ্রের দিকে। জীবনের প্রথম প্রশ্বাসকে অগণিত ঢেউয়ের মমতায় জড়িয়ে নিয়েছিল ঊর্মিমালী। এক দয়াময়ী মা- তার কোমল বুকে আশ্রয় দিয়েছিল নবীন প্রাণকে, সমস্ত মহাজাগতিক প্রতিকূলতার মধ্যে তাকে রক্ষা করে। পৃথিবীর ইতিহাস বহু বছর এগিয়ে গেছে, কিন্তু আজও সমুদ্র সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জীবনের নিবাস। কালের বিবর্তনে জীবন উন্নত হয়েছে। “মানুষ” এর মতো বুদ্ধিমান অথচ আত্ম-বিধ্বংসী, লোভী এবং আগ্রাসী প্রাণী পৃথিবীর ওপর দিয়ে হেঁটেছে। বিলুপ্ত করে দিয়েছে বহু প্রাণ, প্রাণী, প্রজাতি, এবং গোত্র। তবু, সমুদ্রের প্রতিজ্ঞা জীবনকে রক্ষা করা। গভীর অন্ধকার গহ্বর, অগম্য খাদ আর অজানা বিস্তৃতি—এগুলো সব যেন তার নিজেরই সৃষ্টি করা এক আশ্রয়স্থল, যেখানে মানুষ তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়েও পৌঁছাতে অক্ষম। 

তথ্যসূত্র

[1] Boschman, Lydian M., and Douwe JJ Van Hinsbergen. “On the enigmatic birth of the Pacific Plate within the Panthalassa Ocean.” Science Advances 2.7 (2016): e1600022.

[2] Sousa, Cristina. “Bridging darwin’s origin of species & wegener’s origin of continents and oceans: using biogeography, phylogeny, geology & interactive learning.” The American Biology Teacher 78.1 (2016): 24-33.

[3] Stampfli, G. M., et al. “The formation of Pangea.” Tectonophysics 593 (2013): 1-19.

[4] Lane, Nick, John F. Allen, and William Martin. “How did LUCA make a living? Chemiosmosis in the origin of life.” BioEssays 32.4 (2010): 271-280.

[5] O’Keefe, James H., Evan L. O’Keefe, and Carl J. Lavie. “The goldilocks zone for exercise: not too little, not too much.” Missouri medicine 115.2 (2018): 98.

[6] McClendon, John H. “The origin of life.” Earth-Science Reviews 47.1-2 (1999): 71-93.

[7] Parker, Eric T., et al. “Conducting miller-urey experiments.” Journal of visualized experiments: JoVE 83 (2014).

[8] Graham, U. M., and Hiroshi Ohmoto. “Experimental study of formation mechanisms of hydrothermal pyrite.” Geochimica et Cosmochimica Acta 58.10 (1994): 2187-2202.

[9] Horneck, Gerda. “Ozone Layer.” Encyclopedia of Astrobiology. Berlin, Heidelberg: Springer Berlin Heidelberg, 2023. 2232-2234.[10] Riding, Robert. “The term stromatolite: towards an essential definition.” Lethaia 32.4 (1999): 321-33

লেখাটি 27-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading