মানুষের যত পূর্বপুরুষ (পর্ব-৩)


লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছরের ইতিহাস গেঁথে রয়েছে পৃথিবীর বুকে। এই সুদীর্ঘ সময়ে বহু উত্থান পতন হয়েছে পৃথিবীর। সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়েছে বহু প্রাণের। বিবর্তিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী। সাড়ে তিনশো কোটি বছর আগে প্রথম জীবের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে প্রাণের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে এককোষী থেকে বহুকোষী প্রাণীর উদ্ভবের মাধ্যমে এবং প্রজননের বিবর্তনের মাধ্যমে প্রাণীকূলে ব্যাপক বৈচিত্র‍্য সৃষ্টি হয়। একসময় উদ্ভব হয় মাছের। সেই মাছেরা উঠে আসে ডাঙায়। সৃষ্টি করে সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ীদের। আর এই স্তন্যপায়ীদের অন্যতম সংস্করণ হলো মানুষ। হ্যাঁ, আমাদের আশেপাশে যে প্রচুর মানুষ দেখতে পাই এরা সবাই স্তন্যপায়ী; পাশাপাশি একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। সেই প্রজাতির নাম ‘হোমো সেপিয়েন্স’। বর্তমানে মানুষের একটিমাত্র প্রজাতি থাকলেও একসময় কিন্তু ১৫-২০ প্রজাতির মানুষ ঘুরে বেড়াতো পৃথিবীর বুকে। তারা শিকার করতো, চিত্রকর্ম তৈরি করতো, অবসর সময়ে গল্পগুজবও করতো। এভাবে একসময় ধীরে ধীরে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়, রেখে যায় বিবর্তিত নতুন প্রজাতি। মানুষের এই পূর্বপুরুষ প্রজাতি নিয়েই আমাদের এই সিরিজ। সিরিজের অন্তিম খণ্ডে এসে পড়েছি আমরা। বাকি থাকা কিছু মানব প্রজাতির গল্প বলেই শেষ করবো ‘মানুষের যত পূর্বপুরুষ’ সিরিজটি। চলুন শুরু করা যাক।

হোমো লংগি

১৯৩০-এর দশকে উত্তর-পূর্ব চীনের হারবিন শহরে নির্মাণ কাজ চলাকালে শ্রমিকরা খুঁজে পান এক অদ্ভুত মানুষের খুলি। তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে খুলি দীর্ঘকাল গোপনে রয়ে যায়। প্রায় ৮০ বছর পর, ২০১৮ সালে, এটি চীনা জীবাশ্মবিদ জি চিয়াং-এর হাতে এসে পৌঁছায়। তিনি ও তাঁর দল বিশ্লেষণ করে দেখেন – এটি প্রায় দেড় থেকে তিন লাখ বছরের পুরোনো। এর আকার বড়, চোখের কোটর গভীর, তবে আকৃতি আধুনিক মানুষের মতো। তারা এটির নাম দেন Homo longi বা হোমো লংগি, যার মানে “ড্রাগন মানব”। এই আবিষ্কার চমকে দেয় গোটা বিজ্ঞানসমাজকে। কারণ, এর বৈশিষ্ট্য নিয়ান্ডারথাল বা ডেনিসোভানদের থেকেও আলাদা। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন – এই ড্রাগন মানব হতে পারে আমাদের আধুনিক প্রজাতির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

ছবিঃ হোমো লংগি

হোমো লংগিদের খুলির গঠনগত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে নিম্ন ও দীর্ঘায়িত খুলি, পুরু ভ্রূকুটি, প্রশস্ত চোখের কোটর, বড় নাসারন্ধ্র এবং সমতল মুখমণ্ডল। এদের মস্তিষ্কের আয়তন প্রায় ১,৪২০ ঘন সেন্টিমিটার, যা আধুনিক মানুষ এবং নিয়ান্ডারথালের মস্তিষ্কের আকারের মধ্যে পড়ে। এর দাঁতগুলো বড় এবং মজবুত, যা শক্ত খাবার চিবানোর জন্য উপযোগী। অনেক বিজ্ঞানী এদেরকে ডেনিসোভানদের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করেন, যদিও জিনগত বিশ্লেষণ ছাড়া তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। এই প্রাণীটির খুলির বৈশিষ্ট্যগুলো মধ্য প্লাইস্টোসিন যুগের অন্যান্য চীনা নমুনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেমন দালি এবং হুয়ালং গুহার নমুনা। তবে, অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে কিছু গবেষক এটিকে একটি নতুন প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

হারবিন খুলির আশেপাশের ভূতাত্ত্বিক স্তর থেকে পাওয়া জীবাশ্মগুলো ইঙ্গিত দেয় যে হোমো লংগি এমন একটি পরিবেশে বাস করত যেখানে বড় হরিণ, বন্য ঘোড়া, এল্ক, মহিষ, বাদামী ভাল্লুক, বাঘ, গুহা সিংহ, উলি ম্যামথ এবং উলি গণ্ডারের মতো প্রাণীরা সহাবস্থান করত।  যদিও বেশিরভাগ বিজ্ঞানীর ধারণা এটা মানুষের নতুন আত্মীয় প্রজাতি, তবে এখনও বিতর্ক চলছে – এটা নতুন প্রজাতি, না কি ডেনিসোভানদেরই একটি রূপ? এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গবেষণাই দেবে।

হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস

নিয়ান্ডারথালরা (Homo neanderthalensis) ছিল প্লাইস্টোসিন যুগের বাসিন্দা। একটি বিলুপ্ত মানব প্রজাতি, যারা ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় প্রায় চার লাখ থেকে চল্লিশ হাজার বছর পূর্বে বসবাস করেছিল। তাদের নামকরণ করা হয়েছে জার্মানির নিয়ান্ডার উপত্যকার নামানুসারে, যেখানে প্রথম তাদের জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়। মানুষের সব প্রজাতির মধ্যে এদের ফসিলই সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়। ১৮৫৬ সালে জার্মানির নিয়ান্ডার উপত্যকার একটি গুহায় এদের কিছু জীবাশ্ম পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা শুরুতে এই জীবাশ্মগুলোকে বিকৃত গঠনের মানুষের দেহাবশেষ মনে করলেও পরবর্তীতে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানব প্রজাতি হিসেবে নিজের স্থান করে নেয়। ধারণা করা হয়, নিয়ান্ডারথালরা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম এশিয়ায় প্রায় চার লাখ বছর আগে আবির্ভূত হয় এবং প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

নিয়ান্ডারথালদের দেহ গঠন ছিল শক্তপোক্ত। তুলনামূলকভাবে খাটো হলেও শরীর চওড়া ও পেশীবহুল ছিল। এই গঠন তাদের বরফাচ্ছন্ন ও ঠান্ডা পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করত। এদের খুলির গঠন আধুনিক মানুষের চেয়ে আলাদা ছিল – বিশেষ করে ভ্রু ছিল মোটা এবং কপালের উপর দিয়ে প্রসারিত। পুরুষদের গড় উচ্চতা ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট এবং নারীদের ৫ ফুট ১ ইঞ্চি। তারা পাথরের তৈরি সরঞ্জাম, অস্ত্র এবং আগুন ব্যবহারে পারদর্শী ছিল। অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, নিয়ান্ডারথালরা নিজেদের মৃতদের সমাধি দিত, শিকার করত এবং গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন করত। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে গুহাচিত্র অঙ্কন ও অলংকার ব্যবহার করত বলে ধারণা করা হয়, যা তাদের চিন্তাশক্তি ও সাংস্কৃতিক চেতনার ইঙ্গিত দেয়।

ছবিঃ হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস

কিছু গবেষণার দাবী, নিয়ান্ডারথালদের ভাষা বোঝার এবং ব্যবহারের ক্ষমতা ছিল। কানের গঠন এবং মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশের বিকাশ থেকে অনুমান করা হয় যে তারা মৌখিক ভাষায় যোগাযোগ করতে পারত। ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায়, আধুনিক মানুষের জিনোমে ১-২ শতাংশ নিয়ান্ডারথালের জিন রয়েছে, অর্থাৎ আধুনিক মানুষদের সঙ্গে এদের আন্তঃপ্রজনন ঘটেছিল। এটি বিশেষভাবে ইউরেশিয়ার মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায়। নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তির পেছনে বিভিন্ন কারণের কথা বলা হয় – যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, আধুনিক মানুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, সংক্রমণ রোগ এবং ধীরে ধীরে আধুনিক মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে বিলীন হয়ে যাওয়া। এই প্রজাতির গবেষণা এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং প্রতিনিয়ত তাদের জীবনধারা ও মানসিক সক্ষমতা নিয়ে নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে, যা আমাদের প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে আশা করা যায়। ২০২২ সালে এই নিয়ান্ডারথালদের নিয়ে গবেষণার ফলেই বিজ্ঞানী ‘সাভান্তে পাবো’ নোবেল পুরস্কার পান।

হোমো লুজোনেনসিস

২০০৭ সালে ফিলিপাইনের লুজোন দ্বীপের ক্যালাও গুহায় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা একটি পায়ের হাড়ের জীবাশ্ম আবিষ্কার করেন, যা প্রাথমিকভাবে আধুনিক মানুষের বলে মনে করা হয়েছিল। পরবর্তীতে, ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আরও ১২টি জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়, যার মধ্যে দাঁত, হাত ও পায়ের আঙুলের হাড় এবং পায়ের হাড় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নমুনাগুলোর অনন্য শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে বিজ্ঞানীরা হোমো লুজোনেনসিসকে একটি নতুন প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করেন। নতুন এই প্রজাতির আবিষ্কার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি মানব বিবর্তনের ইতিহাসে আরো একটি নতুন শাখা যুক্ত করে। আবিষ্কৃত দেহাবশেষের মধ্যে ছিল কয়েকটি দাঁত, হাত ও পায়ের হাড় এবং একটি উরুর হাড় – যেগুলো অন্তত তিনটি ভিন্ন মানুষের দেহাংশ বলে ধারণা করা হয়। এসব হাড় প্রায় ৫০,০০০ থেকে ৬৭,০০০ বছরের পুরনো।

হোমো লুজোনেনসিস এর শারীরিক গঠন ছিল চমকপ্রদভাবে অনন্য। তাদের দাঁত ছোট হলেও বেশ জটিল গড়নের ছিল, এবং প্রাচীন কিছু বৈশিষ্ট্য বহন করত যা আধুনিক মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় না। তাদের আঙুল ও পায়ের হাড় বাঁকা ছিল, যা ইঙ্গিত করে যে তারা হয়তো গাছে চড়ার মতো দক্ষতা রাখত – এটি প্রাচীন হোমিনিনদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এর ফলে ধারণা করা হয়, তারা হয়তো এক ধরনের “প্রাচীনতর শরীরের গঠন” বজায় রেখেছিল, যদিও তারা আধুনিক মানুষের সঙ্গে সমসাময়িক সময়কালে জীবিত ছিল।

ছবিঃ হোমো লুজুনেনসিস

হোমো লুজোনেনসিসের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই, তবে ধারণা করা হয় যে তারা হোমো ইরেক্টাস বা আরও প্রাচীন কোনো মানব প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়েছে। লুজোন দ্বীপে প্রায় ৭৭১,০০০ থেকে ৬৩১,০০০ বছর পূর্বে হোমিনিনদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা নির্দেশ করে যে এই দ্বীপে প্রাচীন মানবদের বসবাস দীর্ঘকাল ধরে ছিল এবং তারা আলাদা ভাবে বিবর্তিত হয়েছিল।

এই প্রজাতির আবিষ্কার প্রমাণ করে যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছিল মানব বিবর্তনের এক বৈচিত্র্যময় কেন্দ্র, যেখানে একাধিক মানব প্রজাতি একসঙ্গে বসবাস করত। হোমো লুজোনেনসিস প্রজাতির আবিষ্কার আমাদের এও জানায় যে, মানুষের পূর্বপুরুষরা বেশ আগেই সমুদ্র পেরিয়ে দ্বীপাঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিল, যা আগের ধারণাগুলোর চেয়েও অনেক বেশি জটিল ও প্রগতিশীল অভিযোজন প্রক্রিয়ার সাক্ষ্য বহন করে।

হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস

২০০৩ সালের গ্রীষ্মকাল। ইন্দোনেশিয়ার পূর্বের ছোট্ট দ্বীপ ফ্লোরেসের গভীরে লিয়াং বুয়া (Liang Bua) নামক একটি প্রাচীন চুনাপাথরের গুহার ভিতরে কাজ করছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ও ইন্দোনেশিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদদের একটি দল। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মাইকেল জে. মোরউড এবং র‍্যাডিও কার্বন ডেটিং বিশেষজ্ঞ রিচার্ড রবার্টস।

তাদের লক্ষ্য ছিল এখানকার প্রাগৈতিহাসিক মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে নতুন তথ্য উদ্ধার করা। কিন্তু তারা তখনও জানতেন না—এই খনন কাজ বদলে দেবে মানবজাতির ইতিহাসচর্চার দৃষ্টিভঙ্গি।

গুহার ভিতর খনন করতে করতে একদিন তাঁরা খুঁজে পান একটি অদ্ভুত আকৃতির মাথার খুলি। প্রথম দেখায় এটিকে শিশুর খুলির মতো মনে হলেও, বিশ্লেষণ করে দেখা গেল এটি একটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের, তবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকৃতির—মাত্র ৩ ফুট লম্বা একজন মানুষের দেহের অংশ! এরপর তারা আরও কিছু হাড়গোড় ও দাঁতের নমুনা খুঁজে পান। বয়স নির্ধারণের জন্য ব্যবহার করা হয় রেডিওকার্বন, ইউরেনিয়াম-সিরিজ, লুমিনেসেন্স এবং ইলেকট্রন স্পিন রেজোন্যান্স (ESR) টেস্ট। ফলাফল জানাল—এই “নতুন” প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল প্রায় ৩৮,০০০ বছর আগে থেকে ১৮,০০০ বছর আগ পর্যন্ত

পরবর্তীতে এই ক্ষুদ্রকায় মানুষদের নাম দেওয়া হলো Homo floresiensis—দ্বীপটির নাম অনুসারে। গবেষকরা ভালোবেসে তাদের ডাকতে লাগলেন “হবিট”, টলকিনের সেই ছোটখাটো, নিরীহ চরিত্রের মতো দেখতে বলেই। হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিসের গড় উচ্চতা ছিল মাত্র ১.১ মিটার (প্রায় ৩ ফুট ৭ ইঞ্চি) এবং তাদের মস্তিষ্কের আকার প্রায় ৪২৬ ঘন সেন্টিমিটার, যা আধুনিক মানুষের তুলনায় অনেক ছোট ছিল। হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস মূলত ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি এবং মাছ শিকার করত। তাদের গুহার চারপাশে ছড়িয়ে ছিল প্রাচীন হাতির মতো প্রাণী স্টেগোডন, কমোডো ড্রাগন, ও নানা ধরনের পাথরের তৈরি সরঞ্জাম। সবকিছুই সাক্ষ্য দিচ্ছিল—এই ক্ষুদ্র মানবেরা ছিল দক্ষ শিকারি এবং বুদ্ধিমান যন্ত্র ব্যবহারকারী।

ছবিঃ হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস

কিছু গবেষক মনে করেন যে হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস মূলত হোমো ইরেক্টাসের একটি ক্ষুদ্রাকৃতির রূপ হতে পারে, যা দ্বীপীয় পরিবেশের কারণে বিকশিত হয়েছে। এই ধারণাটি দ্বীপীয় বামনত্ব (Island Dwarfism) নামক বিবর্তনীয় ঘটনাকে সমর্থন করে, যেখানে বড় প্রাণীরা ছোট আকারে বিকশিত হয় খাদ্য ও সম্পদের সীমিততার কারণে। অন্যদিকে, কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে এটি হোমো হাবিলিস বা আরও প্রাচীন কোনো মানব পূর্বপুরুষের বংশধর হতে পারে, যারা আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত হয়েছিল। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হল—এই হবিটরা হোমো সেপিয়েন্স , অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে যুগপৎ একই সময়ে বেঁচে ছিল, কিন্তু ঠিক কিভাবে দু’টি প্রজাতির মধ্যে সম্পর্ক ছিল, তা আজও রহস্য।

হোমো সেপিয়েন্স

পরিচয়পর্বের একেবারে শেষে এসে পড়েছি আমরা। আর এবার আমাদেরই নিজেদের সাথে পরিচয় করে দেওয়ার পালা। বলছিলাম হোমো সেপিয়েন্স তথা বর্তমান মানুষদের কথা। হোমো সেপিয়েন্স হল আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম, যার অর্থ “বুদ্ধিমান মানুষ”। এই প্রজাতির উৎপত্তি আফ্রিকায় প্রায় ৩ লাখ বছর আগে হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। হোমো সেপিয়েন্স ছিল পূর্ববর্তী মানব প্রজাতিগুলোর তুলনায় শারীরিকভাবে তুলনামূলক হালকা গঠনের, তবে তাদের মস্তিষ্ক ছিল অত্যন্ত জটিল এবং উন্নত। এই উন্নত মস্তিষ্কের কারণে তারা ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্ম, ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি লাভ করে। হোমো সেপিয়েন্স-এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের অভিযোজন ক্ষমতা ও সামাজিক আচরণ। তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করত এবং শিকার, কৃষিকাজ, নৌকা নির্মাণ, আগুনের ব্যবহার, ও সরঞ্জাম তৈরিতে পারদর্শী ছিল।

ছবিঃ প্রাচীন হোমো সেপিয়েন্স

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, হোমো সেপিয়েন্স প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে আফ্রিকা থেকে অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিস্তারকালেই তারা নানান প্রতিবেশে টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করে এবং অন্যান্য মানব প্রজাতির (যেমন, নিয়ানডারথাল ও ডেনিসোভানদের) সঙ্গে কখনও সংঘর্ষে, আবার কখনও সংমিশ্রণে যুক্ত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হোমো সেপিয়েন্সই একমাত্র টিকে থাকা মানব প্রজাতিতে পরিণত হয়। তাদের সাংস্কৃতিক বিবর্তনও ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়, যেমন—গুহাচিত্র, ভাষার বিকাশ, ধর্মীয় বিশ্বাস, কৃষি বিপ্লব ও নগর সভ্যতার সূচনা।

আজকের পৃথিবীতে যত মানুষ রয়েছে, তারা সবাই হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। এই প্রজাতির অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতা, চিন্তাশক্তি ও সামাজিক সহযোগিতার গুণ মানুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে পৃথিবী জুড়ে। তবুও, হোমো সেপিয়েন্সের বিবর্তন এখনও চলমান, যা আমাদের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব ও বিকাশের দিকেও ইঙ্গিত দেয়।

হোমো সেপিয়েন্সদের বিবর্তন সম্পর্কে বলতে গেলে বিশাল বড় একটা বই হয়ে যাবে। অন্য আরেকদিন আমরা এদের নিয়ে আলোচনা করবো। তবে বলতেই হয়, মানব বিবর্তনের অন্যতম এক আবিষ্কার হোমো সেপিয়েন্স’রা। প্রায় ১ কোটি বছর আগে গাছে চড়া অস্ট্রালোপিথেকাস দের থেকে কীভাবে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হওয়া হোমো সেপিয়েন্স আজ চাঁদে পদার্পণ করছে, মঙ্গলে মহাকাশযান পাঠাচ্ছে তা আসলেই এক বিস্ময়ের ব্যাপার। আর এই সব বিস্ময়ের পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব রয়েছে মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তনের। এই মস্তিষ্কের সাহায্যেই আমরা হয়তো একদিন মানব বিবর্তনের সবগুলো পাজলের টুকরা একসাথে করতে সক্ষম হবো। জানতে পারবো আমাদের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে।

তথ্যসূত্র







বিজ্ঞান নিউজলেটার

যুক্ত হোন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান নিউজলেটারে!
আমরা সাপ্তাহিক ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। 
এ নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। থাকবে নতুন লেখার খবরও।


Loading

লেখাটি 35-বার পড়া হয়েছে।

ইউটিউব চ্যানেল থেকে

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লেখা


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

বিজ্ঞান অভিসন্ধানী: পঞ্চাশ জন বিজ্ঞান লেখকের লেখা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ই-বুকটি। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে শুরু করে ডিএনএর রহস্য, গণিত, এমনকি মনোবিজ্ঞানের মতো বিশাল বিষয় ব্যাপ্তির পঞ্চাশটি নিবন্ধ রয়েছে দুই মলাটের ভেতরে।
বিজ্ঞান অভিসন্ধানী: আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে শুরু করে ডিএনএর রহস্য, গণিত, এমনকি মনোবিজ্ঞানের মতো বিশাল বিষয় ব্যাপ্তির পঞ্চাশটি নিবন্ধ রয়েছে দুই মলাটের ভেতরে। ।