এআই মেডিসিন 

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

ঘাড়টা শক্ত হয়ে আছে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে, আঙুলগুলো ঝিনঝিন করছে। এভাবে আপনার সমস্যাগুলো উল্লেখ করলেন। এরপর স্ক্রিনে প্রশ্ন এলো, ঠিক কবে থেকে এই সমস্যাগুলো হচ্ছে এবং আগের থেকে অবস্থা আরও বেগতিক কি না। আপনি ঠিকঠাক জবাব দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাপটা আপনার সমস্যাটা ধরে ফেললঃ ঘাড়ে টান পড়েছে। এজন্যে আপনার ঘর থেকে বের হতে হয়নি, ক্লিনিকে গিয়ে লাইন ধরতে হয়নি। এটা কিন্তু কোনো বিজ্ঞান কল্প-গল্প এর প্লট নয়। Ada বা এডা অ্যাপটি ঠিক এভাবেই লক্ষণ দেখে রোগ নিদান করে দিচ্ছে।

এডার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে, ড. মার্টিন হির্শ, ড. ক্লেয়ার নভোরোল এবং ড্যানিয়েল নাথরাথ, এই তিনজনের হাত ধরে। ২০১৬ সালে লঞ্চ করা হয় অ্যাপটি। সে থেকে এ অবধি পুরো বিশ্বে প্রায় দেড় কোটির মতন কেস সামলেছে এডা। অ্যাপটির পেছনে কাজ করছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাকে বাস্তবিক বিভিন্ন মেডিক্যাল রেকর্ড দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। কাজটি করতে শ খানেক ডেটা বিজ্ঞানীর ছ’ বছর লেগেছিল। বলা যায় এখনও এটি প্রশিক্ষিত হচ্ছে। একেকটা কেস সামলানোর সঙ্গে সঙ্গে আরেকটু স্মার্ট হয় ওঠে এডা। 

এভাবেই চিকিৎসাশাস্ত্রে ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা। মানুষ চিকিৎসকের পাশাপাশি রোগ নিদান শাস্ত্রে জায়গা নিচ্ছে যন্ত্র বুদ্ধিমত্তা। স্বাস্থ্যকর্মী এবং বিশেষজ্ঞগণ এআই ভিত্তিক এই মেডিক্যাল অ্যাপগুলোর দীপ্ত ভবিষ্যতই দেখতে পান। এরকমই আরেকটি অ্যাপ হচ্ছে  Babylon বা ব্যাবিলন। এর প্রতিষ্ঠাতা আলী পারসা, তিনি যন্ত্রকে অবজ্ঞা করতে চান না। তাঁর মতে, “ মানুষের মতন যন্ত্র মানসিকভাবে চাপগ্রস্ত হয় না। ক্ষুধার্ত হয় না। নিরলসভাবে প্রতিবার এটি তা-ই করে যেজন্যে একে বানানো হয়েছে।” 

সুচিকিৎসা দানের পূর্বশর্ত হচ্ছে ঠিকঠাক রোগ নিদান। ইউএস ইন্সটিটিউট অব মেডিসিনের তথ্য মতে, প্রতি ১০টা রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ১টা ভুল হয়। আর কেবল এজন্যেই প্রতি বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ৮০ হাজার অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ঘটে। এক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে এই ধরনের মেডিক্যাল অ্যাপগুলো। অ্যাপগুলোর পেছনে কাজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। এই এআই’কে বেশ কয়েকটা ব্যাপারে পারদর্শী হতে হয় যেমনঃ ভাষা পাঠ করতে পারা, রোগীর লক্ষণগুলো বুঝতে পারা; তাৎক্ষণিকভাবে পুরো বিশ্বের মেডিক্যাল ডেটাবেজ থেকে তথ্য অনুসন্ধান করতে পারা এবং লাখ লাখ ভিন্ন রকম উপসর্গ এবং রোগের মধ্যে সম্পর্ক শনাক্ত করতে পারা। 

ডায়াবেটিসের একটি জটিলতা হলো ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, যেখানে চোখের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি মারাত্মক ত্বক ক্যান্সারের নাম হচ্ছে মেলানোমা, যেখানে মেলানিন উৎপাদনকারী কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুই রোগ শনাক্তকরণে ডিপ লার্নিং নেটওয়ার্ক ডাক্তারদেরও ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমআরআই কিংবা সিটি স্ক্যান দেখে ক্যান্সার শনাক্তকরণ কিংবা স্বাস্থ্য পরীক্ষার ডেটা দেখে বলে দিতে পারে কারো হৃদরোগের সম্ভাবনা আছে কি না। ইউএস ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন এ পর্যন্ত প্রায় ডজন খানেক এধরনের অ্যালগরিদম এর অনুমোদন দিয়েছে। 

এডার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে, ড. মার্টিন হির্শ, ড. ক্লেয়ার নভোরোল এবং ড্যানিয়েল নাথরাথ, এই তিনজনের হাত ধরে। ২০১৬ সালে লঞ্চ করা হয় অ্যাপটি। সে থেকে এ অবধি পুরো বিশ্বে প্রায় দেড় কোটির মতন কেস সামলেছে এডা।

এআই ভিত্তিক এই মেডিক্যাল প্রোগ্রামগুলো রোগ শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াকে সহজ করে তুলেছে তো বটেই। তবে এখনও যে এগুলো সবসময় নিখুঁত ফলাফল দিচ্ছে তা নয়। অনেকসময় এখানে ওভারডায়াগনোসিস বা অপ্রয়োজনীয় রোগ নির্ণয়ের সম্ভাবনা থাকে। ২০১৩ সালে স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর একটি সমীক্ষা বলছে, ১০ জন মহিলা অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়েছে এবং ২০০ জন অপ্রয়োজনীয় মানসিক চাপে ভুগেছেন। পাশাপাশি এআই এর প্রশিক্ষন ডাটার প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকে। যদি কোনো এআই ইমেজিং মডেলকে কেবল ইউরোপের মেডিক্যাল ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয় তাহলে এই মডেল কেবল ইউরোপের লোকজনের জন্যেই প্রযোজ্য হবে। অন্যান্য দেশের মানুষের রোগ নিদানের জন্যে প্রযোজ্য হবে না। এটা কমন সমস্যা। 

এআই অ্যাপগুলো কালো বাক্সের মতন। কেন এগুলো একটা সারসংক্ষেপে পৌঁছায় সেটা বলা মুশকিল। আমেরিকায় বড় পরিসরে একটা বিদ্যায়তনিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। এআই ব্যবহার করে পুরোনো মেডিক্যাল ডেটা থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মারা যাবার সম্ভাবনা কতটুকু সে পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। উল্লেখ্য এআই প্রোগ্রামটি মোটামুটি ভালো পূর্বাভাস দিতে পেরেছিল। তবে পুরোপুরি নিখুঁত নয়। দেখা যায় অ্যাজমায় আক্রান্ত কিছু রোগী সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়েছে, যে তারা অপেক্ষাকৃত কম বিপজ্জনক অবস্থায় আছেন এবং তাদের চিকিৎসকের দ্বারস্থ হবার প্রয়োজন নেই। পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে হয়তো এই পূর্বাভাস ঠিক ছিলো। তবে কারো স্বাস্থ্যের ভালো পরিসংখ্যান আসার পেছনে থাকে চিকিৎসকদের নিবিড় মনোযোগ এবং সুচিকিৎসা। আর এ জন্যেই ডেভেলাপাররা এধরনের মেডিক্যাল অ্যাপ তৈরির কাজে ডাক্তারদের যুক্ত করেন।

তবে সবসময় যে চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ ঠিক হয় তাও না। যন্ত্র এবং চিকিৎসকদের মধ্যে মত বিভেদ হলে অনেকসময় চিকিৎসকরাও ভুল করেন। আর অনেকটা এই কারণেই রোগ শনাক্তকরণ এবং প্রশক্ষিনে যন্ত্রের কোনোরকম পক্ষপাত না থাকাই শ্রেয়। এক্ষেত্রে স্বাধীনতা জরুরি। তবে মেডিক্যাল এআইগুলো কেবল রোগ শনাক্তকরণেই সীমাবদ্ধ নয়। মেডিক্যাল এআই গবেষকরা বলেন, এসব প্রোগ্রাম রোগ শনাক্তের পাশাপাশি কোন কোন থেরাপি বা চিকিৎসা দিতে হবে, আগের তুলনায় শরীরের অবস্থা কতটা উন্নত হয়েছে- এসবও পর্যবেক্ষণ করতে পারে। সামনে হয়তো এমন অ্যালগরিদম বানানো সম্ভব হবে যেগুলো ডায়াবেটিস, বাতরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং অ্যাজমার মতন দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যেগুলোর চিকিৎসা অত্যন্ত খরুচে, আরও ভালোভাবে রোগীর শরীরের উন্নতি বুঝতে চিকিৎসকদের সাহায্য করবে। মানসিক রোগের চিকিৎসায় ইতিমধ্যেই এআই ভেলকি দেখাচ্ছে। অনলাইনে রোগীদের কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি দিচ্ছে। 

তবে এখনও এআই মেডিসিন সিস্টেমে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এআই’কে সিদ্ধান্ত নিতে বা প্রশিক্ষিত করতে রোগীদের যে ডেটাসেট দেওয়া হয় সেগুলোর গোপনীয়তা রক্ষা। ইলেকট্রনিক চিকিৎসার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এর নিয়ন্ত্রণেও এসেছে বিভিন্ন কঠোর আইন যেমন যুক্তরাষ্ট্রের হাইটেক আইন এবং যুক্তরাজ্যের তথ্য নিরাপত্তা আইন। এআই মেডিসিনকে আরও উন্নত করতে হলে অবাধ তথ্য সরবরাহের খুবই দরকার। সেজন্যে তথ্য সরবরাহের ব্যাপারে নতুন আইন চালু জরুরি। 

এআই মেডিসিনে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে দায়বদ্ধতা। চিকিৎসায় ত্রুটি সংক্রান্ত আইন সবখানে একরকম হয় না। আবার এধরণের আইন বেশ জটিল হয়। তাই চিকিৎসায় এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইন কীরকম হওয়া উচিত সেটা ঠিক করা জরুরি। চিকিৎসকরা ইতিমধ্যে চিকিৎসা দানে এআই ব্যবহার শুরু করেছেন। যদি এআই এর সিদ্ধান্ত এবং চিকিৎসকের মধ্যে মতবিরোধ হয় সেক্ষেত্রে তৃতীয় একজন চিকিৎসক বা কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। 

তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত ভালো সাহায্যই করুক না কেন একেবারে মানুষ চিকিৎসকদের স্থান কখনোই দখল করতে পারবে না। এআই হয়তো একজন স্বাস্থ্যকর্মীর সক্ষমতা আরেকটু বাড়াতে পারবে। কিন্তু কখনোই রোগীর সঙ্গে সহানুভূতিশীল সম্পর্ক গড়তে পারবে না যা কিনা রোগীর সেরে ওঠার জন্য খুবই দরকারি। যখন খুব জটিল অবস্থার উপক্রম হয় কিংবা জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন সিদ্ধান্ত নিতে মানুষের যুক্তি প্রয়োজন হয়। যন্ত্র যতোই উন্নত হোক না কেন কোনোভাবেই তা মানব ডাক্তারদের প্রতিস্থাপন করতে পারবে না।

তবে এআই যা করতে পারে তা হলো ডাক্তারদের কাজকে আরেকটু সহজ করে তোলা। বর্তমানে চিকিৎসকদের অনেক কাগজপত্র এবং ডিজিটাল ফরম সামলাতে হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে যদি এই কাজগুলো সারা যায় তাহলে ডাক্তাররা রোগীদের আরও সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। তাদের রোগের ইতিহাস শুনতে পারবেন আরও মনোযোগ সহকারে।

বর্তমানে আমরা যখন গুরুতর অসুস্থ হই কেবল তখনই  চিকিৎসকের দ্বারস্থ হই। কিন্তু এআই মেডিসিনের কল্যাণে প্রতিনিয়ত আমাদের স্বাস্থ্য নিরীক্ষার মধ্যে থাকবে। হাতের স্মার্টঘড়ি থেকে তথ্য নিয়ে এবং জিনোম সিকোয়েন্সের ওপর ভিত্তি করে দৈনন্দিন আমাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা জানিয়ে দেবে এআই। ফলে সম্ভব হবে সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত এবং চিকিৎসা গ্রহণ।   

তথ্যসূত্রঃ







বিজ্ঞান নিউজলেটার

যুক্ত হোন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান নিউজলেটারে!
আমরা সাপ্তাহিক ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। 
এ নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। থাকবে নতুন লেখার খবরও।


Loading

লেখাটি 0-বার পড়া হয়েছে।

ইউটিউব চ্যানেল থেকে

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লেখা


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

বিজ্ঞান অভিসন্ধানী: পঞ্চাশ জন বিজ্ঞান লেখকের লেখা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ই-বুকটি। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে শুরু করে ডিএনএর রহস্য, গণিত, এমনকি মনোবিজ্ঞানের মতো বিশাল বিষয় ব্যাপ্তির পঞ্চাশটি নিবন্ধ রয়েছে দুই মলাটের ভেতরে।
বিজ্ঞান অভিসন্ধানী: আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে শুরু করে ডিএনএর রহস্য, গণিত, এমনকি মনোবিজ্ঞানের মতো বিশাল বিষয় ব্যাপ্তির পঞ্চাশটি নিবন্ধ রয়েছে দুই মলাটের ভেতরে। ।