ছিলেন ডিএনএ-র অন্যতম রহস্যভেদকারী, মানব জিনোম প্রজেক্টের স্বপ্নদ্রষ্টা; সাহায্য করেছেন একটি মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে, লিখেছেন একটি ক্লাসিক পাঠ্যপুস্তক; আবার কুখ্যাত হয়েছেন বর্ণবাদী এবং লিঙ্গবাদী মন্তব্যের জন্যও।
ডিএনএ-র দ্বি-সূত্রক মডেলের অন্যতম আবিষ্কর্তা এবং শারীরতত্ত্বে নোবেলজয়ী কিংবদন্তি বিজ্ঞানী জেমস ডি ওয়াটসন চলতি মাসের ৬ তারিখে ৯৭ বছর বয়সে মারা গেছেন। মানব জিনোম প্রজেক্ট শুরু করতে এবং এগিয়ে নিতে তাঁর ছিলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেই তিনিই আবার জীবনের শেষ পর্যায়ে জড়িয়েছিলেন নানা বিতর্কের বেড়াজালে।

ডিএনএ-র দ্বি-সূত্রক গঠন উন্মোচন পরবর্তীতে বংশগতীয় বিজ্ঞানের আণবিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। ডিএনএ-র তথ্য ব্যবহার করে কোষ প্রোটিন সংশ্লেষণ করে। প্রোটিন নিয়োজিত হয় কোষের বিভিন্ন কাজে। ওয়াটসনের সহকর্মী এবং সহ-নোবেল-বিজয়ী ফ্রান্সিস ক্রিক একে জীবনবিদ্যার কেন্দ্রীয় প্রত্যয় বলে অভিহিত করেছেন। জিন থেরাপি, মানব জিনোমের সিকুয়েন্সিং এবং ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি’র উদ্ভাবন- বর্তমান জীবনবিদ্যার এমন বহু অগ্রগতি ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কার ছাড়া চিন্তাই করা যেতো না।
“ডিএনএ’র দ্বি-সুত্রক গঠন উন্মোচন, বলতে গেলে মেন্ডেলের জিনতত্ত্ব এবং ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের সাথে জীববিজ্ঞানের তিনটি সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হিসেবে গণ্য হয়,” বলছিলেন নিউ ইয়র্কের কোল্ড স্প্রিং হার্বার গবেষণাগারের প্রধান ব্রুস স্টিলম্যান। ওয়াটসন এই গবেষণাগারে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন।
যুগান্তকারী গবেষণাপত্র
জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজে একসাথে কাজ করেছিলেন। প্রথম সাক্ষাতের কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁরা সমাধান করেন জীবনের নীল নকশা তথা ডিএনএ-র গঠন। ১৯৫৩ সালে প্রসিদ্ধ বিজ্ঞান বিষয়ক প্রকাশনা নেচার’-এ তাঁরা একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। শিরোনাম ছিল ‘এ স্ট্রাকচার ফর ডিঅক্সিরাইবোজ নিউক্লিক অ্যাসিড’। ওয়াটসনের বয়স তখন সবে মাত্র ২৫। অবশ্য এই আবিষ্কার নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।

ফ্রান্সিস ক্রিক ও জেমস ওয়াটসন; ছবি: National Geographic
ওয়াটসন এবং ক্রিক জটিল গঠনটি উন্মোচন করেছিলেন রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন এবং মরিস উইলকিন্সের এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফিক ছবি এবং তথ্যের সাহায্যে। তাঁরা তখন লন্ডনের কিংস কলেজ কাজ করছিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণকগুলো ফ্র্যাঙ্কলিনের অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করা হয়েছিল। ওয়াটসন এবং ক্রিকের সাথে উইলকিন্সকেও ১৯৬২ সালে শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এর চার বছর আগে ৩৭ বছর বয়সে জরায়ুর ক্যান্সারে মারা যান ফ্র্যাঙ্কলিন। ফলে তিনি নোবেলের জন্য বিবেচিত হননি।
“ওয়াটসন এবং ক্রিক, এই তথ্য ব্যবহারের অনুমতি চাইতে পারতেন ― এবং চাওয়া উচিত ছিল ― এবং ঐ তথ্য দিয়ে ঠিক কী করেছিলেন তা স্পষ্ট করে বলতে পারতেন, প্রথমে ফ্র্যাঙ্কলিন এবং উইলকিন্সকে, এবং তারপর বাকি বিশ্বকে”। ২০২৩ সালে ফ্র্যাঙ্কলিনকে নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধে এমনটাই লিখেছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার এবং ম্যারিল্যান্ডের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির দুই ইতিহাসবিদ ম্যাথিউ কব এবং ন্যাথানিয়েল কমফোর্ট।
আবিষ্কারের পরে ওয়াটসন ফ্র্যাঙ্কলিনের ব্যাপারে খুব একটা সদয় ছিলেন না। উপরন্তু, বিজ্ঞানচর্চায় নারীদের ভূমিকাকে কিছুটা হেয় করেছিলেন। নিজের লেখা একটি বহুল বিক্রিত বইয়ে তিনি লিখেছেন, “এই চিন্তা এড়ানো যায় না যে একজন নারীবাদীর জন্য সর্বোচ্চ স্থান হলো অন্য কারও গবেষণাগার।”
উত্তর নেই
ওয়াটসনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের মধ্যেও দীর্ঘদিন তাঁর এই মিশ্র স্বভাব নিয়ে কানাঘুষা ছিলো। ন্যান্সি হপকিন্স কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে কাজ করেন একজন আণবিক জীববিজ্ঞানী হিসেবে। তিনি বলেন ওয়াটসন তাকে এমন এক সময়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য উৎসাহিত করেছিলেন, যখন বিজ্ঞানে খুব কম সংখ্যক নারী কাজ করতেন। তিনি যখন নিজস্ব ল্যাব শুরু করেন এবং এই ভেবে ভয় পাচ্ছিলেন যে, তিনি হয়ত স্থায়ী নিয়োগ পাবেন না। ওয়াটসন তখন তাকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেন। “শুধু কাজ চালিয়ে যাও এবং চিঠিগুলি যথেষ্ট ভালো হলে, নিশ্চয়ই তুমি নিয়োগ পাবে। নয়তো আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করব!”- এমনটাই না কি বলেছিলেন ওয়াটসন।
হপকিন্স পরে বিজ্ঞানচর্চায় নারীদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের জন্য সোচ্চার হন।
তিনি বলছিলেন তিনি ছাড়াও আরো অনেক নারী বিজ্ঞানীকে ওয়াটসন প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং পাশে থেকেছেন। ওয়াটসনের জাতিবিদ্বেষী বক্তব্যের ব্যাপারে অবশ্য তিনিও বিস্মিত। ২০০১ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া, বার্কলে’তে একটি বক্তৃতায় ওয়াটসন চামড়ার রঙের সাথে যৌনাকাঙ্ক্ষা (লিবিডো)’র এবং চিকন হওয়ার সাথে উচ্চাকাঙ্ক্ষার সম্পর্ক রচনা করে এমন কিছু মন্তব্য করেন, যা শ্রোতাদের অনেককে অবাক করে দেয়।
ঐ বিতর্কিত বক্তৃতা নিয়ে হপকিন্স বলেছিলেন “এটাই ছিল তার পতনের শুরু । এর পরে যা ঘটেছিল, সেসবের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই।”
২০০৭ সালে ওয়াটসন মন্তব্য করেন কালো মানুষেরা সাদা মানুষের চেয়ে কম বুদ্ধিমান। তখনও তিনি কোল্ড স্প্রিং হার্বার গবেষণাগারে পদাধিকারী। একসময় তিনি এই গবেষণাগারের পরিচালকও ছিলেন এবং গবেষণাগারটিকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু বর্ণবাদী বক্তব্যের জন্য তাকে তখনকার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০২০ সালে পুনরায় এহেন মন্তব্যের দরুন প্রতিষ্ঠানটি ওয়াটসনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইহুদিবিদ্বেষী মন্তব্যেরও নজির ছিল তাঁর, যেমন ২০০৭ সালে তিনি বলেছিলেন “কিছু ইহুদিবিদ্বেষ ন্যায্য।”
গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক
ওয়াটসন অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। সবচেয়ে বিখ্যাত বইটা হল “দ্য ডাবল হেলিক্স: এ পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ডিসকভারি অফ দ্য স্ট্রাকচার অফ ডিএনএ”, যা পরবর্তীতে সমালোচিত হয়েছে। বিশেষ করে ফ্র্যাঙ্কলিনের প্রতি শিষ্টাচার বর্জিত আচরণের জন্য।
কিন্তু আরেকটি বই “দ্য মলিকিউলার বায়োলজি অফ দ্য জিন” “অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল” – এমনটাই মনে করেন ইতিহাসবিদ ম্যাথিউ কব। তাঁর মতে, “এই বই কয়েক প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের মনন গঠন করেছে। … একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে তরুণদের ওপর ওয়াটসনের দারুণ প্রভাব ছিলো, যেমনটা আবার ক্রিকের ছিল না।”

ওয়াটসনের লেখা পাঠ্যবই; ছবি: Amazon
কোল্ড স্প্রিং হার্বারের গবেষক আলেক্সান্ডার গ্যান বলেন, বইটি তখনকার সময়ের জন্য অসাধারণ সাবলীল ভাষায় লেখা হয়েছিল এবং আণবিক জীববিজ্ঞানের পুরো পরিসরটিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলো। তিনি আরও বলেন, “এটি একদিকে যেমন ইতোপূর্বে লিখিত অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকের থেকে স্বতন্ত্র ছিলো, তেমন পরবর্তীকালে পাঠ্যপুস্তক লেখার শৈলীতেও পরিবর্তন এনেছিলো।”
স্টিলম্যান কোল্ড স্প্রিং হার্বারে ওয়াটসনের অধীনে কয়েক বছর কাজ করেছিলেন এবং তারপর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্তা হয়েছিলেন। তার ভাষায়, “ওয়াটসন সত্যিই মানুষের যত্ন করতেন।…এটা একেবারে জ্বলজ্বলে সত্য যে তিনি ১৯৫০ এবং ৬০-এর দশকে হার্ভার্ডের একমাত্র শিক্ষক ছিলেন যার সহযোগিতায় বহু তরুণ নারীর ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছিলো।”
স্টিলম্যান বিশ্বাস করেন না যে, ওয়াটসন বর্ণবাদী ছিলেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ওয়াটসন মানব জিনোম সিকুয়েন্সিং-এর নৈতিক, আইনি এবং সামাজিক প্রভাব নিয়ে গবেষণায় অর্থলগ্নির দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। ওয়াটসন ১৯৮০-এর দশকের শেষ এবং ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে এই প্রকল্পের গোড়াপত্তন করেছিলেন। সেসময় অধিকাংশ মানুষ কল্পনাও করেনি যে এমন কাজ সম্ভব!
স্টিলম্যান যোগ করেন, “পরে তিনি কিছু আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন যার সঙ্গে আমি একমত নই। এবং আমরা এ নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি।” তিনি এবং অন্য সহকর্মীরা মাঝেমধ্যেই চিন্তা করেন এই মন্তব্যগুলি ওয়াটসনের অন্য কাজগুলিকে ছাপিয়ে যাবে কি না। স্টিলম্যান আরও বলেন, ” একশ বছর পরে, আমি মনে করি, মানুষ ঐ ডাবল হেলিক্সকেই মনে রাখবে।”
বি. দ্র. লেখাটি হেইডি লেডফোর্ড, মারিয়ানা লেনহারো, ব্রেন্ডেন মাহের, ট্রেসি ওয়াটসন এর “DNA pioneer James Watson has died ― colleagues wrestle with his legacy” শিরোনামে নিবন্ধ থেকে অনুপ্রাণিত।
মূল লেখাঃ
১। DNA pioneer James Watson has died ― colleagues wrestle with his legacy
আরও পড়ুনঃ
১। ডিএনএ এর দ্বি-সুত্রাকার গঠন আবিষ্কারের নেপথ্যে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন
২। ওয়াটসন-ক্রিক কি রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের উপাত্ত চুরি করেছিলেন?








Leave a Reply