২০২৫ এর জানুয়ারিতে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. সৈয়দ উদ্দিন একটি বিজ্ঞান বক্তৃতা দেবেন। রেজিস্ট্রেশন করে ফেলুন এই লিঙ্ক থেকে: https://cassa.site/event/colloquium-3/

এন্ডোসিম্বায়োসিস

ধরা যাক, আপনার একটি সুপারপাওয়ার আছে। আর পাওয়ারটি হল সময়কে স্থির করে দেয়া। পরিস্থিতি অনুযায়ী এই পাওয়ার ব্যাবহার এবং প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন, এসব করে সুখেই আছে। “Great power comes with great responsibility” এই ধরনের কোন ফিলোসফি এখনো আপনাকে আক্রান্ত করেনি। তবে কেউ না জানলেও আপনার এই ক্ষমতার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাবহার ঘটে পরীক্ষার হলে। কোন কিছু না পারলে প্রায়ই টাইম ফ্রিজ করে দিয়ে হল থেকে বের হয়ে বই-খাতা খুলে দেখে আসেন ব্যাপারটা কি।

আজও আপনি পরীক্ষার হলে, প্রশ্ন এসেছে এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরীর উপর। কিছুই পারছেননা। তবে আপনার এই অশুভ শক্তি কিছুক্ষনের জন্য একটু শুভকাজে ব্যায় করুন। আপনাকে বায়োটিক রিলেশনশিপ সম্পর্কে ধারনা দেব এই পরীক্ষার হলেই। টাইম ফ্রিজ করুন, এবং আমার সাথে সামনে চলে আসুন। বায়োটিক রিলেশনশিপ নানান রকম থাকলেও কম্পিটিশন, কমেনসালিজন, এমেনসালিজম, মিউচুয়ালিজম এসবের উদাহরন এই হলেই পাবেন।

এই যে সামনের সারিতে দুই কোনায় বসে দুইজন নিবিষ্ট মনে লিখছেন, কোন দিকে কোন খোজ খবর নাই। দুই জনেরই সিজিপিএ 3.9 এনারা প্রতিযোগীতা করছেন কে একটু এগিয়ে গিয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হতে পারেন। অর্থাৎ খুবই সহজ এদের মধ্যে কম্পিটিশনের সম্পর্ক। মাঝের সারিতে হোমড়া-চোমড়া ছেলেটা আর তার পাশে বসা রোগা-পটকা ছেলেটা। রোগা ছেলেটা মোটা ছেলেটাকে উজার করে দেখাচ্ছে, বলে দিচ্ছে। এখানে মোটাটার উপকার হলেও আপাত দৃষ্টিতে চিকনটার কোন লাভ আছে বলে মনে হয়না। এদের মধ্যে সম্পর্ক হল কমেনসালিজম। একজনের উপকার, অন্যের কোন লাভ-ক্ষতি নাই। এইবার ওই সারিতেই এক সাইডে বসা বিটলা টাইপের ছেলেটা। যে সাধারনত কাউকে ডিস্টার্ব করেনা, অন্য কেউ জিজ্ঞেস করলেও নিরীহ ভাবে বলে দেয়। কিন্তু যেটা বলে সেটা ভুল বলে, কি সাংঘাতিক! এখানে তাহলে বিটলা ছেলেটার সাথে তার পাশের ছাত্রের সম্পর্ক এমেনসালিজম। একজনের লাভ-ক্ষতি কিছু না হলেও অপরের ক্ষতি। এবার লক্ষ্য করুন একেবার পিছনের সারিতে বসা ক্লাসের একমাত্র কাপল। যারা একে অপরকে যথাসাধ্য বলে বলে হেল্প তো করছেই এমনকি কলম-পেন্সিল ও শেয়ার করছে। এইখানে দুইজনেরই উপকার, কারো কোন ক্ষতি নাই। এদের মধ্যে সম্পর্ক হল মিউচুয়ালিজম। এই দুই লাভবার্ডকে নিয়েই আমরা আগাচ্ছি এন্ডোসিম্বায়োসিসের দিকে।

সময় তো স্থির হয়েই আছে, চলেন একটু ফেসবুকে ঢুকি। ঢুকে দেখি গত রাতে ওই ছেলেটা কি স্ট্যাটাস দিয়েছে। আরে বাহ! চার লাইনের একটা অণুকাব্য, মেয়েটাকে ট্যাগ করে দিয়েছে। তো কি সেই কাব্য?

"হতিস যদি হৃদয় মোর,
লিখে দিতাম এই পাঁজর,
সুখ দিতি রোজ স্পন্দনে-
সিম্বায়োটিক বন্ধনে..."

কিছু বুঝলেন? ও আচ্ছা, আপনি তো আবার কবিতা বুঝেন না। এর মানে হল, ছেলেটা বলছেঃ মেয়েটা যদি তার হৃদয় মানে হার্ট হতো। তাহলে ছেলেটা তার বুকের মধ্যে আশ্রয় দিত। বিনিময়ে মেয়েটা তাকে হৃদস্পন্দনের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতো। হাইপোথিটিক্যালি চিন্তা করেন, এই হার্টকে যদি সাধারন কোন অংগ না ধরে জ্যান্ত একটা প্রানী হিসেবে ধরে নেন। তাহলে এইখানে যেটা ঘটার কথা ছেলেটা ভাবছে, বিশ্বাস করেন সেটাই এন্ডোসিম্বায়োসিস।

Endosymbiosis, গম্ভীর একটা শব্দ। এখন এটাকে ধরে যদি একটা আছাড় দেই, তাহলে সেটা তিন টুকরা হয়ে যাবে। Endo, syn এবং biosis. এদের কাছাকাছি বাংলা অর্থ যথাক্রমেঃ ভেতরে, একসাথে, থাকা। অর্থাৎ, একটা জীব যখন আরেকটা জীবের দেহের ভেতরে বসবাস করে তখন তাকে এন্ডোসিম্বায়োসিস বলে।

আরাফাত রহমান ভাইয়া তার একটা লেখায় লিখেছিলেন ‘গোটা মহাবিশ্বের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জটিলতা‘। কথা ঠিক, আমাদের জীবন-যাপনের সাথে অনুজীবের তুলনা করলে আমাদেরকে বেশ জটিল বলে মনে হবে। তবুও এই জটিলতার মধ্যেও অনেক সময় কিছু প্যাটার্ন দেখা যায়। এই বায়োটিক রিলেশন গুলো এরকম এক ধরনের প্যাটার্ন।

এন্ডোসিম্বায়োসিসের উদাহরন আমাদের আসে পাশে অনেক দেখা যায়। যেমন Rhizobia স্পেসিসের ব্যাকটেরিয়া যারা Legume প্ল্যান্টের শিকড়ে নডিউল তৈরি করে বসবাস করে এবং নাইট্রোজেন ফিক্সেশনে সহায়তা করে বিনিময়ে প্ল্যান্টের থেকে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এসব পুষ্টি গ্রহন করে।

ছবিতে এক প্রকার কোরাল দেখতে পাচ্ছেন। এদের বৈশিষ্ট্য হল এরা ফটোসিনথেসিস করতে সক্ষম! কিন্তু, কোরাল তো কোন উদ্ভিদ নয়। তাহলে কিভাবে ফটোসিনথেসিস করে? এর কারন Symbiodinium নামের এক ধরনের শৈবাল। এই কোরালগুলো Symbiodinium কে খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে কিন্তু ঠিক হজম করেনা। এরা কোরালের এন্ডোডার্মাল স্তরে বসবাস করে কোরালের দেহ থেকে কার্বনডাই অক্সাইড, এমোনিয়া গ্রহন করে এবং কোরালকে কার্বোহাইড্রেট সর্বরাহ করে।

এন্ডোসিম্বায়োসিসের কথা আসলেই আরেকটি ব্যাপার মাথায় আসে, সেটা হল এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরী। এটা বেশ চমকপ্রদ একটা বিষয়। এই থিওরী যেটা বলে তা হলঃ প্রকৃতকোষী বা ইউক্যারিওটের কিছু কিছু অঙ্গানু, আলাদা এককোষী জীবের সাথে সিম্বায়োসিসের মাধ্যমে এসেছে। এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরী অনুযায়ী মাইটোকন্ড্রিয়া, প্লাস্টিড বহু আগে মুক্তজীবি ব্যাক্টেরিয়া ছিল। যারা এন্ডোসিম্বায়োন্ট হিসেবে অন্য কোষের মধ্যে ঢুকে পরে এবং একসময় কোষেরই অংশ হয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের ধারনা, মাইটোকন্ড্রিয়া এসেছে প্রোটিওব্যাক্টেরিয়া থেকে এবং প্লাস্টিড এসেছে সায়ানোব্যাক্টেরিয়া থেকে!

A. A prokaryote ingested some aerobic bacteria. The aerobes were protected and produced energy for the prokaryote. A. B. C. D. Cyanobacteria. Aerobic bacteria. Mitochondria. Chloroplasts. N. N. N. Plant cell. Prokaryote. N. Animal Cell.

কি বিশ্বাস হচ্ছেনা? আচ্ছা বাদ দেন থিওরী কপচানো। আসেন একটা গল্প বলি আপনাকে, সাই-ফাই থ্রিলার!

ইভ নামের এক অন্য রকম বুদ্ধিমান সত্বা, যার এক সময় স্বাধীন অস্তিত্ব ছিল। নিজের স্বার্থে এখন বসবাস পৃথিবীর প্রতিটা প্রাণীর কোষে। অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করছে এক কাংক্ষিত মুহুর্তের যখন তারা এই ইউক্যারিওটিকদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্টা করতে পারবে ‘পারফেক্ট লাইফ ফর্ম’ এর মাধ্যমে। এই ‘পারফেক্ট লাইফ ফর্ম’ সচেতন ভাবে নিজের জেনেটিক কোড পরিবর্তন করতে সক্ষম। যখন কিয়োমি নামের মেয়েটির জন্ম হল তখন থেকেই ইভের কলকাঠি নাড়া শুরু। সে কিওমির মনকে নিয়ন্ত্রন করতে পারত। এক সময় কিওমিকে গাড়ির দুর্ঘটনায় ফেলে দেয়। কিওমি বেঁচে ফিরলেও সে যাকে বলে প্রায় জোম্বি হয়ে যায়, কারন ইভ তার সম্পুর্ন দখল নিয়ে নেয়। কিওমির স্বামী একজন বিজ্ঞানী। কিওমি তার স্বামীকে বলে একটা কিডনি ডোনেট করে মারিকো নামের এক কিশোরির দেহে। এইভাবে ইভ আরো একজনের দেহে ছড়ায়। ইভ অর্থাৎ কিওমি তার স্বামীর সহায়তায় ল্যাবে তার লিভারের কিছু কোষ কালচার করে, এর ফলে ইভ একটি সম্পুর্ন স্বাধীন দেহ পায়। এই স্বাধীন দেহ নিয়ে ইভ সেই ল্যাবের আরো দুইজন সায়েন্টিস্টদের যাকে বলে আছড় করে। তারপর নানা ঘটনায় কিওমির দেহ থেকে একটি নিষিক্ত ডিম্বানু ইভ মডিফাই করে এবং তা মারিকোর দেহে স্থাপন করে। এবং একটি শিশুর জন্ম হয়। ফলে মারিকো হয় ‘পারফেক্ট লাইফ ফর্ম’ এর প্রথম হোস্ট।

এখন বলেন তো ইভ আসলে কি? ঠিক তাই ‘মাইটোকন্ড্রিয়া’। এমন একটি প্লট নিয়ে চমৎকার একটি সায়েন্স-ফিকশন লিখেছেন জাপানি রাইটার ‘হিদেয়াকি সেনা’। বইটার ইংরেজি নাম ‘প্যারাসাইট ইভ’। এই এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরীর ধারনা থেকেই এই গল্পের উৎপত্তি। কি বললেন? এই নামে মুভি দেখেছেন? ওয়াও তাই, সেটা কিন্তু আমি জানতামইনা।

যাই হোক, এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরী যে সম্পুর্ন একটা সায়েন্টিফিক ফ্যাক্ট এর জন্য বিজ্ঞানীরা অনেক প্রমান দাড় করিয়েছেন। এগুলো থেকে বুঝা যায় বুঝা যায় যে মাইটোকন্ড্রিয়া এবং প্লাস্টিড ব্যাক্টেরিয়া থেকে এসেছে। এর মধ্যে কয়েকটা এরকমঃ

  • ব্যাক্টেরিয়ার মেমব্রেনের সাথে এই অঙ্গানুগুলোর মেমব্রেনের অনেক মিল রয়েছে।
  • নতুন মাইটোকন্ড্রিয়া অথবা প্লাস্টিড যেই প্রকৃয়ায় আসে, ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রেও এমন ঘটে যাকে বলে বাইনারি ফিশন। এটা এক ধরনের অযৌন প্রজনন।
  • এরা যে ধরনের রাইবোজম(70S) বহন করে, ব্যাক্টেরিয়াতেও তা রয়েছে।
  • ব্যাক্টেরিরার বাহিরের মেমব্রেনে ‘পোরিন’ নামের এক ধরনের ট্রান্সপোর্ট প্রোটিন পাওয়া যায়, যা মাইটোকন্ড্রিয়া এবং প্লাস্টিডের বাহিরের মেমব্রেনেও রয়েছে।
  • যদি কোষের থেকে মাইটোকন্ড্রিয়া অথবা ক্লোরোপ্লাস্ট সরিয়ে ফেলা হয়, কোষের ভেতর তারা আবার তৈরি হয়না।
  • তবে সবচেয়ে আকর্ষনীয় যেটা তা হল ডিএনএ। মাইটোকন্ড্রিয়া এবং প্লাস্টিড উভয়েরই নিজস্ব ডিএনএ রয়েছে যা সংস্লিষ্ট ব্যাক্টেরিয়ার সাথে তুলনা করলে বিশাল মিল পাওয়া যায়।

এখন বিশ্বাস হয়েছে? যান ভাই। এইবার পরীক্ষাটা শেষ করেন। দেখলেন তো, সব সময় বই দেখা লাগেনা। চিন্তা করেই অনেক কিছু বের করে ফেলা যায়,বিশেষ করে পরীক্ষার সময়। আর এই সুপার পাওয়ার, টাইম ফ্রিজ এগুলা কিছুই না। সম্ভব হলে একজন ভালো মানসিক ডাক্তার দেখান। ধন্যবাদ।

তথ্যসূত্রঃ

উইকিপিডিয়া, উইকিপিডিয়া এবং ইউটিউব।

লেখাটি 1,249-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. লেখাটা দারুণ লাগলো। সাজিয়েছো সুন্দর করে। বিশেষ করে এন্ডোসিম্বায়োসিসকে যেভাবে ভেঙে দেখিয়েছো তা আকর্ষণীয়। ফিলসফি, বায়োটিক, কম্পিটিশন ইত্যাদি শব্দকে বাংলা করা যেত। যেসব শব্দের কোন ভালো প্রতিশব্দ নেই তাদের কথা ভিন্ন, কিন্তু যাদের আছে তাদের বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করাটাই শ্রেয়। আর পারফেক্ট লাইফ ফর্ম বলতে কি বোঝাচ্ছো?

    1. অনেক ধন্যবাদ কমেন্টের জন্য। পরের বার থেকে পরিভাষা ব্যাবহারে আরও সতর্ক হব।
      ‘পারফেক্ট লাইফ ফর্ম ‘ বলতে লেখক বুঝিয়েছেন এমন এক অর্গানিজম যে সচেতন ভাবে নিজের জেনেটিক কোড পরিবর্তন করতে পারে।

  2. খান ওসমান Avatar
    খান ওসমান

    নিচের পয়েন্টগুলা ভাল লাগল। ৬ নম্বরে ‘মাইটোকন্ড্রিয়া এবং প্লাস্টিড উভয়েরই নিজস্ব ডিএনএ রয়েছে যা সংস্লিষ্ট ব্যাক্টেরিয়ার সাথে তুলনা করলে বিশাল মিল পাওয়া যায়’ বলতে নিশ্চয়ই দুইটা অর্গানেলেরই প্রোক্যারিওটিক ডিএনএ- এটা বোঝাচ্ছেন?

    এই লেখা দুইটা আপনাকে উৎসাহী করতে পারে:

    http://www.bigganblog.com/?p=2298
    http://www.bigganblog.com/?p=2332

    1. অনেক ধন্যবাদ,
      আপনার ধারনা সঠিক প্রোক্যারিওটিক ডিএনএ-র কথাই বলেছি।
      আপনার দেয়া পোস্টগুলোও যথেষ্ট তথ্যসমৃদ্ধ। ভালো লেগেছে।
      শুভকামনা রইল।

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading