পূর্বের লেখা: মস্তিষ্ক যেভাবে বদলায়
আমরা জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ঘুমের মধ্যে কাটাই। এটা কি সময়ের অপচয়? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা একটু কঠিনই বটে। চলুন, কোন ভালো ব্যাখ্যার খোঁজে একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখি।
১৯৫২ সাল। চলছিলো কোরিয়ান যুদ্ধ। সে সময় আমেরিকার সামরিক বাহিনী একটা অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। কারণ চলমান যুদ্ধে বিপক্ষীয় চীনা বাহিনী কর্তৃক আটক হওয়া আমেরিকান সেনাদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি যোদ্ধা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যাবহারের মতো উল্টোপাল্টা সব যুদ্ধাপরাধের স্বীকারোক্তি দিচ্ছিলো। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার আমেরিকাকে ত্যাগ করে কম্যুনিজম গ্রহণ করে দলিলে স্বাক্ষর দিচ্ছিলো। বোঝাই যাচ্ছে যে তখন এসব ঘটনা চীনাদের পক্ষে খুব শক্তিশালী প্রচারণার মালমশলা হিসেবে কাজ করছিলো। সিআইএ এবং অন্যান্য মিলিটারি গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা তখন চীনাদের এই সাফল্যের কারণ খোঁজে অনেকগুলো অদ্ভুত ব্যাখ্যা দাঁড় করছিলেন। যেমন, কেউ কেউ বললেন চীনারা হয়তো কোন নতুন রাসায়নিক দিয়ে মগজ-ধোলাই করছে। কেউ বললেন চীনারা নিশ্চয়ই সৈনিকদের সম্মোহিত করে ফেলেছে। হয়তো এজন্য তারা মন-বদলানো-তড়িৎ-ক্ষেত্রের (!) সহায়তা নিচ্ছে। তবে কয়েক বছর পরে যখন আসল ঘটনা বের হলো তখন অনেকেই বেশ বিনোদিত হলেন। চীনারা এইসব দলিল বা রেকর্ডে ইচ্ছামতো স্বীকারোক্তি আদায় করে নিচ্ছিলে তেমন কিছু নয় — খুব লম্বা সময় ধরে ঘুমাতে না দিয়ে; সাথে সেই আদিম পিটুনি-পদ্ধতি তো আছেই!
ঘুমাতে না দেয়ার মাধ্যমে নির্যাতন নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থেকেই এর ব্যবহার জানা যায়। প্রাচীন রোমানরা কারাবন্দীদের পেট থেকে গোপন তথ্য বের করা আর শাস্তির কৌশল হিসেবে বন্দীদের ঘুমাতে দিতো না। এর সুবিধা অনেক – নির্যাতনের কোন শারীরিক আলামত থাকে না। তাছাড়া বন্দীর মানসিক অবস্থার কোন চিরস্থায়ী পরিবর্তনও হয় না। দুই-এক রাত ভালো ঘুমের পর বন্দী আবার সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে যায়। যেমন কোরিয়ান যুদ্ধের পর মুক্তিপ্রাপ্ত আমেরিকান যোদ্ধারা প্রায় সবাই পূর্বের ভূয়া স্বীকারোক্তি কিংবা কম্যুনিজমকে আলিঙ্গন করার অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসেন। তাদের চিরস্থায়ী ‘মগজ ধোলাই’ করা যায় নি। তাদের মৌলিক বিশ্বাস, ব্যক্তিত্বের ছাঁদ কোনটারই স্থায়ী পরিবর্তন হয় নি। বরং ঘুমের অভাবে সাময়িকভাবে তারা খানিকটা বিভ্রান্ত, সম্মোহিত কিংবা ভারসাম্যহীন মানসিক অবস্থার মধ্যে চলে গিয়েছিলো।
ঘুমাতে-না-দেয়া নির্যাতন কার্যকর; তবে সীমিত সময়ের জন্য। বন্দীদের দমন-পীড়নের জন্য পদ্ধতিটা ভালো হলেও তাদের পেট থেকে তথ্য আদায়ের জন্য খুব নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ মানুষজন ঘুমের তীব্র অভাবে পড়ে গেলে এমন অনেক কিছুই দেখে বা শোনে যার কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই। যেমন পরী দেখার মতো ঘটনার পেছনে ঘুমের অভাবজাত হ্যালুসিনেশনকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া ঘুমের অভাবে সাময়িক মস্তিষ্ক-বিকৃতিও দেখা যায়। এরকম অবস্থায় বন্দীরা যদি মনে করে যেকোন কিছু বলে নির্যাতনকারীদের খুশী করিয়ে ঘুমানোর সুযোগ পাবে তাহলে তারা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে পারে। বলে রাখা ভালো, অতীতের রোমান সাম্রাজ্যের মতো বর্তমানেও বিভিন্ন আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশে বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঘুমাতে না দেয়া আইনত স্বীকৃত একটি পদ্ধতি।
মানুষ কতক্ষণ না ঘুমিয়ে থাকতে পারে? ড়্যান্ডি গার্ডনারের কথা শোনা যাক। সতেরো বছর বয়েসী এই স্কুল ছাত্র ১৯৬৫ সালে টানা এগারো দিন শুধু জেগে থাকার জন্যেই জেগে ছিলো। এজন্য অবশ্য সে কোন উত্তেজক ঔষুধ নেয় নি। প্রথম দিকে সে হয়ে পড়লো মনমরা-বিষন্ন, অবিচক্ষণ আর খিটখিটে প্রকৃতির। তারপরে সে হ্যালুসিনেশন দেখা শুরু করলো – সে দেখতো তার ঘুমানোর ঘর থেকে একটি পথ বনের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। তার মধ্যে দেখা গেলো মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ আর কোন কিছুতে মনোসংযোগে অক্ষমতা। তবে মাত্র পনের ঘন্টা ঘুমানোর পর বলতে গেলে প্রায় সব উপসর্গই উড়ে যায়। এতদিন টানা জাগার ফলে গার্ডনারের কোন দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক, মানসিক বা আবেগীয় ক্ষতি হয় নি।
ইঁদুরের উপর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছিলো যেটা কেউই মানুষের উপর করার সাহস করবে না। এসব পরীক্ষায় দেখা যায় যে টানা সময় ধরে কোন ইঁদুরকে ঘুমাতে না দিলে তারা তিন-চার সপ্তাহের মধ্যেই মারা যায়। মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও ইঁদুরগুলোর ত্বকে ক্ষতের সৃষ্টি এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থার লক্ষ্যণীয় অবনতি ঘটে। এ ধরনের শারীরিক অবস্থার শেষের দিকে তাদের দেহে সাধারণত অন্ত্রে বসবাসকারী কিছু আপাত নিরীহ ব্যাক্টেরিয়ার অস্বাভাবিক বিস্তার ঘটে। ঘুমের দীর্ঘ অভাবে তাদের দেহে কর্টিসল নামের একধরনের হরমোন নির্গত হয়। কর্টিসল সাধারণত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে অবদমিত করে রাখে। এছাড়াও তাদের দেহের ভেতরের গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে থাকে। বৈজ্ঞানিক জার্নালে ঘুমের অভাবে মানব মৃত্যুর কোন গবেষণার বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসী বাহিনীর ক্যাম্পের কিছু কিছু রিপোর্টে মানুষকে তিন-চার সপ্তাহ ধরে ঘুমাতে না দিয়ে হত্যার ঘটনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তারমানে চার সপ্তাহ ধরে আপনাকে খেতে না দিলে আপনি মারা নাও যেতে পারেন (এটা অবশ্য আপনার শারিরীক অবস্থা ও বয়সের উপর নির্ভর করবে)। কিন্তু চার সপ্তাহ ধরে না ঘুমালে নিশ্চিত মৃত্যু।
এটা পরিস্কার যে মানুষ ও ইঁদুর উভয়ের বেঁচে থাকার জন্য ঘুম দরকার। আমরা জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ঘুমের মধ্যে কাটাই। প্রশ্ন হলো, শারীরবৃত্তীয় ঠিক কোন ভূমিকার জন্য ঘুম এতটা গুরুত্বপূর্ণ? বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে এই সামান্য প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর নেই। একটু ভাবনা-চিন্তা করলে যে উত্তরটা মাথায় আসবে সেটা হলো ঘুম সম্ভবত দেহের ক্ষয়পূরণের একটা কাজ করে। ঘুমের সময় মস্তিষ্কসহ দেহের অন্যান্য কলাসমূহে বিভিন্ন কোষের বিকাশ ও মেরামত সংশ্লিষ্ট জিনগুলোর প্রকাশ ও প্রোটিন তৈরির গতি বেড়ে যেতে দেখা যায়। তবে সাধারণত শারীরিকভাবে বেশি তৎপর মানুষজনকে তুলনামূলক কম তৎপর মানুষের চেয়ে বেশি ঘুমাতে দেখা যায় না। কিংবা কিছু সময় ধরে শ্রমসাধ্য ব্যায়াম করলে মানুষজন বেশি ঘুমায় এমনও দেখা যায় না। এ কারণে ঘুমের মাধ্যমে ক্ষয়পুরণের ধারণাটা খুব একটা জোর পায় না।
অন্য একটি প্রস্তাবনা অনুযায়ী ঘুম শক্তি সংরক্ষণের কাজ করে। এই প্রস্তাবনাটি স্তন্যপায়ী ও পাখিদের মতো প্রাণীদের ক্ষেত্রে বেশি খাটে। উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের দেহ-তাপমাত্রা চারপাশের চেয়ে বাড়িয়ে রাখতে হয়। যেমন শীত-প্রধান দেশে অনেক ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীকে তুলনামুলক বেশি ঘুমাতে দেখা যায়। এসব প্রাণীর দেহের ভরের তুলনায় ত্বকীয়-পৃষ্ঠদেশের ক্ষেত্রফল তাপীয়ভাবে প্রতিকূলে, তাই ভাবা হয় ঘুম হয়তো শক্তি সংরক্ষণের কাজটি করছে। কিন্তু ঘুমের উদ্ভব যে কেবলমাত্র যে উষ্ণরক্তের প্রাণীদের মধ্যেই হয়েছে এমন নয়। ইইজি পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা যায় সরীসৃপ ও উভচারী প্রাণীরাও ঘুমায়। এমনকি মাছি, মৌমাছি ও বাগদাচিংড়ীর মতো অমেরুদন্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রেও ঘুমের মতো একটি অবস্থা দেখা যায়। এটা ঠিক যে ঘুমের সময় শক্তির সার্বিক ব্যাবহার বেশ কমে যায়। অবশ্য হাঁটাহাঁটির সাথে তুলনা করলে শক্তি ব্যবহারে একই পরিমাণ হ্রাস দেখা যায় চুপচাপ বসে বিশ্রামের সময়েও। বিশ্রাম থেকে ঘুমের মধ্যে গড় শক্তি ব্যবহারে যে পার্থক্য তা সামান্যই। তাই ঘুমের শক্তি সংরক্ষণের ভিত্তিক ব্যাখ্যাও অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
প্রাণীর কার্যক্রমকে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে গন্ডীবদ্ধ করে রাখার সহজ সমাধান হতে পারে ঘুম। চব্বিশ ঘন্টার পুরোটাই প্রাণীর জন্য উৎপাদনক্ষম নয় – দিনের একটা সময়ে অন্যের শিকার না হয়ে খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। মানুষসহ অনেক প্রজাতির ক্ষেত্রে এই সময়টা হলো দিন। ইঁদুর, পেঁচা কিংবা বাঁদুড়ের ক্ষেত্রে কাজের সময়টা হলো রাত; তারা ঘুমায় দিনে। ঘুমের প্রয়োজনীয়তার এই ধারণার পেছনে কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। খাদ্য পিরামিডের শীর্ষে থাকা সিংহের মতো শিকারী প্রাণীরা প্রচুর ঘুমায়, দিনে বারো ঘন্টার মতো। আর হরিণের মতো প্রাণীরা খোলা জায়গায় চরে বেড়ায়। তারা আবার অতোটা ঘুমায় না। বিপরীতক্রমে স্লথ ও কাঠবিড়ালীর মতো কিছু কিছু তৃণভোজী প্রাণীরা আবার অনেক ঘুমায়। যেমন স্লথেরা দৈনিক বিশ ঘন্টা ঘুমাতে পারে। তবে এই অতিরিক্ত ঘুমানো প্রাণীরা সাধারণত এমন সব জায়গায় থাকে যেখানে শিকারীরা খুব সহজে খুঁজে পাবে না। তাই সবদিক দিয়ে চিন্তা করলে দিনের নির্দিষ্ট সময় জুড়ে প্রাণীর গতিবিধি সীমাবদ্ধ এই সরল ধারণাটাও খুব একটা সন্তোষজনক মনে হচ্ছে না।
ঘুম কেন দরকার — এই প্রশ্নটা আপাতত একপাশে রেখে ঘুমের প্রক্রিয়ার উপর নজর দেয়া যাক। হয়তো এই বাঁকা পথে আমরা জোড়ালো উত্তর পাবো।
[আমরা যখন ঘুমায় তখন কিছু শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটে। ঘুমানোর সময়ে আমরা কয়েকটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাই। পরের লেখায় ঘুমের এই পর্যায়গুলো সম্পর্কে আমরা জানবো। তারপর এসব প্রক্রিয়া থেকে বোঝার চেষ্টা করবো ঘুম ঠিক কেন দরকার।][ডেভিড লিনডেনের The Accidental Mind বইটির সপ্তম অধ্যায় Sleeping and Dreaming থেকে অনূদিত]পরবর্তী লেখা: ঘুম-গবেষণার আশ্চর্য-আরম্ভ
Leave a Reply