মেঘমালা আপনাকে সমুদ্রের কথা মনে করিয়ে দেবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু সমুদ্র না থাকলে মাথার উপরে খুব কম সংখ্যক মেঘই ভেসে বেড়াতো। কারণ সুবিশাল সমুদ্র জুড়ে অজস্র ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র জীব রয়েছে যারা ডাই-মিথাইল সালফাইড (বা ডিএমএস) নামক গ্যাস তৈরি করে। কিছু সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ডিএমএস মেঘ গঠন আরম্ভ করতে পারে। এ ক্ষুদ্র জীবদের মধ্যে আছে শৈবাল ও অণুজীব। এরা অবশ্য মেঘ নির্মাণের জন্য ডিএমএস তেরি করে না। ডিএমএস আসলে ডাই-মিথাইল-সালফনিও-প্রপিওনেট (বা ডিএমএসপি) নামক বিপাকীয় অণুর উপজাত। সম্ভবত ভেসে বেড়ানো কিংবা প্রতিরক্ষা কিংবা উভয় কাজেই ফাইটোপ্লাঙ্কটনের ডিএমএসপি দরকার। সমুদ্রের একটি নিজস্ব ঘ্রাণ আছে। এ ঘ্রাণ কখনো কখনো অপ্রীতিকর কটুগন্ধ মনে হতে পারে। এ ঘ্রাণের (বা কটুগন্ধের) জন্য বায়ুবাহিত ডিএমএস দায়ি। সম্প্রতি সাগরের ফাইটোপ্লাঙ্কটন এমিলিয়ানিয়া হাক্সলি-র (Emiliania huxleyi) মাঝে এ ঘ্রাণের পেছনে যে উৎসেচক (এনজাইম) দায়ী তা আবিষ্কৃত হয়েছে। এর নাম দেয়া হয়েছে ডিএমএসপি লাইয়েজ ১ (DMSP lyase 1)। এটি শৈবালের উৎসেচক যা ডিএমএসপি-কে ভেঙে ফেলে। ফলাফলে সুগন্ধী ডিএমএস তৈরি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে গোটা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে।
চিত্র: ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচেএমিলিয়ানিয়া হাক্সলি। বাইরে কোক্কোলিথের আবরণ দেখা যাচ্ছে।
সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো অধিকাংশ ফাইটোপ্লাঙ্কটন হলো এমিলিয়ানিয়া হাক্সলি। এরা সমুদ্রের বিশাল অঞ্চল জুড়ে সবুজ আস্তরণ তৈরি করে। ব্লুম নামে পরিচিত এ আস্তরণ মহাকাশ থেকেও দেখা যায়। ক্রান্তীয় ও সাবআর্কটিক উভয় সাগরজলে এদের উপস্থিতি সাবলীল। এসব বাস্তুসংস্থানে খাদ্যজালের গুরুত্বপূর্ণ অংশও এ ফাইটোপ্লাঙ্কটনগুলো। এমিলিয়ানিয়া হাক্সলি এককোষী ইউক্যারিয়টিক (নিউক্লিয়াস বিদ্যমান এমন প্রকৃতকোষী) ফাইটোপ্লাঙ্কটন যাদের চারপাশে কোক্কোলিথ নামক একধরণের আবরণ রয়েছে। কোক্কোলিথের নামকরণ করেছিলেন ব্রিটিশ তুলনামূলক দেহসংস্থানবিদ থমাস হাক্সলি (১৮২৫ – ১৮৯৫)।
ছবি: ডিএমএসপি (উপরে) ও ডিএমএস (নিচে)
কোক্কোলিথ ক্যালসাইট নামক খনিজ দিয়ে তৈরি। এদের নির্মাণকৌশল খুব সুক্ষ্ণ ও অসাধারণ। বেশিরভাগ সময়েই এরা রঙহীন ও অস্বচ্ছ। এমিলেনিয়া হাক্সলি-র কোক্কোলিথ ক্যালসাইটের চাকতি দিয়ে তৈরি। এ বিষয়টি সর্বপ্রথম বর্ণনা করেন হাক্সলি ও সিজার এমিলিয়ানি (১৯২২-১৯৯৫) নামক আরো একজন ইতালীয় অণুজীববিজ্ঞানী। তাঁদের দু’জনের নামানুসারেই এমিলেনিয়া হাক্সলি-র নামকরণ করা হয়েছে। নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয় ক্যালসাইটের খোলটি প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা রাখে। কোক্কোলিথ হয়তো অনান্য বড় প্রাণির ভোজে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করার একটা পদ্ধতি। অথবা ভাইরাস বা ব্যক্টেরিয়া সংক্রমণ, এমনকি হয়তো ক্ষতিকর অতিবেগুণী রশ্মির বিরুদ্ধে ভৌত বাধা হিসেবে কাজ করে। এরা হয়তো ফাইটোপ্লাঙ্কটনগুলোকে ভাসিয়ে রাখার জন্য জরুরী। অথবা গভীর সমুদ্রে বসবাসকারী প্রজাতীগুলোর সালোকসংশ্লেষণের আলো যোগাড়ের একটি পদ্ধতিও হতে পারে। এ ক্যালসাইট খোলগুলো প্রতিনিয়ত দেহ থেকে স্খলিত হয়ে সাগরতলে ডুবে যায়। গভীর সাগরে জমা হওয়া তলানির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এ ক্যালসাইটগুলো। ডোভার নগরীর শ্বেত পর্বতগাত্র দীর্ঘ ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে জমা হওয়া এরকম তলানীর উদাহরণ।
চিত্র: ডোভার নগরের শ্বেত পর্বতগাত্র। সাগরতলে দীর্ঘদিন ক্যালসাইট খোলের তলানী পড়ে এ স্তর তৈরি হয়েছে।
স্বাতন্ত্র্য ক্যালসাইট খোল ছাড়াও এমিলেনিয়া হাক্সলি ডিএমএসপি তৈরি করে। অন্যান্য ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও সামুদ্রিক শৈবালও এই রাসায়নিক যৌগটি তৈরি করে। এই জৈবযৌগটি প্রতিবছর এক বিলিয়ন মেট্রিক টন পরিমাণে সমুদ্রে যুক্ত হয় ও সাথে সাথে বদলে যায়। ডিএমএসপি অধিক পরিমাণে পাওয়া যায় বলে জৈবঅণুর উপস্থিতি সমুদ্রে প্রাণের অন্যতম চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়। যেহেতু এ অণুটির উৎপাদন অনেক বেশি, সুতরাং ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও সামুদ্রিক শৈবালের জীবন চক্রে ডিএমএসপি অবশ্যই কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ সুনির্দিষ্টভাবে জানেন না এর কাজ কি। হয়তো এটি জীবকে অভিস্রবণীয় চাপ থেকে রক্ষা করে। ভেসে বেড়ানোর জন্য এর হয়তো ভূমিকা রয়েছে। এমনকি হয়তো শিকারী-শিকার সম্পর্কে এর কোন বিশেষ কাজ রয়েছে। ডিএমএসপি থেকে যে ডিএমএস তৈরি হয় তা সর্বপ্রথম ১৯৪৮ সালে লোহিত শৈবাল পলিসিফোনিয়ায় সনাক্ত করা হয়। সমুদ্র শৈবালের গন্ধের জন্য যে ডিএমএস দায়ী তা তখনই জানা ছিলো। ১৯৫৬ সালে প্রথম ডিএমএসপি ভাঙার উৎসেচক সনাক্ত করা হয়। এটি ছিলো এরকম অনেকগুলো এনজাইমের মধ্যে একটি – যাদের মধ্যে আধুনিকতম হলো ডিএমএসপি লাইএজ ১।
চিত্র: কলম ও কালির ড্রয়িং। শিল্পী সু বার্টফিল্ড
ডিএমএস বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে গিয়ে পৃথিবীর সালফার চক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর তীব্র সৌরভ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীকে সাম্ভাব্য খাদ্য-উৎসের প্রতি রাসায়নিক আকর্ষক হিসেবে কাজ করে। এসব প্রাণীর মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক পাখি, বিভিন্ন অমেরুদন্ডী এবং কিছু কিছু স্তন্যপায়ী। ডিএমএস মেঘ তৈরির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। ফলাফলে এ যৌগটি বিশ্ব জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ। কিভাবে? যখন গ্যাসটি বায়ুমন্ডলে নিক্ষিপ্ত হয় তখন তা তাৎক্ষণিকভাবে জারিত হয়ে পড়ে। ডিএমএস জারিত হয়ে তৈরি করে ডিএমএসও। ডিএমএসও পানির অণুর ঘণীভবনের নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করে। ফলাফলে তৈরি হয় মেঘ। আর যেখানেই মেঘ রয়েছে সে অঞ্চলের জলবায়ুতে এর প্রভাব থাকবেই। শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক জলবায়ুতেও এর প্রভাব থাকবে। মেঘ সৌর বিকিরণের প্রতিফলন বাড়িয়ে এটিকে মহাশূণ্যে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা প্রভাবিত হয়।
ডিএমএস এর একরকমের কটু গন্ধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন গন্ধটা বাঁধাকপির মতো। অন্যরা কাব্যিকভাবে একে সমুদ্রের ঘ্রাণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। বিট-মূল, এসপারাগাস ও সামুদ্রিক খাবার রান্না করার সময়েও এ বৈশিষ্ট্যপূর্ন ঘ্রাণ পাওয়া যায়। বিশ বছর আগে থিয়েরি থ্যালৌ নামের একজন ফরাসী রসায়নবিদ কটু গন্ধের জন্য ডিএমএস-কে দায়ী করেন। তিনি এ তত্ত্ব প্রমাণের জন্য এক ধরণের ভূগর্ভস্থ ছত্রাক ও শূকর ব্যবহার করেন। আজকাল অবশ্য ডিএমএস খুব কম মাত্রায় খাবারে দেয়া হয় মশলাদার স্বাদ নিয়ে আসার জন্য।
একটি রাসায়নিকের মেঘ তৈরির ক্ষমতা রয়েছে – এ কথাটির মধ্যে এক রকমের গীতিধর্মী আবেদন রয়েছে। মেঘ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ – যা ইদানিংকালে বেশ সংবেদনশীল বিষয়। ডিএমএসপি লাইয়েজ সম্পর্কে ভালোভাবে জানা গেলে বোঝা যাবে এটি বায়ুমন্ডলে ডিএমএস তৈরিতে কিভাবে ভূমিকা রাখে। এটি আবার ব্যক্টেরিয়া ও ইউক্যারিয়টদের বৈশ্বিক বিস্তৃতির উপর নির্ভরশীল। ডিএমএস কিভাবে পরিবেশের বিভিন্ন পরিমাপ দিয়ে আক্রান্ত হয়, কিংবা ডিএমএস কিভাবে পরিবেশকে প্রভাবিত করে তা আমাদের সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যদিকে, ডিএমএসপি লাইয়েজের মতো একই কাজ করা অনেক উৎসেচক সম্পর্কে আমরা কোন কিছু জানিই না।
ফাইটোপ্লাঙ্কটনের শারীরবৃত্তীক, জৈবসংকেত লেনদেন করা, ভাইরাস সংক্রামণের বিরুদ্ধের এর প্রতিরোধক্ষমতা, শিকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ কিংবা অন্যান্য জীবের সাথে মিথিজীবিতার ক্ষেত্রে ডিএমএস এর ভূমিকা বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ। সামুদ্রিক সালফার চক্রে এই ক্ষুদ্র জীবটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি এটি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপরেও বড়োসড়ো ভূমিকা রাখে। এর মাধ্যমে এ জীবটি সমগ্র পৃথিবীতেই একটা ভূমিকা রাখে – আমরাও যার একটি অংশ। এমিলেনিয়া হাক্সলি আসলে সেই প্রাণী যা লাভলকের বিখ্যাত গায়া অনুকল্পকে (হাইপোথিসিস) অনুপ্রাণিত করে, যে অনুকল্পের মূল কথা হলো পৃথিবীর জৈবরসায়ন ও ভূরসায়ন একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত।
নোট
সমুদ্র বিভিন্নধরণের অজস্র প্রাণী দিয়ে ভর্তি যারা বিভিন্ন উৎসেচকের মাধ্যমে ডিএমএসপি ভেঙে ডিএমএস ও এক্রাইলেটে পরিণত করতে পারে। একই ভাবে সমুদ্রে সালফার নিমজ্জিত হওয়ার অন্যতম কারিগর ডিএমএসপি-ও। অন্যদিকে ডিএমএস বায়ুমন্ডলে সালফারের অন্যতম প্রধান উপাদান। ডিএমএসপি লাইএস আদিকোষী ব্যক্টেরিয়া ও প্রকৃতকোষী ইউক্যারিয়ট উভয় ধরনের জীবেই বর্তমান। তবে এমিলিয়ানি হাক্সলি-র ডিএমএসপি লাইয়েজ ১ উৎসেচকটির সাথে এ ধরনের কোন উৎসেচকেরই মিল নেই। এটি চারটি একক দিয়ে গঠিত যা এসপারটেট রেসিমেজ সুপারফ্যামিলির অন্তর্গত, যেখানে সামুদ্রিক ব্যক্টেরিয়ার ডিএমএসপি লাইয়েজ এম২৪ সুপারফ্যামিলির সদস্য। ডিএমএসপি লাইয়েজ ১ ডিএমএসপি-কে ভেঙে ফেলে। তৈরি হয় ডিএমএস গ্যাস ও অ্যাক্রাইলেট। ডিএমএসপি লাইয়েজের বিভিন্ন ক্রিস্টাল গঠন দেখে বোঝা যায় যে এর দুইটি সক্রিয় অংশে (অ্যাক্টিভ সাইট) সিস্টিন রয়েছে। এ এনজাইমটির সক্রিয়তা শৈবাল-মিথোজীবিতা বা অন্যান্য সম্পর্কিত ব্যক্টেরিয়ার উপর নির্ভরশীল বলে ভাবা হয়।
প্রোটিন স্পটলাইট ১৭৪ ইস্যু হতে The smell of the sea-র ভাষান্তর। মূল লেখক Vivienne Baillie Gerritsen।
Leave a Reply