শ্বাসতন্ত্রের যেসব ভাইরাস সাধারণ সর্দি, ঠান্ডা অথবা আরো মারাত্মক উপসর্গের জন্য দায়ী তারা মূলত নাক ও মুখ দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। নাক ও মুখের গভীরে এই অংশকে ফ্যারিংক্স বলে যেটির সবথেকে উপরের অংশ ন্যাসোফেরিংক্স (নাকের গভীরের অংশ), এরপর অরোফেরিংক্স (মুখ গহ্বর এর ভিতরে) এবং হাইপোফেরিংক্স ( অরোফেরিংক্স এর আরো খানিকটা নীচে)। অন্যান্য ভাইরাসের মতো সার্স-কভ-২ এর প্রাথমিক সংক্রমণে এই অঞ্চল গুলোতে ভাইরাস অবস্থান করে এবং এখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভাইরাস পাওয়া ও যায়। যার কারনে এখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়।
ঠান্ডা কাশিতে লবণ পানি দিয়ে গড়গড়া আমাদের ঘরোয়া চিকিৎসা তে একটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। এতে এই জায়গাগুলোতে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের পরিমাণ কমিয়ে সংক্রমণ ও উপসর্গ কে কমিয়ে আনা সম্ভব। যারা পেশাগত কারনে প্রতিনিয়ত বাইরের মানুষ অথবা পরিবেশের সংস্পর্শে যাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে শুরুর দিকে এই জায়গাগুলোতে ভাইরাস এর পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারলে সেটি ভালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসাবে কাজ করতে পারে। এমনকি ঘরে যারা থাকছেন তারাও নিয়মিত এটি করতে পারলে উপকার মিলবে। লবণ পানি এবং পভিডোন আয়োডিন (PVP-I) নামে একটি রাসায়নিক উপাদান দিয়ে গড়গড়া করে ভাইরাস প্রতিরোধের কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষনা সুফলের ইংগিত দেয়। ভাইরাস নিয়ন্ত্রনে এগুলো কিভাবে কাজ করে সে বিষয়ে সংক্ষেপে এ নিবন্ধে আলাপ করবো।
পভিডোন আয়োডিন এর আরেক নাম আয়োডোপোভিডোন, এটি সাধারণত চামড়াকে জীবানুমুক্ত করার কাজে সার্জারীর আগে বা পরে ব্যবহার করা হয়। গড়গড়া করার জন্য পভিডোন আয়োডিন এর বিভিন্ন শতকরা দ্রবণ বাজারজাত করা হয়। যেগুলোকে গার্গল সলুশন বলে। বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ড নামে এই সলুশন পাওয়া যায়। (সতর্কতাঃ চামড়া জীবণুমুক্ত করার কাজে বাজারজাত করা পভিডোন আয়োডিন কোনভাবেই গড়গড়া করার উপযুক্ত নয় এবং বিপদজনক। কেবল মাত্র গার্গল সলুশন নির্দেশিত মাত্রা অনুযায়ী ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে ব্যবহার করা যেতে পারে)।
পভিডোন আয়োডিন পভিডোন, হাইড্রোজেন আয়োডাইড এবং আয়োডিনের সমন্বয়ে তৈরী যৌগ। পভিডোন আয়োডিন থেকে আয়োডিন ধীরে ধীরে বের হয়ে এককোষী বা বহুকোষী জীবের লিপিড এবং মেমব্রেন কে নষ্ট করে দেয়। এটি পানিতে খুব সহজেই মিশে যায় এবং দ্রবীভুত অবস্থায় খুব ধীরে আয়োডিন বের হয় বলে স্তন্যপায়ী প্রাণীর কোষে এর বিষাক্ত প্রভাব পড়েনা। জার্মানীর গবেষকরা গবেষণাগারে বিভিন্ন ভাইরাসের উপর জাপানে তৈরী ‘আইসোডিন’ নামে বাজারজাতকৃত পভিডোন আয়োডিন এর সলুশন পরীক্ষা করেছেন [1]। জাপানের বাজারে এটি ৭% গার্গল/মাউথওয়াশ হিসাবে পাওয়া যায় এবং ব্যবহারের মাত্রা ০.২৩% অর্থাৎ ১ঃ৩০ অনুপাতে পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হয়। বিজ্ঞানীরা এই ০.২৩% মাত্রার আইসোডিন দিয়ে দেখলেন তা সার্স, মার্স ভাইরাস কে ১৫ সেকেন্ডে ৯৯.৯৯% এর বেশী অকার্যকর করতে সক্ষম। তবে ল্যাবে ভাইরাস কালচারে কাজ হলেও এটি মানব দেহে ফ্যারিংক্স এ একই ভাবে কাজ করবে কিনা সেটি পরীক্ষা সাপেক্ষ। সম্প্রতি ইটালীর একজন ডাক্তার এই সলুশান কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন [2]।
যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক পরীক্ষাগারে খাবার লবনের হাইপারটনিক সলুশন (৩% সোডিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণ, আনুমানিক এক কাপে দু চামচ লবণ) এর মাধ্যমে নন -মায়োলয়েড কোষের ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবার বিষয় টি দেখিয়েছেন [3]। ম্যাক্রোফাজ সহ যেসব কোষ প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ পদ্ধতির মাধ্যমে ভাইরাস ধ্বংস করে তাদের কে মায়োলয়েড কোষ বলে। এই কোষ গুলিতে মায়েলোপারক্সিডেজ এনজাইম থাকে। এই এনজাইম এর সহায়তায় কোষগুলো ক্লোরিন আয়ন এবং লাইসোজোমের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এর সমন্বয়ে হাইপোক্লোরাস এসিড (HOCl) উৎপন্ন করে যা ভাইরাস ধ্বংস করতে কাজে লাগে। কিন্তু যেসব কোষ মায়োলয়েড নয়, যেমন এপিথেলিয়াল, হেপাটিক বা ফাইব্রোব্রাস্ট তারাও ক্লোরিন আয়নের উপস্থিতি তে একধরনের পারঅক্সিডেজ এনজাইম ব্যবহার করে হাইপোক্লোরাস এসিড উৎপন্ন করে ভাইরাস দমন করতে পারে। এই গবেষণার ধারাবাহিকতায় ক্লিনিকাল পরীক্ষায় তারা ৬৮ জন ঠান্ডায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কে দুই ভাগে ভাগ করে একদল কে নাকে লবন পানির প্রবাহ এবং গড়গড়া করিয়ে ফলাফল লক্ষ্য করেন [4]। অন্য দলকে তুলনা করার জন্য কোন পদ্ধতি ছাড়াই রাখা হয়। ফলাফলে দেখা যায় যারা লবণ পানি নিয়েছেন তারা কম দিন ঠান্ডায় ভুগেছেন, এবং তাদের গলার নমুনাতে ভাইরাস ও অনেক কম পাওয়া গেছে। এছাড়া ১৩০ জনের উপর করা একটি গবেষণাতে শুধু পানি দিয়ে গড়গড়া করার ফলেও ভাইরাস জনিত ঠান্ডা কমার প্রমাণ মিলেছে, যা পভিডোন আয়োডিন এর থেকেও বেশী কার্যকরী হয়েছে তাদের ফলাফলে [5]।
যেহেতু সার্স-কভ-২ ভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ একটি প্যানডেমিক, বহু মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং হয়তো হবেন। তাই প্রত্যেকের ই কম বেশী এই ভাইরাসের সম্মুখীন হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। গড়গড়ার মত একটি সহজ, স্বল্প ব্যায়ের প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এর ভয়াবহতা কমিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া পাঁচ ওয়াক্ত ওযু তে আমরা যেহেতু ভালোভাবে নাকের ভিতরে পানি দিয়ে পরিস্কার ও গলার গভীরে গড়গড়া করি সেটিও আমাদের কে একই ভাবে ভাইরাসের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং এ ধরনের ছোট কিন্তু কার্যকরী উপায় গুলো ভাইরাস মোকাবেলায় জোরালো ভূমিকা রাখবে এটাই প্রত্যাশা।
তথ্যসূত্রঃ
[1] M. Eggers, T. Koburger-Janssen, M. Eickmann, and J. Zorn, “In Vitro Bactericidal and Virucidal Efficacy of Povidone-Iodine Gargle/Mouthwash Against Respiratory and Oral Tract Pathogens,” Infect. Dis. Ther., 2018, doi: 10.1007/s40121-018-0200-7.[2] D. Gui, G. Pepe, and S. Magalini, “Just one more hygiene practice in COVID-19,” Eur. Rev. Med. Pharmacol. Sci., vol. 24, p. 3438*39, 2020, doi: 10.26355/eurrev_202004_20796.[3] S. Ramalingam et al., “Antiviral innate immune response in non-myeloid cells is augmented by chloride ions via an increase in intracellular hypochlorous acid levels,” Sci. Rep., 2018, doi: 10.1038/s41598-018-31936-y.[4] S. Ramalingam, C. Graham, J. Dove, L. Morrice, and A. Sheikh, “A pilot, open labelled, randomised controlled trial of hypertonic saline nasal irrigation and gargling for the common cold,” Sci. Rep., 2019, doi: 10.1038/s41598-018-37703-3.[5] K. Satomura et al., “Prevention of upper respiratory tract infections by gargling: A randomized trial,” Am. J. Prev. Med., 2005, doi: 10.1016/j.amepre.2005.06.013.
Leave a Reply