চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পাঁচ মাসের ভিতরেই বিশ্বের প্রায় সমস্ত ভূখন্ড দখলে নিয়েছে অতিক্ষুদ্র ভাইরাস সার্স-করোনাভাইরাস-২। স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ ব্যয় করা যুক্তরাস্ট্র মৃত্যুর মিছিলেও এগিয়ে। অন্যান্য ডিএন এ বা আর এন এ ভাইরাসের থেকে কম গতিতে নিজেকে পাল্টাচ্ছে এই ভাইরাস। দ্রুত গতিতে পাল্টালে এর বিধ্বংসী ভাব কমে আসতো কিনা তাও বলা যাচ্ছে না। রয়েছে তাপমাত্রা, আদ্রতা,বয়সজনিত ব্যধি এরকম অনেক বিষয় যা এর উপর প্রভাব ফেলছে। মানসিক ও শারীরিক ভাবে অস্থির হয়ে পড়ছে গৃহবন্দী মানুষ। বাড়ছে আতংক। কাজ বন্ধ থাকায় সঞ্চয় কমে আসা মানুষরা বের হতে বাধ্য হচ্ছে। আক্রান্তদের ভিতরে শতকরা হারে মৃত্যু কিংবা জটিল অবস্থার সংখ্যা টা খুব বেশী না হলেও, একই সময়ে অনেক বেশী মানুষ আক্রান্ত হওয়াতে সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞ এবং বিশেষ যন্ত্রপাতির ঘাটতি দ্রুত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বিশ্বের কম ব্যয় করা দেশগুলোর মধ্যে। তাই সার্বিক ভাবে শুরু থেকেই সেবা এবং সমন্বয় এর সমস্যা গুলো কাটিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নে সময় লাগছে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট চিকিতসা নাই সেটা সকলের ই জানা। তাই রোগ সনাক্তকরন করার ক্ষেত্রে এবং প্রয়োজন হলে হাসপাতালে কাংখিত সেবাটুকু আদৌ মিলবে কিনা সেই শংকাই সকলের মনে।
হাসপাতালে আপন জনের পক্ষে থাকা সম্ভব হচ্ছেনা, মৃত্যু ঘটলে সৎকারে নিকট কাউকে পাওয়া নিয়ে নানা ভয় ও জটিলতা। এমনকি আক্রান্ত হলে সামাজিকভাবে হেয় ও অবহেলিত হবার ভয় রয়েছে। তাই সব কিছু ছাপিয়ে এরকম পরিস্থিতিতে মৃত্যুকালীন সময়ের একাকীত্ব, হাসপাতালে কিরকম সেবা কপালে জুটবে কিংবা মৃত্যু ঘটলে তার পরের ধাপ গুলো কেমন হবে এরকম ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের ভিতর। এই ভাবনা গুলো কি আসলে নতুন? মানুষ মৃত্যুর কাছাকাছি পরিবেশে দাঁড়িয়ে কি এসব ভাবেনা? আধ্যাত্মিকতা বা ধর্মীয় চিন্তা কি মানুষের মনে উঁকি দেয়? এই অনুভুতি গুলো স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত সেবাদানকারীরা কিভাবে দেখেন? আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বিষয়গুলোর উপস্থিতি না থাকলেও অনেক দেশে এর কাঠামো বিদ্যমান। বিশেষ করে ক্যান্সার, এইডস বা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া রোগীদের ভিতর যে ধর্মীয়, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ভাবনার ঝড় বয়ে চলে সেগুলো আমলে নিয়ে তাদের কে চিকিতসা দেয়া হয়।
ভিকটর ফ্রাংকল নামে একজন মনোবিজ্ঞানী বলেন মানুষ কষ্টের কারনে শেষ হয়ে যায়না, সে শেষ হয়ে যায় ‘মানে খুঁজে না পাওয়া’ কষ্টের কারনে। ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা মানুষের জীবনের মানে খুঁজতে সাহায্য করে। আর তাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পাওয়ার কষ্ট মানুষকে বেশী তাড়া করে। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে থাকা মৃত্যুর মুখোমুখি মানুষ নানা রকম প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ঠিক এরকম টা কেন হচ্ছে তার সাথে? তিনি কি তার সব কাজ সারতে পারবেন মৃত্যুর আগে? স্রষ্টার সাথে কি দেখা হবে? কি হবে ওপারে? তার পরিবারের কি হবে? তাকে কি সবাই মনে রাখবে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর কঠিন হলেও শেষ সময়ে ডাক্তার বা আপনজনের কাছে তারা এর উত্তর ই খোঁজেন। অনেক দূরারোগ্য রোগ সারানো যায়না, কিন্তু রোগীর উতকন্ঠার অনেকটাই উপশম আনতে পারে এই উত্তর গুলো।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন তিন ভাবে রোগীর ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক দর্শন তার রোগে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। মৃত্যু হার কমিয়ে আনা, রোগের সাথে খাপ খেতে সাহায্য করা এবং রোগ থেকে সেরে উঠতে সাহায্য করা।দীর্ঘ জীবন লাভের সাথে আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক বেশ কিছু গবেষণা পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। যারা নিয়মিত আধ্যাত্মিক চর্চা করেন তাদের দীর্ঘজীবি হতে দেখা গেছে। নানা বিধ রোগের সাথে শরীরে অতি মাত্রায় ইন্টারলিউকিন-৬ এর মাত্রা দেখা যায়। প্রায় ১৭০০ জন বয়স্ক মানুষের উপর পরীক্ষায় দেখা গেছে এদের ভিতর যারা নিয়মিত চার্চে যেতেন তাদের অন্যদের তুলনায় ইন্টারলিউকিন-৬ বৃদ্ধির ঘটনা প্রায় অর্ধেক। ধর্মীয় চর্চার কারনে নিয়ন্ত্রিত মানসিক চাপ এর পিছনের কারন বলে গবেষকদের ধারনা।
ধর্মে বিশ্বাস মানুষকে জীবন সম্পর্কে ভালো ধারণা এনে দেয় এবং উন্নত জীবন যাপনে সাহায্য করে। কারন ধর্মবিশ্বাস মানুষের অস্বিত্বের একটি অংশ। আমেরিকান ব্যথা বিষয়ক সংস্থা একবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের উপর জরিপ করে দেখেন ৭৬ শতাংশ রোগী ব্যথা নিরাময়ে প্রার্থনা করে থাকেন। যেখানে ৬৬ শতাংশ শিরায় ব্যথানাশক উপাদান গ্রহন করেন, ৬২ শতাংশ ব্যথানাশক ইঞ্জেকশন নেন,৩৩ শতাংশ স্থিরতার ও চাপমুক্ত থাকার অভ্যাস করেন। অর্থাৎ ব্যথানাশক ঔষধ বা ব্যবস্থা গ্রহনের পাশাপাশি একটা বড় অংশই ধর্মীয় চর্চাকে উপযোগী মনে করেন। প্রসূতিজনিত ক্যানসার আক্রান্ত ১০৮ জন রোগীর উপর করা আরেকটি জরিপে এমন ই দেখা যায় যেখানে তাদের ৯৩% ধর্মীয় বিশ্বাস ধারন করেন, ৭৫% মনে করেন ধর্ম তাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে এবং ৪৫% বলেছেন অসুস্থ হয়ে তারা ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়েছেন।সক্রিয় ধর্মীয় চর্চা তাদেরকে রোগের সাথে খাপ খাওয়াতে এবং মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহায্য করে।এইডস রোগীদের উপর করা আরেকটি জরিপেও প্রায় একই রকম ফল আসে।
অন্য একটি জরিপে জানতে চাওয়া হয়েছিলো মৃত্যুর কাছাকাছি সময় তাদের কাছে কি গুরুত্ব রাখে? ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আপন কারো সংগ পাওয়ার বিষয়টি ছিল উত্তরের শীর্ষে। ধর্মীয় বিশ্বাস গুলোর মধ্যে ছিল এই পার্থিব জীবন ই শেষ নয়, উচ্চ মাত্রার জীবনে প্রবেশের একটি দরজা মাত্র; মৃত্যুর পর তারা স্রষ্টার সান্নিধ্য পাবে এবং তাদের সন্তানের মাঝে তারা বেঁচে থাকবে। পরিবারের নিকট কাউকে হারানোর শোক খুব কঠিন যা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় নেয়। ক্যান্সারে সন্তান হারানো এরকম ১৪৫ জন বাবা মায়ের উপর করা জরিপে দেখা গেছে তাদের ৮০% ধর্মীয় চর্চার কারনে সন্তানের মৃত্যুর এক বছ্র এর ভিতর অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছেন এবং এই সন্তান হারানোর পরের বছর তাদের ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্টতা ও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডাক্তার বা নার্স রা কিভাবে আধ্যাত্মিকতা বা ধর্মীয় বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সেবা দেন? স্বাস্থ্যখাতে সেবাদানকারীরা অত্যন্ত মায়া, আন্তরিকতা ও মনযোগ নিয়ে রোগীর সাথে সহাবস্থান (এটাকে বলা হচ্ছে compassionate presence) করার মাধ্যমে এটা করে থাকেন। তাদের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সকল কষ্টের পাশে থেকে তাদের সাহস যোগান। তাদের ভয়, আশা, ব্যথা ও স্বপ্নের কথা মন দিয়ে শোনেন, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন এবং প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যাপ্লান (এরকম প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মীয় গুরু যেমন পুরোহিত, ফাদার বা ইমাম যারা সংশ্লিষ্ট রোগীদের নানা ভাবে সাহায্য করে থাকেন)এর সাথে নিয়মিত সাক্ষাতের সুযোগ করে দেন। এই পদ্ধতিগুলো তাদের জীবনের শেষ সময় গুলোকে অনেক অর্থবহ করে তোলে। তারা অনেক স্থিরতা এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে মৃত্যু কে আলিঙ্গন করেন।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বা যাদের সংকটপূর্ণ অবস্থা হচ্ছে তাদের অনেকেই পৌঢ়, একাধিক ব্যধিতে ভূগছেন। সারা জীবন পরিবার, সমাজ এবং দেশের জন্য নিজ অংগনে কাজ করে গিয়েছেন তারা। ভাইরাসের এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক সময়ের মত নিকট পরিজন কে কাছে পাবার সুযোগ ও হারাচ্ছেন। এই সংকট কালে তাদের কষ্টের ভিতরেও ডাক্তার ও নার্স দের কাছ থেকে যদি তারা সামান্য আন্তরিক উপস্থিতি এবং ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ভাবনার মূল্যায়ন পান সেটা তাদের কষ্ট অনেকটাই লাঘব করবে।
ডাক্তার র্যাচেল নাওমির ভাষায়,
“Helping, fixing, and serving represent three different ways of seeing life. When you help, you see life as weak. When you fix, you see life as broken. When you serve, you see life as whole. Fixing and helping may be the work of the ego, and service the work of the soul”
তাই সংকটাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রেই শুধু না, শুধু কোভিড-১৯ এই না, সব সময়ের জন্য আমরা সেবা পাবো, ‘উন্নত সেবা’ যাতে আন্তরিকতা মেশানো থাকবে। কারন চিকিতসা কেবল সাহায্য করা বা সমস্যা সমাধান না,এটা একটা সার্বিক সেবা, যেখানে রোগীর শারীরিক, মানসিক আধ্যাত্মিক সমস্ত সত্তাকেই সময় নিয়ে পর্যবেক্ষন করা হয়। আধুনিক যন্ত্রের সেবার পাশাপাশি মানবিক এই সেবা আমাদের সকল রোগীরা পাবে কোভিড-১৯ সংকটে এরকম দৃঢ় প্রত্যয় গড়ে উঠুক আমাদের ভিতর।
তথ্যসূত্রঃ
লেখাটির মূলভাব ডাক্তার ক্রিস্টিনা এম পুচালস্কি এর নিবন্ধন (1) থেকে নেয়া।
1. Puchalski CM. The role of spirituality in health care. Proceedings. 2001;14(4):352-7.
Leave a Reply