তামাক অর্থনৈতিক ভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি গাছ। তামাকের বৈজ্ঞানিক নাম নিকোটিয়ানা টেবাকাম (Nicotiana tabacum)। তামাকের ব্যবহার ইতিহাস ৮,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নথিভুক্ত করা আছে। মধ্য মেক্সিকোতে ভুট্টাভিত্তিক কৃষিক্ষেত্রের বিকাশের সাথে সাথে খ্রিস্টপূর্ব ৫,০০০ সালে তামাকের চাষ শুরু হয়েছিলো। তামাকের ব্যবহার অবশ্য ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগের কারণ। জীববিজ্ঞান গবেষণাগারে যারা সেল কালচার নিয়ে কাজ করেন, তারা সবাই হেলা সেল-লাইনের সাথে পরিচিত। তামাক চাষে জড়িতদের ক্যন্সারের ঝুঁকি থাকে। হেনরিয়েটা ল্যাক্স ভার্জিনিয়ার একজন তামাক চাষী ছিলেন যিনি ১৯৫১ সালে জরায়ু মুখের ক্যান্সারে মারা যান। তাঁর অজান্তে তার অমৃত ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ নিয়েই পরবর্তীতে হেলা কোষ নামে গবেষণাগারে ক্যান্সার কোষ চাষ করা হয়। তাই ক্যান্সার কোষ-লাইন আবিষ্কারে ও তামাক চাষের বড়োসড়ো ভূমিকা ছিলো বলা যায়।
তামাকের ফলনে বড় ধরণের ক্ষতির কারণ হলো তামাকের মোজাইক রোগ। এই রোগটি তামাকের মোজাইক ভাইরাসের কারণে হয় (Tobacco Mosaic Virus / TMV )। রেডিওকার্বন প্রক্রিয়ায় জানা যায়, আমেরিকার নিউ মেক্সিকোতে উঁচু গুহায় ১৪০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ অবধি বন্য তামাক চাষ করা হতো। তখন কলম্বিয়ায় চাষকৃত তামাক পাতা জার্মানে সিগারের জন্য রপ্তানি করা হতো।
তখন বিশ্ব জুড়ে তামাক ও টোস্টেড বাদামে তৈরি নোট কাগজ এর মতো দেখতে সিগারের ধোঁয়া নেওয়া খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। সিগার হলো গাঁজন প্রক্রিয়ায় তৈরি শুকানো তামাক পাতার প্যাঁচানো গুচ্ছ বিশেষ যার ধোঁয়া নেওয়া হতো। সিগার দেখতে অনেকটা আমাদের দেশে পানের সাথে প্রচলিত সাদা পাতার মতো।
আবিষ্কার ও অনুসন্ধান
উনবিংশ শতাব্দীতে তামাকের মোজাইক রোগ ইউরোপে বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ ছিলো। ১৮৭৯ সালে ডাচ তামাক চাষীরা তরুণ রসায়নবিদ এডলফ মেয়ারের কাছে সাহায্যের জন্য যান। মেয়ার তামাক গাছগুলো যে পরিবেশে জন্মায় সে পরিবেশের মাটি, তাপমাত্রা, সূর্যালোক নিয়ে নিরীক্ষা করলেন। কিন্তু তিনি সুস্থ ও অসুস্থ গাছকে আলাদা করার কোন উপায় খুঁজে পেলেন না। তিনি ভাবলেন গাছগুলো হয়তো কোন অদৃশ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বলেছেন আলু এবং অন্যান্য উদ্ভিদের রোগের জন্য ছত্রাক দায়ী হতে পারে। তাই মেয়ার তামাক গাছে ছত্রাক আর পরজীবী পোকাও খুঁজলেন তবুও তিনি কিছু’ই পেলেন না। তিনি অসুস্থ গাছের রস নিয়ে তা সুস্থ তামাক গাছে প্রবেশ করালেন। সুস্থ গাছগুলো অসুস্থ হয়ে গেলো! মেয়ার বুঝতে পারলেন কোন আণুবীক্ষণিক জীব গাছগুলোর ভিতরে বংশবৃদ্ধি করছে। ল্যাবরেটরিতে তিনি অসুস্হ গাছের রস নিয়ে অনুকূল পরিবেশে রাখলেন। তাতে ব্যাক্টেরিয়ার বসতি হলো। তারা ধীরে ধীরে এত বড় হলো যে মেয়ার খালি চোখেই ব্যাক্টেরিয়ার কলোনি দেখতে পেলেন। মেয়ার এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে সুস্থ গাছে প্রবেশ করালেন এবং ব্যাক্টেরিয়াগুলো রোগ সৃষ্টি করে কি না তা দেখার জন্যে অপেক্ষায় রইলেন। কিন্তু গাছগুলোতে কোন রোগ সৃষ্টি হলো না। এই ব্যর্থতার সাথেই মেয়ারের গবেষণা কিছু সময়ের জন্যে আড়ালে চলে গেলো।
তখনও ভাইরাসের উপস্থিতি ছিলো সবার কাছে অজানা। টিএমভি হলো এক শতাব্দী আগে আবিষ্কৃত প্রথম বিশুদ্ধ ভাইরাস। ভাইরাস যেভাবে তাদের পোষক কে আক্রান্ত করে তা বিমোহিত করার মতো। পরবর্তীতে প্রাণের সাধারণ নীতিতে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত আবিষ্কারেও তামাকের মোজাইক ভাইরাসের গবেষণা নেতৃত্ব দিয়েছিলো। মেয়ারের ব্যর্থতার পর রাশিয়ান উদ্ভিদ-বিজ্ঞানী দিমিত্রি আইভানোস্কি ১৮৮৭ থেকে ১৮৯০ সালে মধ্যে পূর্ব ইউরোপে তামাক গাছের মোজাইক রোগটি অনুসন্ধান করেন। তিনি আক্রান্ত তামাক গাছ ধোয়া তরল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি দেখতে পান রোগ, সৃষ্টিকারী জীবাণু একটি সূক্ষ ছিদ্রের চীনামাটির ফিল্টারের ভেতর ব্যাকটেরিয়া আটকে রাখতে পারে ছাকনীর মতো। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে পরিশ্রুত তরলে কোন ব্যাকটেরিয়া না থাকলেও তা পুনরায় সুস্থ তামাক গাছে রোগ তৈরি করছে। কিন্তু তখনো আইভানস্কি এই আবিষ্কারের পূর্ণ তাৎপর্য বুঝতে পারেন নি।
চিত্রঃমার্টিন বেঞ্জেরিঙ্ক
১৮৯৮ সালে নেদারল্যান্ডসের মার্টিন বেঞ্জেরিঙ্ক প্রমাণ করেন যে পরিশ্রুত তরলে মোজাইক রোগের জন্য দায়ী কারণটি খুব ক্ষুদ্র এবং সংক্রামক। বেঞ্জেরিঙ্ক এটির নাম দিয়েছিলেন ছোঁয়াচে প্রাণরস । তিনি দেখান যে গবেষণাগারে টিএমভি ব্যাকটেরিয়ার মতো পেট্রিডিশে কালচার বা চাষ করা যায়না। একমাত্র-জীবন্ত ও বর্ধমান গাছপালাতেই এটি দেখা যায়। তখনো মানুষ ভাইরাস সম্পর্কে কিছু জানতোনা। বিজ্ঞানীরা রোগের কারণ হিসেবে শুধু ব্যকটেরিয়াকেই সংক্রামক বলে মনে করতো। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয় ‘জীবাণু’ অকোষীয় হতে পারে। তাই চিরতরে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সংজ্ঞা পরিবর্তন করা উচিত। বেঞ্জেরিঙ্কই সর্বপ্রথম ভাইরাস নামকরণ করেন। এর পরে ওয়েন্ডলে স্ট্যানলি টিএমভি ভাইরাসকে কেলাসায়িত করে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে ছবি তুলেন।
এজন্য তিনি ১৯৪৬ সালে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তবে ঐ সময়ে তিনি ভুল বলেন যে, মোজাইক ভাইরাস সম্পূর্ণটাই প্রোটিন দিয়ে তৈরি। ঠিক সে সময়ে ইংল্যাণ্ডে বাইডেন এবং পেরি দরকারী প্রমাণ পেশ করেন টিএমভি আসলে একটি রাইবোনিউক্লিওপ্রোটিন, আরএনএ ও কোট প্রোটিন দিয়ে তৈরি। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে জার্মান এবং আমেরিকান বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন ভাইরাসের আরএনএ-ই শুধু সংক্রামক ছিলো। এই তত্ত্বই আণবিক ভাইরাস বিদ্যার আধুনিক যুগ সূচিত করে।
আজ অবধি টিএমভি ভাইরাস গবেষণায় উদ্ভিদের ভাইরাস প্রতিরোধী জিন হিসেবে এখনও শীর্ষে ব্যবহৃত হয়। ভাইরাসকে বিকশিত করতে ট্রান্সজেনিক (সংকারয়ন) প্রযুক্তির জন্ম হয়। যা ওয়ার্ক হর্স হিসেবে ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ভ্যাকসিন উৎপাদনে উদ্ভিদের বাইরের জিনকে প্রকাশ করে। এখানে ওয়ার্কহর্স ভাইরাসকে বলা যায় যা একটি দলের প্রতিনিধির কাজ করে।
ভাইরাসের গঠন ও বৈশিষ্ট্য
তামাকের মোজাইক ভাইরাস হলো টোবামো ভাইরাস বংশের একটি ধনাত্মক-সূত্রক (পজেটিভ স্ট্রেন্ডেড) একক-প্রসারিত আরএনএ ভাইরাস প্রজাতি। যেসব ভাইরাসের জিনগত তথ্য আরএনএর একক স্ট্র্যান্ড নিয়ে গঠিত তাদের (পজিটিভ স্ট্রেন্ডেড) বলে। এটি দেখতে পাইপের মত প্যাঁচানো। টোবাকো মোজাইক ভাইরাস হলো টোবাকো মোজাইক ভাইরাস ভাইরাস প্রজাতির বৃহৎ দলের সদস্য যা সোলানেসি পরিবারের উদ্ভিদ তামাক ও অন্যান্য উদ্ভিদকে আক্রান্ত করতে পারে। টিএমভি রড-আকৃতি ভাইরাস কণা ৩০০ ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যের এবং ১৫ ন্যানোমিটার প্রস্হের হয়।
একটি একক টিএমভি কণা কোট প্রোটিনের ২,১৩০টি অনুলিপি দিয়ে গঠিত। এটি প্রায় ৬,৪০০ নিউক্লিওটাইড দৈর্ঘ্যের আরএনএ অণুকে আবৃত করে রাখতে পারে। নিউক্লিওটাইড আরএনএ অণু চারটি জিনকে সংকেত আকারে প্রকাশ করে। টিএমভি মেসেঞ্জার আরএনএ কে সরাসরি ট্রান্সলেশন করে দুইটি প্রতিরূপের মতো প্রোটিনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার আলোড়ন সৃষ্টি করে। আবৃত প্রোটিন সাবজেনোমিক আরএনএ কে ট্রান্সলেশন করে প্রোটিনে রূপান্তর করে এক গাছ থেকে আরেক গাছে স্হানান্তর করে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় মেসেঞ্জার আরএনএ বার্তা বাহকের কাজ করে।
উপসর্গ ও লক্ষণ
তামাকের মোজাইক ভাইরাস দিয়ে হওয়া রোগের লক্ষণসমূহ কিছুটা পোষক উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। মোজাইক, নেক্রোসিস, স্টান্টিং, পাতা কুঁকড়ানো এবং গাছের টিস্যু হলদেটে হতে পারে। লক্ষণগুলো আক্রান্ত গাছের বয়স, পরিবেশ, পরিস্থিতি, ভাইরাসের জাত এবং পোষক গাছের জিনগত পটভূমির উপর নির্ভর করে। ভাইরাসের জাত টমেটোতেও সংক্রামিত হলে কখনও খারাপ ফলন বা বিকৃত ফল দেখা যায়। ফল পাকতে দেরি হয় এবং ফলের রঙ ভিন্ন হয়।
অনুলিপনচক্র ও রোগ তত্ত্ব
তামাকের মোজাইক রোগে আক্রান্ত পাতা বাগানের দূষিত সরঞ্জামের মাধ্যমে অন্য কোন স্বাস্থ্যকর গাছের পাতার পিঠে ঘষলে তা আক্রান্ত হয়। মাঝে মাঝে কর্মীদের হাতে সিগারেটে থাকা তামাকের গুঁড়ায় মোজাইক ভাইরাস থেকে সহজেই সংক্রমণ হয়। আহত উদ্ভিদ কোষে টিএমভি প্রবেশের ছাড়পত্র দেয়। ভাইরাসটি বীজের বহিরাবরণকেও দূষিত করতে পারে। ফলে সেই বীজ থেকে অঙ্কুরিত গাছও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। টিএমভি অদ্ভুতরকম স্হিতিশীল।। পরিশোধিত টিএমভি পরিক্ষাগারে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ৫০ বছর সংরক্ষণের পরেও সংক্রমণক্ষম থাকে ।
গাছের কোষে ছোট ক্ষত করে প্রবেশ করার পর ভাইরাস কণা টিএমভির আরএনএ প্রকাশে সাহায্য করতে জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভাইরাসের পজেটিভ সেন্স আরএন সরাসরি একটি মেসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ) তৈরি করে। এটি পোষকের রাইবোসোমকে কাজে লাগিয়ে ট্রান্সলেশন প্রক্রিয়ায় নতুন ভাইরাসের বিভিন্ন কণা সংশ্লেষণ শুরু করে। রেপ্লিকেজ সংশ্লিষ্ট প্রোটিন সংক্রমণের কয়েক মিনিটের মাঝে ট্রান্সলেশন শুরু করে ।
অনুলিপন চক্র
টিএমভির এই প্রোটিন সংশ্লেষিত হয়ে প্রতিরূপটির আরএনএর ৩’-প্রান্তের সাথে যুক্ত হয় নেগেটিভ সেন্স আরএনএ তৈরি করে। আরএনএ হলো পূর্ণ দৈর্ঘ্যের জিনোমিক যা (+) আরএনএ এর পাশাপাশি (+) পজেটিভ সাবজেনোমিক আরএনএ (এসিজি-আরএনএ) উভয় তৈরি করার ছাঁচ তৈরি করে। ক্যাসিজি-আরএনএ(CCACG- RNA)পোষক রাইবোসোম দিয়ে ট্রান্সলেট করে মুভিং প্রোটিন (এমপি) ৩০ কিলোডাল্টন এবং কোট প্রোটিন ১৭.৫ কিলোডাল্টন উৎপাদন করে (কিলোডাল্টন হলো প্রোটিনের আকারের পরিমাপ)। তারপরে আবৃত প্রোটিন ও প্রজনিত ভিরিওন সমাবেশ করতে নতুন সংশ্লেষণ করে টিএমভির আরএনএর সাথে যোগাযোগ করে। এই ভাইরাসের কণাগুলি এতোই স্থিতিশীল যে কোথাও কোষ নষ্ট হলে বা পাতা শুকিয়ে গেলে ও তারা নতুন গাছকে আক্রান্ত করে। বিকল্পভাবে টিএমভি আরএনএর নড়নক্ষম প্রোটিন দিয়ে আবৃত থেকে জটিল প্রণালীতে কোষে ছড়িয়ে পড়ে ।
সংক্রমণ ও বিস্তার
ভাইরাসটি প্রোটিন ব্যবহার এক কোষ থেকে অন্য কোষে প্লাজমোডেস্মাটার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি উদ্ভিদের কোষকে যুক্ত করে রাখে। অক্ষত টিএমভি প্লাজমোডমাস্ট নামক ছোট একটি চ্যানেল দিয়ে প্রতিবেশী উদ্ভিদ কোষের সাইটোপ্লাজমকে একে অপরের সাথে সরাসরি যুক্ত করে কোষের মধ্যে জীবন্ত সেতু স্থাপন করে)।
মুভমেন্ট প্রোটিন অজানা পোষক প্রোটিনের সহায়তায় প্লাজমোডম্যাটাল চ্যানেল প্রসারিত করে যাতে টিএমভি আরএনএ এর পাশে থাকা কোষে চলে যেতে পারে। যা আন্দোলিত প্রোটিন আর পোষক প্রোটিনকে নতুন দফা সংক্রমণের সু্যোগ করে দেয় । তখন ভাইরাসটি এক কোষ থেকে অন্য কোষে স্থানান্তরিত হয়। সেই সময়ে অনবরত উদ্ভিদের শিকড় এবং ডগায় ফ্লোয়েম টিস্যুর মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে উদ্ভিদের পরিবহন টিস্যুতে (ভাস্কুলার সিস্টেমে) পৌঁছে যায়।
মোজাইক ভাইরাসের মহামারি
টিএমভি রোগ চক্রের সাথে মোজাইক ভাইরাসের মহামারির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে। কারণ ভাইরাস পুরোপুরিভাবে প্রতিলিপি হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পোষক উদ্ভিদের প্রয়োজন। জমিতে রোগ শুরুর সময় এবং শস্য আবাদের উপর নির্ভর করে রোগের প্রকোপের মধ্যে অনেকগুলো প্রকারণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মৌসুমের শুরুর দিকে কয়েকটি গাছ সংক্রামিত হতে পারে। বীজের আবরণ থেকে টিএমভি শ্রমিকদের মাধ্যমে গাছে দূষিত হয় । রোগটি তখন টিএমভি আক্রান্ত গাছের সাথে স্বাস্থ্যকর গাছের যোগাযোগের মাধ্যমে, সরঞ্জাম বা শ্রমিকদের মাধ্যমে পুরো ক্ষেত্র বা গ্রিনহাউস জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। টিএমভি আক্রান্ত উদ্ভিদের ধ্বংসস্তূপ বা বহুবর্ষজীবী (আগাছা) পোষকে এমনকি মাটিতেও বেঁচে থাকতে পারে বা নির্জীব থাকতে পারে। কৃষি জমিতে অনবরত একই ফসল চাষ করলে রোগটি পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় । গ্রিনহাউজে টিএমভির (ইনোকুলাম) জীবাণু টিকে থাকলে একাধিক গাছের প্রজাতিতে বৃদ্ধি পেতে পারে।
রোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রতিকার
- গ্রিনহাউস ব্যবস্থাপনা: বাগান চর্চায় গাছের সংক্রমণ কমাতে সব সরঞ্জামগুলো সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে বা ভাইরাসটি নিষ্ক্রিয় করতে ঘরে তৈরি ১০% ব্লিচিং দ্রবণ ব্যবহার করতে হবে। টিএমভি-দূষিত মাটি ফেলে দিতে হবে। সংক্রামিত গাছ থেকে স্বাস্থ্যকর গাছে ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে, জল দেওয়ার পাইপ এর সাথে গাছের স্পর্শ এড়ানো উচিত। মরা পাতা এবং পুরাতন গাছপালা নিষ্পত্তি করা উচিত। কারণ শুকনো, আক্রান্ত পাতা গ্রিনহাউসের চারপাশে ‘ধুলাবালি’ হিসেবে উড়িয়ে দিলে স্বাস্থ্যকর গাছ ও আক্রান্ত হতে পারে।
- ক্রস সুরক্ষা: কচি গাছে ভাইরাসের একটি মৃদু জাতকে তীব্র জাত দিয়ে কলম করে (গ্রাফটিং) টিএমভির সংক্রমণ মুক্ত করা যেতে পারে। এটি হলো একটি তথ্যচিত্র ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল, “ক্রস সুরক্ষা” নামে পরিচিত গ্রিনহাউস ক্রিয়াকলাপে সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়। ট্রান্সজেনিক গাছ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বিকল্প কৌশল হিসেবে কাজে লাগায় কৃষকরা। বেশ কয়েকরকম তামাক এবং টমেটোতে টিএমভি প্রতিরোধী জিন পাওয়া গেছে।
- জৈব প্রযুক্তিঃ জিন প্রকৌশল প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা ট্রান্সজেনিক তামাক এবং টমেটো গাছে টিএমভির কোট প্রোটিন জিনকে প্রকাশ করেছিলো। এই নিয়ন্ত্রণ কৌশলটি ভাইরাস এর সাথে ঘনিষ্ট জাত থেকে বাঁচাতে রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করে।
- ইনোকুলাম নির্মূল : পরীক্ষামূলকভাবে এটি দেখানো হয় শ্রমিকেরা গাছ রোপণের আগে দূষিত হাত ধুয়ে নিলে টিএমভি নিষ্ক্রিয় হতে পারে। এই সামান্য কৌশলে রোগের প্রকোপ অনেকটাই কমে যায়। টিএমভি-দূষিত মূল বা গাছের ধ্বংসস্তূপ রয়ে গেলে পরিচিত সংবেদনশীল চারাগাছ ঐ মাটিতে স্হানান্তর করা উচিত নয়।
- শস্য ক্ষেত পরিচালনা: রোগের জন্য বাড়ন্ত মৌসুমে দেখাশোনা, আক্রান্ত গাছের শেকড় মাটি খনন করে, জোগাড় করে ক্ষেত থেকে সরানো উচিত। ঘূর্ণন অনুশীলনে প্রতিরোধী উদ্ভিদ বা অপোষক ফসল চাষে জীবাণুর পরিমাণ কমানো উচিত।
- ফসল ও সংরক্ষণ পরিচালনা: টিএমভি সহজেই বীজের বহিরাবরণে নির্জীব থাকতে পারে, তখন পরবর্তী রোপণ চক্রে জীবাণুর উৎস হতে পারে। তাই টিএমভি-দূষিত তামাকের বীজকে ১৫ মিনিট ট্রাইসোডিয়াম ফসফেটের ১০% দ্রবণে চুবিয়ে রাখা জরুরি। টিএমভিতে দূষিত টমেটো বীজ রোপণের ২-৪ দিন আগে ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ও আক্রান্ত হতে পারে। উভয় পদ্ধতিতে বীজের বহিরাবরণে থাকা ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হলেও বীজের অঙ্কুরোদগমে নিছক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ।
তথ্যসূত্রঃTobacco mosaic virus
ছোঁয়াচে প্রাণরসঃ টোবাকো মোজাইক ভাইরাস এবং ভাইরাস জগতের আবিষ্কার
অণুজীববিজ্ঞানে ভাইরাসের প্রথম সূচনা ও বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রাম
Leave a Reply