‘বংশে’-র গল্প কিভাবে ‘গতি’ পেল

লেখাটি , , বিভাগে প্রকাশিত

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলায় কৃষক হরিপদ কাপালি নিজ ধানের ক্ষেতে চাষাবাদের সময় একটি অনন্য পর্যবেক্ষণ করেন। ধানগাছের একটি ছড়া তার নজর কাড়ে, যার গোছা পুষ্ট, ছড়া গুলো দীর্ঘ। তিনি এ ছড়া সংগ্রহ করে পাকা ধান বীজ হিসেবে রেখে দেন। পরের মৌসুমে চাষ করে এই বীজ থেকে তিনি আশাতীত ফলন পেলেন। এ থেকে পৃথিবীতে নতুন জাতের ধান ‘হরিধান’ শুরু হলো। নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে ফসলের বীজ সংগ্রহ করার এ কাজটি পৃথিবীর ইতিহাসে কৃষকরা হাজার হাজার বছর ধরে এই পরীক্ষাটি করে আসছেন। একে বলে কৃত্রিম নির্বাচন।

১৮৫৯ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার ‘অন দ্যা অরিজিন অব স্পিসিস’ বইটি বের করেন। কোন প্রজাতিই সময়ের সাথে সাথে অপরিবর্তিত থাকে না সেটা তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ সময়ের বিবর্তনে নতুন নতুন প্রজাতি বিবর্তিত হয়। এজন্য তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের অবতারণা করেন। তিনি দেখালেন, হাজার হাজার বছর ধরে কৃষকেরা যেভাবে প্রজন্ম-পরম্পরায় এক ধরনের বন্য ঘাসের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্বাচনের মাধ্যমে থেকে গম-ধান প্রভৃতি ফসলের আধুনিক জাত তৈরি করেছে, ঠিক অনুরূপ প্রক্রিয়ায় প্রকৃতিতে কোন প্রজাতির জনপুঞ্জে বিভিন্ন বৈচিত্র্যর মধ্য থেকে সেরা বৈশিষ্ট্য নির্বাচিত হয়ে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে (জনপুঞ্জ হলো নির্দিষ্ট এলাকায় একটি প্রজাতির সকল স্বতন্ত্র জীবের সমষ্টি)। কিন্তু তার তত্ত্বে একটা বড়ধরনের ফাঁক ছিলো। তিনি জানতেন না কিভাবে বংশগতি কাজ করে, জনপুঞ্জে কিভাবে বৈচিত্র্য তৈরি হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন পিতা-মাতা থেকে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্য মিলে-মিশে গিয়ে নতুন মিশ্র বৈশিষ্ট্য তৈরি করে। অনেকটা জলরঙ-এ নীল ও হলুদ রং মিশে সবুজ রঙ তৈরির মতো। গ্রীক দার্শনিক হিপোক্রেটিস দ্বারা প্রভাবিত এ তত্ত্বকে বলা হয় প্যানজেনেসিস। তবে প্যানজেনেসিস তত্ত্ব অনুযায়ী একটি সমস্যা হলো বংশপরম্পরায় বংশগতির তথ্য মিলে মিশে একাকার হয়ে একসময় জনপুঞ্জে সকল প্রজাতির বংশগতির তথ্য একই রকম হয়ে যাবে। ঠিক যেমন সকল রঙ মিশালে সাদা রঙ তৈরি হয়। বাস্তবে কোন জনপুঞ্জে এরকম দেখা যায় না যে বৈচিত্র্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

বিজ্ঞান জগত কাকতালীয় ঘটনায় পূর্ণ। সমসাময়িক বছরেই অস্ট্রিয়ার এক খ্রীষ্টান-ভিক্ষু গ্রেগর জোহান মেন্ডেল তার বাগানে ধারাবাহিক পরীক্ষা শুরু করেন। তিনি সাত বছর ধরে মটরশুঁটি গাছে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বংশগতির তথ্য কিভাবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয় তার একটি কাঠামো তৈরি করছিলেন। মেন্ডেলকে বলা হয় বংশগতিবিদ্যার জনক। তবে সেই সময়ে মেন্ডেল একাই এ ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন এমন না। আরো অনেক বিজ্ঞানীই বিভিন্ন কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বংশগতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। সমস্যা হলো, তারা একই সময়ে একাধিক বৈশিষ্ট্য (উচ্চতা, রঙ, মসৃণতা ইত্যাদি) নিয়ে কাজ করছিলেন। একাধিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করলে কৃত্রিম প্রজনন পরীক্ষার ফলাফল ব্যখ্যা করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে মেন্ডেল এক বারে একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করতেন। এছাড়া গবেষণার জন্য তিনি মটরশুঁটির যেসব বৈশিষ্ট্য বেছে নিয়েছিলেন তা একে অপরের উপর নির্ভরশীল ছিলো না। মটরশুঁটি গাছের উচ্চতা, মটরদানার রঙ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সুনির্দিষ্টভাবে স্থানান্তরিত হতো। তিনি মটরশুঁটির সাতটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করেন। একটি পরীক্ষায় তিনি বেগুনী ফুলের মটরশুঁটির সাথে সাদা ফুলের মটরশুঁটি গাছের কৃত্রিম প্রজনন করেন। দেখা গেল পরবর্তী প্রজন্মে (যাকে F1 বলা হয়) সব গাছই বেগুনী রঙের ফুল দিচ্ছে। F1 প্রজন্মের গাছগুলোকে পুনরায় নিজেদের মধ্যে প্রজনন ঘটালে দেখা গেল এর পরের প্রজন্ম (F2) অধিকাংশ গাছ বেগুণী ফুল দিলেও কিছু কিছু গাছ সাদা ফুল দিচ্ছে। অর্থাৎ সাদা রঙের ফুল বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী বংশগতির সংকেত হারিয়ে যায় নি। মেন্ডেল যাজক হিসেবে কাজ করার আগে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত পাঠ করেছিলেন। এজন্য তার পরিসংখ্যানে ভালো ভিত্তি ছিলো। কিভাবে একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পরিকল্পনা করতে হয় সেটাও তিনি শিখেছিলেন। তিনি দেখলেন, বেগুনী ও সাদা ফুলের মটরশুঁটি গাছ সবসময়েই একটি নির্দিষ্ট অনুপাত ৩:১ বজায় রাখছে। শুধু ফুলের রঙ নয়, অন্যান্য বৈশিষ্ট্য (যেমন গাছের উচ্চতা, বীজের মসৃণতা ইত্যাদি) নিয়ে পরীক্ষা করে F1 ও F2 প্রজন্মে তিনি অনুরূপ পর্যবেক্ষণ করেন। তার পর্যবেক্ষণের উপসংহার ছিলো প্যানজেনেসিস ভুল, কারণ কোন মিশ্র বৈশিষ্ট্যের (মাঝারী উচ্চতার) গাছ তৈরি হলো না। তবে একটি বৈশিষ্ট্য (বেগুনী রঙ) প্রভাব বিস্তার করছে অন্যটির উপর। পাশাপাশি, F2 প্রজন্মে আগের প্রজন্মে নিরব থাকা বৈশিষ্ট্যও (সাদা রঙ) ফেরত আসছে (ছবি)।

বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করে বার বার একই অনুপাতের আবির্ভাব দেখে মেন্ডেলের বুঝতে কষ্ট হলো না এর মানে কি। মেন্ডেল বুঝতে পারলেন এসব বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন ‘ফ্যাক্টর’ দিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পরিবাহিত হচ্ছে। এদের কোনটি শক্তিশালী, কোনটি দুর্বল। মেন্ডেল শুরুতে যে গাছ নিয়ে আন্ত:প্রজনন করেছেন তাদের উভয়ই ছিলো ‘সমধর্মী’। অর্থাৎ একটি গাছে শুধুমাত্র শক্তিশালী ও অন্যটিতে দুর্বল বৈশিষ্ট্যের ফ্যাক্টর। কৃত্রিম প্রজননে F1 প্রজন্মের সকল গাছে দুই ধরণের ফ্যাক্টরই বিদ্যমান থাকে, কিন্তু শুধু শক্তিশালী বৈশিষ্ট্যের ফ্যাক্টরই প্রকাশিত হয়। কিন্তু F2 প্রজন্মে শক্তিশালী-শক্তিশালী, শক্তিশালী-দূর্বল ও দূর্বল-দূর্বল বৈশিষ্ট্যের ফ্যাক্টরের বিন্যাস তৈরি হয়। এদের মধ্যে শুধু দূর্বল-দূর্বল ফ্যাক্টর দুর্বল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। বাকি দুইটি বিন্যাস শক্তিশালি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। ফ্যাক্টরগুলোর সমন্বয়ে তৈরি হয় জেনোটাইপ। একই ফেনোটাইপের পেছনে জেনোটাইপ এক নাও হতে পারে।

[লেখাটি আমার জেনেটিক্স: বংশগতিবিদ্যার সহজপাঠ বইটি থেকে নেয়া। বইটি পাওয়া যাচ্ছে বাতিঘররকমারী ও চন্দ্রদ্বীপ সহ বিভিন্ন বইয়ের দোকানে।]

লেখাটি 181-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 911 other subscribers