রোগব্যাধী ও মৃত্যু থেকে দূরে থাকার জন্য বর্তমানে আমাদের আছে বৈচিত্র্যময় ও বিশাল পরিমাণ ঔষধের সরবরাহ। মজার ব্যাপার হলো জীবন রক্ষাকারী উল্লেখযোগ্য অনেক ঔষধ তৈরী করা হয়েছে প্রাণঘাতী বিভিন্ন বিষ থেকে।
উপরের চিত্রটি মানুষের পরিচিত সবচেয়ে বিষাক্ত উপাদানের ত্রিমাত্রিক গঠন। এই বিষাক্ত যৌগটির মাত্র এক চা চামচ পরিমাণ, একটি দেশের সকল মানুষকে মারার জন্য যথেষ্ট। এক কেজি পরিমাণ এই বিষ সমগ্র পৃথিবীর সকল মানুষকে মারতে সক্ষম। এই বিষ এতটাই বিপদজনক যে সামরিক নিরাপত্তায় এটিকে উৎপাদন করা হয়। পাশাপাশি, এ বিষের প্রতি কেজির মূল্য ১০০ ট্রিলিয়ন ইউরো। যা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত তৈরী হওয়া সবচেয়ে দামী ও ব্যয়বহুল উপাদান।
এই মারাত্মক বিষাক্ত উপাদানটি হলো বোটুলিনাম বিষ (Botulinum Toxin) , যা বোটক্স (Botox) নামেই অধিক পরিচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সসেজ জাতীয় খাদ্যে প্রাপ্ত ব্যাকটেরিয়য় বোটক্স আবিষ্কৃত হয়। ল্যাটিন ভাষায় সসেজ মানে হলো বোটুলাস (Botulus)। এখান থেকেই এই বিষের নামকরণ করা হয়েছে।
কোন বিষের বিষাক্ততা মাপার জন্য আছে LD50 স্কেল। কোন বিষ প্রয়োগের পর বিষ দ্বারা আক্রান্ত মানুষের অর্ধেক সংখ্যক মানুষ মারতে ঐ বিষের কি পরিমাণ প্রয়োজন তা এই স্কেল দিয়ে পরিমাপ করা হয়। এই স্কেলে বোটক্স এর মান হল ০.০০০০০১ মিলিগ্রাম/কেজি। অর্থাৎ একজন ৭০ কেজি ভরের মানুষকে মারতে আপনার মাত্র ০.০০০০৭ মিলিগ্রাম বোটক্স প্রয়োজন হবে।
অন্যভাবে বললে আপনার জন্য প্রাণঘাতী এক ডোস বোটক্স-এর ওজন এক কিউবিক মিলিমিটার বায়ু থেকেও কম।বোটুলিনাম বিষ শ্বসনক্রিয়া সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে আক্রান্তব্যক্তিকেমেরে ফেলে। বোটক্স হলো নিউরোটক্সিন (Neurotoxin) অর্থাৎ এটি স্নায়ু কোষে প্রবেশ করে এবং কোষ ও কোষের অভ্যন্তরের প্রোটিন ধ্বংস করতে শুরু করে।
সাধারণত স্নায়ুকোষের অ্যাক্সন দ্বারা স্নায়ু অনুভূতি তড়িৎ সংকেত (Electric Impules) হিসেবে স্নায়ুসন্ধির কাছাকাছি পৌঁছায়। সেখানে এটি এসিটাইলকোলিন নামক রাসায়নিক সংকেতে (Neurotransmitter) পরিবর্তিত হয়ে স্নায়ুসন্ধি অতিক্রম করে এবং পেশীকোষে যায়। পেশীকোষের যেয়ে এই রাসায়নিক সংকেত পুনরায় তড়িৎ সংকেতে পরিবর্তিত হয় যার ফলে পেশী কোষ সংকোচিত হয়।
অ্যাক্সন নামক যে প্রান্ত দ্বারা একটি স্নায়ুকোষ, পেশীকোষের সাথে সন্ধি সৃষ্টি করে সেখান থেকে এসিটাইলকোলিন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে পরে। ফলে স্নায়ুকোষ ও পেশীকোষের মাঝে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। রোগী পেশী সঞ্চালনে অক্ষম হয়ে পরে এবং প্যারালাইসিসে আক্রান্ত্র হয়। শুধুমাত্র আক্রান্ত স্নায়ুকোষের নতুন অ্যাক্সন গঠনের মাধ্যমেই পেশির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এতে সময় লাগতে পারে মাসের পর মাস।
বোটক্স এত বিষাক্ত হওয়ার পরেও এত জনপ্রিয় কিভাবে হলো? এই বিষের জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে মূল কারণ হলো বয়স বৃদ্ধির সাথে মানুষের চেহারায় ও ত্বকে যে ভাঁজ সৃষ্টি হয় তা এই বিষ দূর করতে সক্ষম। যেসকল স্নায়ুকোষ ত্বকে ভাঁজ সৃষ্টির জন্য দায়ী সেসকল স্নায়ুকোষ ধ্বংসের মাধ্যমেই বোটক্স ত্বকের ভাঁজ হওয়া বা কুঞ্চন রোধ করে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত বোটক্সের পরিমাণ অতি ক্ষুদ্র, যা প্রায় এক গ্রামের ১ বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ এবং এটি স্যালাইনের সাথে মিশ্রিত করে প্রদান করা হয়। বোটক্স ব্যবহারের ফলে ত্বক ঠিকই মসৃণ হয়, তবে স্নায়ুকোষের নতুন অ্যাক্সন গঠনের পূর্ব পর্যন্ত মুখে এক অদ্ভুতুরে অভিব্যক্তির সৃষ্টি করে।
বোটুলিনাম বিষ শুধুমাত্র একটি সাধারণ সৌন্দর্য্যবর্ধক উপাদান হিসেবেই ব্যবহৃত হয়, তা কিন্তু নয়। নানাবিধ স্বাস্থ্যগত সমস্যা সমাধানেও বোটক্স অত্যন্ত উপযোগী। এদের মধ্যে আছে তির্যকদৃষ্টি (Eye Squints), মাইগ্রেন, অত্যধিক ঘামরোগ, দুর্বল মূত্রথলী ইত্যাদি । বর্তমানে ২০ এর অধিক রোগ নিরাময়ের জন্য বোটক্স ব্যবহার করা হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিষ দিয়ে চিকিৎসার এটি তো একটি মাত্র উদাহরণ। এরকম আরও অনেক আছে। ক্যাপটোপ্রিল (Captopril) হলো উচ্চ রক্তচাপ নিরাময়ে ব্যবহৃত অতি মূল্যবান এক ঔষধ। এটি প্রস্তুত করা হয়েছিল সাপের বিষ থেকে। এক্সেনাটাইড (Exenatide), যার বাণিজ্যিক নাম বেয়েট্টা (Byetta) একটি কার্যকরী ও অত্যন্ত লাভজনক ঔষধ। এই ঔষধ টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোতে বাস করা গিরিগিটি, গিলা মনস্টার (Gila Monster) এর বিষাক্ত লালারস গবেষণা করে এই ঔষধটি আবিষ্কার করা হয়।
বিষ যে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে তার ইতিহাস কিন্তু মোটেও মধুর নয়। রাণী ভিক্টোরিয়ার যুগ, ব্রিটেনে তখন জীবন বীমার পরিমাণ হুড়হুড় করে বেড়ে চলেছে। এই জীবন বীমার সহজলভ্য টাকার লোভে খুনের পরিমাণও তুমুল পরিমাণে বাড়তে থাকে। এদের অধিকাংশই সংঘটিত হয়েছিল বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে।
তখনকার অনেক বেশি আলোচিত মামলার একটি ছিল মেরি এন কটন নামক মহিলার নামে। তিনি ১৮৭৩ সালে একাধিকবার খুনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি ৪ বার বিয়ে করেন এবং তার ৩ স্বামীই সমৃদ্ধ বীমার মালিক ছিলেন। তারা সকলে স্ত্রীর হাতে খুন হন। বেঁচে যাওয়া স্বামী বীমা উত্তোলনে অস্বীকৃতি জানালে তিনি তার স্বামীকে ত্যাগ করেন।
তার মোট ১০ সন্তান মারা যায় পরিপাক জটিলতার কারণে। মানবিকভাবে প্রতিটা মৃত্যু দুঃখজনক হলেও কটনের জন্য তা ছিল আরও বীমার টাকার হাতছানি। তার শাশুড়ি, ননদ, স্বামী সবাই এক এক করা মারা যায়। ১৮৭২ সালের মাঝে, এই মহিলা বিস্ময়করভাবে ১৬ জন নিকট আত্মীয়কে হারান। বাকি ছিল শুধুমাত্র একজন। তার ৭ বছর বয়সি ছেলে ,চার্লস। তিনি তার ছেলেকে স্থানীয় কারখানায় পাঠাতে চাইলেও কারখানার লোক রাখতে রাজি হন নি। এর কদিন পরেই অল্পবয়সী চার্লসও মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়ে। কারখানার ম্যানেজার এর মনে এই ঘটনা সন্দেহের উদ্রেক করলে তিনি স্থানীয় পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেন। নান ঘটনা শেষে পুলিশ সিদ্ধান্তে আসেন যে কটন, শিশু চার্লসকে বিষ প্রয়োগ করেছেন। তারা জানতে পারেন এ কাজটি করা হয়েছে আর্সেনিক প্রয়োগের মাধ্যমে।
আর্সেনিক অক্সাইড সমূহ হল খনিজ । বিষ হিসেবে এসব খনিজ প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এসব অক্সাইড স্বাদহীন, গরম পানিতে দ্রবণীয় এবং একটি মানুষ মারার এক আউন্স পরিমাণের ১০০ ভাগের ১ ভাগই যথেষ্ট। তবুও ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই আর্সেনিক খনিজ ইঁদুর মারার বিষ হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হতে থাকে। ফলে সে সময় আর্সেনিক অক্সাইড ছিল সস্তা ও সহজলভ্য। শিশুরা খুশিমনে দোকান থেকে চা, চিনি, শুঁকনো খাবারের পাশাপাশি এটিও কিনতে পারত।
অন্যদিকে, আদালতে মেরি এন কটনের বিচার নির্ভর করছিল পুলিশ তার সৎ ছেলে চার্লসের দেহে আর্সেনিকের আলামত খুঁজে পায় কিনা তার উপর। সে সময় ফরেন্সিক বিজ্ঞান যথেষ্ট সমৃদ্ধ না হলেও আর্সেনিকের উপস্থিতি নির্ণয়ের একটি ভালো পরিক্ষা তাদের জানা ছিল। মৃত শিশু চার্লসের পাকস্থলী ও অন্ত্র থেকে নেয়া নমুনা এসিড ও কপারের সাথে উত্তপ্ত করা হয়। কপার গাড় ধূসর রঙ ধারণ করলেই আর্সেনিকের উপস্থিতি প্রমাণ হবে।
পুলিশ তদন্ত করে প্রমাণ করে যে, প্রাণঘাতী আর্সেনিকের ডোস প্রদানের মাধ্যমে শিশু চার্লসকে হত্যা করা হয়। কটনকে চার্লসের খুনের দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় এবং দুরহাম জেলে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। এরকম বহু বেপরোয়া খুন ও বিষ প্রয়োগের ঘটনাই আমাদের প্রথম ‘আর্সেনিক আইন’ ও এরপর‘ঔষধ আইন ১৮৬৮’ এর দিকে নিয়ে যায়। এই আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন ফার্মাসিস্ট এবং ঔষধ-বিক্রেতাই নানাবিধ বিষাক্ত উপাদান ও বিপদনক ঔষধ বিক্রি করতে পারবে।
তাই বলা যায় যে, বিষক্রিয়া, দুর্ঘটনা, খুন এসবের মাধ্য দিয়েই বর্তমান ‘বৈধ’ আধুনিক ঔষধ শিল্পের অঙ্কুরোদগম ঘটে। জানলে অবাক হবেন এই আর্সেনিক ট্রাইঅক্সাইডই ক্যান্সার প্রতিরোধে বৈধভাবে চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহার হয়।
তথ্যসূত্রঃ bbc.com/news/magazine-24551945
বিঃদ্রঃ লেখাটি জিরো টু ইনফিনিটি ম্যাগাজিনের মে-জুন ২০১৮ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে
Leave a Reply