[বিজ্ঞান লেখক কার্ল জিমার নিজের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছিলেন। শুধু তাই না, বিভিন্ন বিজ্ঞানীর সাথে মিলে নিজের জিনোমের ব্যবচ্ছেদও করেছিলেন। বায়োইনফরমেটিক্স, জেনোমিক্স, সিকোয়েন্স এনালাইসিসের প্রতিটি ধাপে খুঁটিয়ে বুঝেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে তার একটা বিশাল ধারাবাহিক আছে, Game of Genomes। প্রায় দুই বছর আগে লস এঞ্জেলসে একটা বিজ্ঞান বক্তৃতায় কার্ল জিমারের সাথে আমার দেখা হয়। এই সিরিজটা বাংলাতে অনুবাদের জন্য অনুমতি পাই তার কাছ থেকে (এবং মূল প্রকাশক ওয়েব-ম্যাগাজিনের কাছ থেকে)। এটা আমার জন্য একটা বিশাল ব্যপার কারণ এই লেখককে আমি বহুদিন ধরে অনুসরণ করে আসছি। তিনিও কোন দ্বিধা ছাড়াই অনুবাদের অনুমতি দেন। অনুবাদটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে বিজ্ঞান ব্লগে। সূচীপত্র ]
[সূচীপত্র | পরের অধ্যায়]
খন্ড-১, অধ্যায়-১
হার্ডড্রাইভের মধ্যে মানুষটি
সম্প্রতি এক বিজ্ঞানী সহগবেষকদের সামনে আমাকে দেখিয়ে ঘোষণা দিলেন, “এই ব্যক্তি কার্ল জিমার নন।”
তিনি মার্ক জেরস্টেইন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা প্রফেসর। আমি গিয়েছিলাম তার কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে আরো দু’জন ল্যাব-সদস্য সাথে বসে ছিলেন তিনি। টেবিলের উপরে রাখা একটা হার্ড ড্রাইভ। সেটা দেখিয়ে তিনি বললেন, “আসল কার্ল জিমার এখানে”।
“এখানে” বলতে তিনি মূলত আমার জিনোম অনুক্রম বোঝালেন। আমার জিনোম অনুক্রমের উপাত্ত তখন ঐ ড্রাইভ থেকে একটা ম্যাকবুক কম্পিউটারে স্থানান্তরিত হচ্ছিলো।
“আমি কিন্তু মজা করছি না,” জারস্টেইন আবার বললেন। “মিনিট পাঁচেকের মধ্যে জিমার এই কম্পিউটারে চলে আসবেন।”
আমি জারস্টেইনের কাছে গিয়েছিলাম আমার জিনোম বিস্তারিত অনুসন্ধান করার জন্য। আমার বিশেষজ্ঞ সাহায্য দরকার। আমার বংশগতিতে আসলে কি লেখা আছে?
হ্যাঁ, আজকাল আপনি বিভিন্ন কোম্পানীর কাছে মুখের থুতুর নমুনা পাঠিয়ে প্রচলিত কিছু পরীক্ষা করতে পারবেন। আপনার বংশ-কুলুজি-ঠিকুজি বিস্তারিতভাবে জানতে পারবেন। তবে এসব বাণিজ্যিক পরীক্ষা আসলে একজন ব্যক্তির ডিএনএ-র খুব ছোট একটা অংশ নিয়ে করা হয়। এটা হয়তো জিনোমের এক শতাংশেরও সমান নয়। আমি একটু ভিন্ন কিছু করতে চাচ্ছিলাম। যেটা গতানুগতিকের চেয়ে রোমাঞ্চকর। আমি আমার জিনোম অনুক্রম পুরোটাই সিকোয়েন্স করে ফেলেছি। আমার জিনোম অনুক্রমের সকল কাঁচা-উপাত্ত যোগাড়ও করে ফেলেছি। এটা হলো সেই উপাত্ত যা দিয়ে জীববিজ্ঞানীরা গবেষণা করেন কিভাবে অজস্র জিন একজন মানুষকে আলাদাভাবে গড়ে তোলে।
জারস্টেইনের ম্যাকবুকে উঁকি দিলে দেখা যাবে বিশাল ফাইল স্থানান্তরিত হচ্ছে। সে ফাইলের প্রতিটি লাইন A, T, G ও C অক্ষরের এলোমেলোভাবে বিন্যস্ত। এরকম অজস্র লাইন ধারাবাহিকভাবে সাজানো। প্রতিটি লাইনের সাথে আবার ভিন্ন ভিন্ন কলামে আরো কিছু উপাত্ত সঙ্গ দিচ্ছে। কোন কলামে অর্থহীন কিছু সংকেত, বাকিগুলোতে বিভিন্ন সংখ্যা। অবোধ্য, কিন্তু রহস্যময়। সব মিলিয়ে এরকম এক’শ-বিশ কোটি সারি।

জার্সটেইনের কম্পিউটারে আমার জিনোম স্থানান্তরিত হতে দেখে খানিকটা বিহ্বল হয়ে পড়ি। সেই ১৯৯০-এর দশকে আমি ডিএনএ নিয়ে লেখালেখি শুরু করি। সেটা এমন এক সময় যখন মানব জিনোম সিকোয়েন্স ধরা হতো মঙ্গলে মানুষ প্রেরণ করার মতোই অরাধ্য। শতশত বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টা আর তিনশ কোটি ডলার খরচ করার পর ২০০১ সালে প্রথম মানব জিনোমে কি লেখা আছে তা পাঠোদ্ধার করা হয়। তখন থেকে ডিএনএ অনুক্রমকরণের খরচ ক্রমাগতই কমা শুরু করে। সাথে সাথে অনুক্রমকরণ প্রযুক্তি আরো নিখুঁত হতে থাকে। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত প্রায় দেড়লাখ মানুষের জিনোম অনুক্রম পাঠোদ্ধার করে ফেলেছেন।
তবে গবেষণার জন্য জিনোম অনুক্রম করা সাম্প্রতি জনপ্রিয় হয়ে গেলেও খুব অল্প লোকজনই নিজেদের জিনোম অনুক্রমের উপাত্ত নিজের হাতে পান। আর সেসব হাতে গোনা ভাগ্যবান ব্যক্তি সচরাচর জিনোমের ভিত্তিতে সতর্কভাবে লেখা প্রতিবেদন পান। আমার মতো নিজের জিনোমের কাঁচা-উপাত্ত সংগ্রহ করার ঘটনা শোনাই যায় না। সাংবাদিকদের মধ্যে নিজ জিনোমের উপাত্ত আমিই সম্ভবত প্রথম হাতে নিয়েছি।
গত কয়েক মাস ধরে আমি জারস্টেইনসহ দুই ডজন বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করেছি যারা আমার জিনোমে কি আছে তা খুঁজে পেতে সাহায্য করবেন। নিজেদের সময় ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নিয়ে তারা এ অভিযানে উদার-সম্মতি জানিয়েছেন। যেমন সাহায্য করেন স্কুবা ডাইভিঙের গাইডেরা, সাগরতলে গভীর গিরিখাতের মধ্যে নের্তৃত্ব দেয়ার সময়ে।
এ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমি নিজের সম্পর্কে বেশ অনেক কিছুই জেনেছি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো — মানব জিনোম সম্পর্কেও আমার খানিকটা জ্ঞানগম্যিও হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন এ গবেষণাক্ষেত্রে যে সব অগ্রসর গবেষণা করছেন, সেটাও খানিকটা বোধগম্য হচ্ছে।
আমি কি শিখেছি জিনোম ব্যবহার করে? লক্ষ লক্ষ বছর আগেরকার আমাদের প্রাক-মানব উৎপত্তির ঘটনা, আমার জিনোমের ঠিক কোন কোন ডিএনএ নিয়নন্ডারথাল মানব থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, সেগুলো আমার শরীর-স্বাস্থ্যে কি প্রভাব ফেলতে পারে ইত্যাদি। আরো জেনেছি আমার কোন কোন জিনের একাধিক অনুলিপি রয়েছে, আর কোন ডিএনএ খন্ডাংশ আমার নেই যা অন্যান্য মানুষের মাঝে সচরাচর থাকে। আমার কিছু কিছু প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গাঠনিক মডেল দেখেছি। পর্যবেক্ষণ করেছি কিভাবে মিউটেশন এসব প্রোটিনের কাজের ধরণ বদলে দিয়ে আমাকে কিছু রোগের প্রতি দূর্বল করে তুলেছে। হয়তো সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমি উপলদ্ধি করেছি, তা হলো বিশেষজ্ঞদের জন্য এখনো জিনোমের অর্থ উদ্ধার করা কতটা কঠিন।
নিজের জিনোম থেকে আমি কি জেনেছি, তা আগামী অধ্যায়ে ধারাবাহিকভাবে বলবো। পৃথিবীর কয়েকজন শীর্ষ জিনোম গবেষকদের সাথেও আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব। আশা রাখি, পাঠক আপনিও আমার সাথে হার্ড ড্রাইভের রহস্যময় উপাত্তে কি আছে তার পাঠোদ্ধার করবেন।
প্রচ্ছদ ছবি: জিনোম সাগরে স্কুবা ডাইভারদের মতো ডুব। ছবি STAT থেকে নেয়া।
Leave a Reply to Md Rashidur RahmanCancel reply