প্রায়ই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ভ্রমণকারীদেরকে সাহস যোগাতে বন্য প্রাণীদের সম্পর্কে একটি কথা বলা হয়ে থাকে, “আপনি তাদেরকে যতটা না ভয় পান, তার থেকেও বেশি তারা আপনাকে ভয় পায়।“ ভাল্লুক, পুমা, চিতা ইত্যাদি প্রাণীরা আমাদেরকে তাদের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে ভীতি দেখিয়ে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু মানুষ এই প্রাণীদের তুলনায় ধীর এবং দুর্বল। তাহলে এই প্রাণীরা কেন আমাদেরকে ভয় পাবে? আর যদি ভয়ই পায়, তাহলে প্রতি বছর বন্য প্রানীদের আক্রমণে হাজার হাজার মানুষ মারা যায় কেন?
জন্তুরা যখন ভয় পায়
আমাদেরকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রমণ না করার পেছনে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। শারীরবৃত্তীয় অবস্থান থেকে যদি দেখি, তাহলে আমরা মূলত দুপেয়ো (Bipedal) প্রাণী, মানে আমরা মূলত ২ পায়ের উপরে ভর দিয়েই চলি। University of Wisconsin-Madison এর জীবাশ্মবিদ জন হকসের মতে, মূলত বিবর্তনের ফলে মানুষ চার হাত-পায়ে চলন থেকে লম্বা দু’পায়ে চলাফেরার বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। হকস বলেন, “আমরা দ্বিপদী হওয়ায় বন্য জন্তুদের জন্য একটি হুমকি তৈরি হয়েছে।“
আমরা যখন প্রাইমেট যেমন শিম্পাঞ্জি, গরিলা-এদের দিকে তাকাই, তখন তারা প্রয়োজন হলে কখনো কখনো আমাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। তবে বেশিক্ষণ পারে না। কিন্তু, স্বভাবত আমরা দ্বিপদী হওয়ায় উচ্চতায় তাদের থেকে লম্বা। এটা ঐসমস্ত প্রাণীদেরকে বেশ চমকে দেয়। ফলে তারা আমাদেরকে ‘ভয়ঙ্কর’ মনে করে। বড় বন্য প্রাণীদের দ্বারা কম আহত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, হিংস্র জন্তুদের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং তারাও অসহায় হয়ে পড়ছে।
আমরা যখন অসহায়
বিবর্তনের ধারায় দ্বিপদ হওয়ায় আমরা ভালোই সুবিধা পাই। কিন্তু, এর আবার নেতিবাচক দিকও আছে। দু-পায়ে আমরা যতটা না দ্রুত দৌড়াতে পারি, তার চেয়েও দ্রুত চারপেয়ে জন্তুরা দৌড়ায়। মানুষের পক্ষে ঘণ্টায় সর্ব্বোচ ২০ মাইল দৌড়ানো সম্ভব। কিন্তু, গ্রিজলি ভাল্লুকের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ৩৫ মাইল। অন্যদিকে, চিতাবাঘের গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ৭০ মাইল। তাহলে পরিসংখ্যানানুসারে কী বোঝা যাচ্ছে? প্রতিরক্ষাহীন অবস্থায় আমাদেরকে কোনো চতুষ্পদী হিংস্র জন্তু যদি ধাওয়া করে, তবে আর রক্ষে নেই! আমরা মাঝে-মধ্যে বন্য প্রাণীর কারণে সাংঘাতিক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হই। ২০০৭ সালে, একদল বন্য বানর ভারতের দিল্লির এক প্রবীণ সরকারী কর্মকর্তাকে আক্রমণ করেছিল। ২০০৩ সালে আলাস্কার কাটমাই জাতীয় উদ্যানে কিছু গ্রিজলি ভাল্লুক আমেরিকান পরিবেশবিদ টিমোথি ট্র্যাডওয়েল এবং তার সাথীদের উপর হামলা চালিয়েছিল। ইতালিতে এক বছরেই বন্য প্রাণীর আক্রমণে ১৬ জন নিহত এবং ২১৫ জন আহত হয়েছেন।
নিজেকে বাঁচানোর উপায়
প্রযুক্তি দিনে দিনে উন্নত হচ্ছে, যার ফলে নিরাপত্তা ও জীবন রক্ষা আরও সহজ হয়েছে। আমাদের কাছে এখন এমন সব হাতিয়ার এবং অস্ত্র রয়েছে, যা দিয়ে নিজেদেরকে বন্য জন্তুদের হাত থেকে নিরাপদ রাখা বেশ সহজ হয়ে উঠেছে। যেমনঃ বিয়ার পেপার স্প্রে, বন্দুক ইত্যাদি। অনেকে বিপদের সময় শক্ত পাথরও ব্যবহার করে, তবে সেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভয়ঙ্করও হতে পারে।
হকস আরো বলেন যে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জীর মতো বড় প্রাইমেটরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। আর তাই হিংস্র প্রাইমেটদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে গেলে মানুষ হিসেবে আমাদেরকেও গ্রুপ আকারে থাকার কোনো বিকল্প নেই। একারণেই দ্বিপদী হওয়ার পাশাপাশি সামাজিকভাবে দলবদ্ধতা আমাদেরকে হিংস্র প্রাণীদেরকে অনেক সময় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। যদি আপনি হাইকিং করেন, বিশেষ করে ভাল্লুকের আস্তানার আশেপাশে, তবে অবশ্যই দলবদ্ধতা বজায়ে রাখবেন। তা না হলে যেকোনো সময় আপনাকে আক্রমণের শিকার হতে হবে। একারণেই ব্যাকরণ বইয়ের কোনো এক পৃষ্ঠায় লেখা থাকে, “একতাই বল”!
কখনো কখনো প্রযুক্তি নয়, বরং বুদ্ধিমত্ত্বা এবং উপস্থিত কৌশলও অনেক জরুরি। একটা বিষয় আমরা অনেকেই জানি, সেটা হলো A friend in need is a friend indeed এর গল্পটা, যেখানে একজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ভাল্লুকের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস ও চোখ বন্ধ করে মাটিতে শুয়ে পড়ে। আর সে বেঁচেও যায়! যদি ভাল্লুক আপনার কাছে আসে, তবে না দৌঁড় দিয়ে মাটিতে পড়ে যান, বেঁকে পড়ুন – আপনার হাঁটু আপনার বুকে টানুন, আঙ্গুলগুলিকে আটকে দিন এবং হাত ঘাড়ের পিছনে রাখুন। এটি আপনাকে অধিক সুরক্ষা প্রদান করবে। আর যদি আশেপাশে গাছ থাকে, তবে গাছের ঘাড়ের উপর উঠে পড়ুন। কিন্তু, বাঘের ক্ষেত্রে ঐসব নাটক না করাই ভালো। এক্ষেত্রে ৩টি উপায় আছেঃ শান্ত থাকার চেষ্টা করে ধীরে ধীরে পেছনে গিয়ে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিতে হবে, বুক ফুলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ হওয়ার অভিনয় করতে হবে এবং শব্দের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন করতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৌশল এবং প্রকৌশলের আশীর্বাদ আপনাকে বন্য জন্তুদের হাত থেকে বাঁচাবে।
মানুষের নেতিবাচক আধিপত্য
১৯৯৩ সালের বিপন্ন প্রজাতি আইন (Endangered Species Act of 1973) পাস হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রে বড় শিকারী প্রাণীদেরকে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মানুষেরা Canis lupus প্রজাতির নেকড়ে শিকার করে তাদেরকে আটকে রেখে অনেক সময় বিষ প্রয়োগ করা শুরু করে। International Union for Conservation of Nature এর প্রতিবেদন বলছে যে উত্তর আমেরিকার ফ্লোরিডার অসংখ্য পুমাদেরকে হত্যা করা হয়।
অধিক জনবহুল এলাকায় বসবাসকারী শিকারী জন্তুরা একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। বাস্তুবিদ জাস্টিন সুরাসির মতে, যেসব প্রাণী মানুষের বিপদ থেকে কোনো না কোনো ভাবে রক্ষা পেয়েছে, তারা সম্ভবত এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে শিখেছে। তিনি আরো বলেন মানুষ সম্পর্কে সম্ভবত এসব প্রাণীদের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ধারণা চলে আসে, যার কারণে তারা মানুষকে শিকারী মনে করে তাদেরকে আক্রমণ করা থেকে দূরে থাকে। ইকোলজি লেটার্স জার্নালে প্রকাশিত 2019 সালের একটি গবেষণায়, সুরসি এবং তার সহকর্মীরা ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্টা ক্রুজ পর্বতমালায় রিমোট স্পিকারের মাধ্যমে মানুষের কণ্ঠের রেকর্ডিং বাজিয়েছিলেন। এর ফলে দেখা গেছে যে মানুষের কথা বলার শব্দটি পুমা এবং বেশ কয়েকটি ছোট জন্তুকে (যেমনঃ ববক্যাট) ভয় দেখিয়েছিল। তাদের রেকর্ড করা কথাগুলো ছিল কবিতা এবং প্রবন্ধের অংশ।
উপসংহার
বন্য প্রাণীরা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদেরকে ভয় পায়। আর এই প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ছে। এর প্রভাব দু’রকম হতে পারে। প্রথমত, বন্য পরিবেশে যেকোনো গবেষণা করতে কিংবা ভ্রমণে গেলে নিরাপত্তার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। দ্বিতীয় প্রভাবটাকে নেতিবাচকই বলা চলে। বন্য জন্তুদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টির একটি বড় কারণ হলো আমাদের দম্ভ এবং পরিবেশের বিপর্যয়। এর ফলে তাদের বিকাশ এবং স্বাভাবিক জীবনধারা ব্যহত হচ্ছে। গভীরে গিয়ে চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন যে এটা প্রাণীদের বিপন্নতার একটি পূর্বাভাস।
আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিংস্র জন্তুরা আমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং এর ফল হয় খুবই মারাত্মক। তবে এর মানে এই নয় যে তাদের উপর স্ট্রীম রোলার চালাতে হবে। নিজেকে নিরাপদ অবস্থানে রাখা এবং আক্রমণ প্রতিহত করাটাই প্রকৃত সমাধান। বন্য জন্তুদেরকে বাঁচাতে না পারলে জীব বৈচিত্র্য নষ্ট হবে এবং আমাদেরকেও এর মাশুল দিতে হবে, যেমনটা মালয়েশিয়ায় বাস্তুসংস্থানের নেতিবাচক কৃত্রিম পরিবর্তনের প্রভাবে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণে মিলিয়ন মিলিয়ন ইউএস ডলার ক্ষতি হয়েছিল।
Leave a Reply