জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকার স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। সেই আফ্রিকাতেই এমন এক ম্যালেরিয়ার উদ্ভব ঘটল, যাকে আর্টেমিসিনিন (Artemisia annua নামক উদ্ভিদ থেকে তৈরি ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক) দ্বারা পরাস্ত করা সম্ভব না। ২০০০ সালের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই পরজীবীগুলোর উদ্ভব ঘটে, যা ক্রমাগত ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধককে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দিচ্ছে। এই ঝুঁকিতে আফ্রিকা অগ্রগামী। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যানানুসারে ঐ অঞ্চলে ম্যালেরিয়ায় প্রায় ৪,০৯,০০০ মানুষ মারা গিয়েছে। দুটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র প্রমাণ দেয় যে ভয়ঙ্কর ম্যালেরিয়া এখন ঐ মহাদেশে পা রেখেছে।
স্যান ফ্রান্সিসকোতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ম্যালেরিয়া গবেষক ফিলিপ রোজেনথাল এই ফলাফল গুলোকে “গেম-চেঞ্জার” বলে আখ্যা দিয়েছেন। আপাতত, এমন কোন প্রমাণ নেই যে, যেটা বলে দেয়, “বর্তমান চিকিৎসা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে”। কারণ ঐ পরজীবীদেরকে পরাস্ত করতে বেশ খানিকটা সময় লাগে! রোজেনথাল বলেছেন, “”আমি মনে করি না এটি আতঙ্কিত হওয়ার কারণ। তবে পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন ঔষধ নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিৎ।“
Plasmodium falciparum এক ধরণের মশাবাহিত পরজীবী, যেগুলো আফ্রিকাতে সর্বাধিক ম্যালেরিয়া সৃষ্টি করে। এই জীবাণু নিয়ে আরেকটা ঝামেলা আছে; পরজীবীটির দেহে খুব দ্রুত মিউটেশন ঘটে। এটি ১৯৫০ এবং ৬০ এর দশকে ক্লোরোকুইনের (প্রাথমিকভাবে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, যেটা ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ এবং আধিপত্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৯০ এর দশকে আর্টেমিসিনিনের আগমন ঘটে, যেটা এই ঊর্ধগামী হারকে কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এখন আর্টেমিসিনিনকে সাধারণত ACTs বা Artemisinin-based combination therapies এ বেশ কয়েকটি সেকেন্ডারি ঔষধের সাথে ব্যবহার করা হয়। এটি গুরুতর ক্ষেত্রে শিরাপথে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ম্যালেরিয়ার পরজীবী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ACTs-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। একাধিক গবেষণা ঐ পরজীবীগুলোর দেহে kelch13 নামের একটি জিনের কথা বলেছে, যার মধ্যে মিউটেশন প্রতিরোধী ক্ষমতা রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা দল আফ্রিকাতে নতুন সমীক্ষা চালিয়েছে, যেগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল ম্যালেরিয়ার বাহক, মিউটেশন প্রতিরোধী ক্ষমতা এবং রোগীদের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করা। এমনি দুটি সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায়, যে হারে ঔষধ রোগীদের শরীর থেকে পরজীবীকে নির্মূল করে, এই মিউটেশনগুলি সেই হারকে কমিয়ে দিচ্ছে।
২০২১ এর এপ্রিলের The Lancet Infectious Diseases এ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটির স্থান ছিল রুয়ান্ডা। এই গবেষণার পর্যবেক্ষণকৃ্ত বিষয়টি ছিল তিনটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ২০১৮ সালের বেশ কয়েকজন অসুস্থ শিশু। যাদের ম্যালেরিয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে তাদের আর্টেমেথার-লুমেফেনট্রিন এর মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছিল। এর কিছুদিন পরে বেশিরভাগ রোগীই পরজীবীগুলি থেকে প্রতিকার পেয়েছিল। কিন্তু ১০% এরও বেশি রোগী তখনও সংক্রামিত ছিল এবং তাদের দেহের পরজীবীগুলি kelch13 বহন করছিল। বিশেষজ্ঞরা এই অনুসন্ধানকে “আফ্রিকাতে আর্টেমিসিনিনের বিরুদ্ধে আংশিক প্রতিরোধের প্রথম নথিভুক্ত প্রমাণ” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
জুনটেন্ডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ তোশিহিরো মিতার নেতৃত্বে দ্বিতীয় দলটি উত্তর উগান্ডায় ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণা করেছে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দলটি গুলুর সেন্ট মেরি’স হসপিটাল ল্যাকোরে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা ম্যালেরিয়া রোগীদেরকে ইন্ট্রেভেনাস-আর্টেসুনেট (জলে দ্রবণীয় আর্টেমিসিনিন ডেরিভেটিভ) দিয়ে গবেষণা চালিয়েছিল। এই পরীক্ষণে গবেষকরা দিনে কয়েকবার রোগীর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছেন এবং পরজীবীর সংখ্যা কত দ্রুত হ্রাস পেয়েছে তা পরীক্ষা করেছেন। এক্ষেত্রে ২৩০ জন রোগীর মধ্যে ১৪ জনে পরজীবীর আধিক্য অর্ধেক করতে ৫ ঘন্টার বেশি সময় লেগেছে, যা বিলম্বিত প্রতিক্রিয়ার ইঙ্গিত। অর্থাৎ, ঐ ১৪ জনের দেহে ম্যালেরিয়ার জীবাণুরা বেশ শক্তিশালী একটা অবস্থান তৈরি করেছিল। গবেষকেরা সেপ্টেম্বরে দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনকে (এনইজেএম) জানায় যে ঐ রোগীদের মধ্যে ১৩ জনের দেহের জীবাণুতে kelch13 পাওয়া গিয়েছিল।
ওয়াল্টার এন্ড এলিজা হল ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল রিসার্চের সংক্রামক রোগের মহামারী বিশেষজ্ঞ আইভো মুলারের মতে আর্টেমিসিনিন সংশ্লিষ্ট থেরাপিগুলোই Plasmodium falciparum এর সংক্রমণে সংঘটিত ম্যালেরিয়ার প্রতিকারে সর্বাধিক কার্যকরী। কিন্তু, ঐ দু’টি গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে Plasmodium falciparum আর্টেমিসিনিনের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম, যা আমাদের জন্য সত্যিই উদ্বেগজনক। আর এর জন্য আপাতত বিজ্ঞানীরা kelch13 জিনকে বিশেষ ভাবে দায়ী করেছেন।
নতুন দু’টি গবেষণার জেনেটিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে ঔষধ-প্রতিরোধী মিউটেশনগুলো স্থানীয়ভাবে বিকশিত হয়েছিল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে এর আগমন ঘটেনি। পূর্বের গবেষণাগুলো থেকে উভয় দলই দেখেছে যে ২০১০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে kelch13 মিউটেশন দেখা দেয় এবং শেষের দিকে এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই মাত্রা রুয়ান্ডায় ৭.৪% থেকে ২০% হয় এবং উগান্ডায় ৩.৯% থেকে ১৯.৮% হয়।
তোশিহিরো মিতা বলেছেন, “এটি বলে দেয় যে আর্টেমিসিনিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশ কয়েক বছর আগে আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু এর ভৌগলিক বিস্তার অস্পষ্ট রয়ে গেছে। সম্ভাবনা আছে যে এই পরজীবীটি উত্তর উগান্ডার কাছাকাছি অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে ঐ অঞ্চলের কোন তথ্য নেই।“ গবেষকগণ বলছেন যে আর্টেমিসিনিনের অত্যধিক ব্যবহার বা অপব্যবহার আফ্রিকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে কিনা তাও স্পষ্ট নয়।
জুন্টেন্ডো ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজিস্ট এবং NEJM এর লেখক বেতি বালিকাগালার মতে ACTs-এ সহযোগী বা সেকেন্ডারি ঔষধের ব্যবহার পরজীবী দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। আর এসব সহযোগী ঔষধের ব্যবহারের ফলে পরজীবীরা অনেক্ষেত্রেই পরাস্ত হয়।
গবেষকেরা এখন বলছেন যে প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার পাশাপাশি নতুন কৌশল প্রয়োগ করার কথা ভাবতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিকিৎসকেরা আলাদা বিভিন্ন সহযোগী ঔষধের মাধ্যমে কম্বিনেশন থেরাপির কার্যকারিতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ACTs-এ আরেকটি মাধ্যমিক ঔষধ যুক্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করে রোজেনথাল বলেছেন,”আর যদি দু’টি ঔষধ কাজ না করে, তবে তিনটি দিয়ে চেষ্টা করুন।“ তিনি বলেছেন যে এই পদ্ধতিটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলিতে ভালো কার্যকারিতা দেখিয়েছে।
USTTB এর জেনেটিক এপিডেমিওলজিস্ট আবদুলায়ে জিমদিই বলেছেন, ”আর্টেমিসিনিনের কার্যকারিতা হ্রাস একটি গুরুতর সতর্কতা চিহ্ন। এ ব্যাপারে আমাদেরকে সক্রিয় হতে হবে। কারণ, ঔষধ-প্রতিরোধী পরজীবিদের আক্রমণে শিশুদের মৃত্যু ঘটা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারি না।“
এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন? আফ্রিকাকে কি এই অভিশাপ থেকে দ্রুতই বাঁচানো সম্ভব? নাকি এখনো আরো অনেক প্রাণকে বিসর্জন দিতে হবে?
Leave a Reply