মিথ আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি শব্দ। ইংরেজি এই শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ আপনাদের জানা আছে? আমি বলে দিচ্ছি। পুরাকথা বা জনশ্রুতি। এই মিথের সাথে যদি কখনও বিজ্ঞানের মিশেল ঘটে? ধুর, সেটাও কি কখনও সম্ভব? জনশ্রুতি আর বিজ্ঞান, তারা কিভাবে একে অপরের পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে? এ যে তেল আর পানির মিশ্রণের কথা মনে করিয়ে দেয়, যারা একই মিশ্রণে থেকেও না মিশে গিয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে!
আজ আপনাদের এমনই এক বিজ্ঞান ঘেঁষে চলা আধুনিক মিথের গল্প শোনাব।
বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বেশ কিছু জায়গা নিয়ে কিছু মিথ আমরা শুনেছি। অনেকেই বলেন, এই সব জায়গায় রহস্যময় সব ঘটনা ঘটে যা মানুষের ব্যাখ্যার অতীত। অনেকেই আবার বলেন, এসব রহস্যময় কাজকারবারের পেছনে আসলে মানুষেরই হাত আছে।
ইন্টারনেটের কল্যাণে এরিয়া ৫১ শব্দটির সঙ্গে আপনারা হয়ত অনেকেই পরিচিত। পরিচিত হবার একটি বড় কারণ, এখানে সংঘঠিত হওয়া আজব সব পরীক্ষা ও গবেষণা নিয়ে প্রচালিত মিথ। এটি একটি হাইলি ক্লাসিফাইড আমেরিকান বিমান বাহিনী বেজ, যেটি ২য় বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পর প্রতিষ্ঠিত হয়।
এটি আমেরিকার নেভাডার লিংকন কান্ট্রিতে অবস্থিত। অবস্থানটা আমেরিকার জনপ্রিয় শহর লাস ভেগাস থেকে প্রায় ৮৫ মাইল উত্তরে। মূলত নেভাডা মরুভূমির মধ্যে গ্রুম লেক নামের এক শুকনো লেকে গজিয়ে ওঠা এই ফ্যাসিলিটি নিয়ে শুরু থেকেই মানুষের আগ্রহের কোন কমতি ছিল না।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমেরিকার সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইএ এর বিভিন্ন ডকুমেন্টে একে এরিয়া ৫১ বলে উল্লেখ করা হয়। এই আমেরিকান এয়ারর্ফোস বেজটির আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এখনও তেমন কিছু জানেন না।
এমনকি এই অঞ্চলের উপর দিয়ে সরকারী অনুমতি ব্যাতীত কোন আকাশযানের চলাচলকে সম্পূর্ণ ভাবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
অনেকেই ধারণা করেন, খুব সম্ভবত এখানে পরীক্ষামূলক আকাশযান এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করা হয়। এখানকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এতটাই সুরক্ষিত যে কন্সপিরেসী থিয়োরিষ্টরা তো প্রায়ই বলেন, এখানে বোধহয় ইউএফও নিয়ে গবেষণা, এমনকি হয়ত তৈরিও করা হয়! কারণ জায়গাটির ভেতরে ঢোকবার চেষ্টা করতে গেলে শুরুতেই আপনার সামনে আসবে অসংখ্য সর্তকতা বার্তা লেখা ব্যানার, ইলেক্ট্রনিক সার্ভিলেন্সের বাধা। এগুলো যদি কোন রকমে আপনি উতরে যেতে পারেন, পরবর্তী ধাপে আপনাকে বাধা দেবার জন্য অসংখ্য অস্ত্রধারী গার্ড কিন্তু ঠিকই প্রস্তুত রয়েছে!
যদিও কখনোই একে গোপন বেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয় নি, তারপরও এখানে যত গবেষণা করা হয় সেগুলো টপ সিক্রেট এর অন্তর্গত।
এরিয়া ৫১ এমন একটি যায়গায় অবস্থিত, যার পাশেই রয়েছে আরেকটি সংরক্ষিত এলাকা, নেভাডা টেস্ট সাইট। ১৯৫০ থেকে ১৯৯০ সালের ভেতর এখানে অনেকগুলো আমেরিকার পারমাণবিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছিল।
আমেরিকাতে প্রথমবারের মত ফ্রিডম অফ ইনফরমেশন এ্যাক্ট পাস হবার পর, ২৫ জুন ২০১৩ সিআই এ প্রথমবারের মত জনসম্মুক্ষে এই বেজটির ইতিহাস এবং গঠনের ব্যাপারে অনেকগুলো ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট প্রকাশ করে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এয়ারফোর্স জায়গাটি অধিগ্রহণ করে, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল লকহেড ইউ – ২ এয়ারক্রাফট এবং এস আর – ৭২ ব্ল্যাকবার্ডের উড্ডয়ন পরীক্ষা করা। এই এরিয়া ৫১ এর চারপাশের এলাকা, পাশের একটি ছোট শহর মিলে একটি বিখ্যাত টুরিষ্টস্পট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
এরিয়া ৫১ সম্পর্কে গোপনীয়তার ধরণ, ক্লাসিয়াইড এয়ারক্রাফট গবেষণার সাথে এর সম্পর্ক এবং এখানে সংঘঠিত বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত ঘটনা এই জায়গাটিকে আধুনিক ইউ এফ ও এবং কন্সপিরেসি থিওরীর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। নিচে কিছু দাবী উল্লেখ করা হলো, যেগুলো কন্সপেরিসি থিয়োরিস্টরা হরহামেশাই এই এলাকাটি সম্পর্কে করে থাকেন।
- তারা মনে করেন এরিয়া ৫১ হলো একটি কেন্দ্র যেখানে এলিয়েন টেকনোলজি সংরক্ষণ, পরীক্ষা এবং রিভার্স ইঞ্জিয়ারিং করা হয়। দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া এলিয়েন এয়ারক্রাফটের (এমনকি রসওয়েল ইউএফও দুর্ঘটনা থেকে প্রাপ্ত) জিনিসপত্র নাকি এখানে রয়েছে!
- তারা এখানে নাকি সেই দুর্ঘটনায় মরে যাওয়া ও বেঁচে থাকা গ্রে এলিয়েনের শরীরের উপরও গবেষণা করে। এমনকি এখানে এলিয়েন টেকনোলজীর উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের উড়োজাহাজ ও তৈরি করা হয়!
- তারা এখানে বিভিন্ন ধরনের উন্নত অস্ত্র তৈরি করে যেটি মুলত আমেরিকার স্ট্রাটেজিক ডিফেন্স ইনিসিয়েটিভ (এসডিআই) এবং অন্যান্য অস্ত্র নির্মাণ কর্মসূচিতে ব্যবহৃত হয়।
- আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখানে বিভিন্ন গবেষণা হয়!
- এখানে নাকি তারা টাইম ট্রাভেল এবং টেলিপোর্টেশন প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করে ! আশ্চর্য ব্যাপার!
- শোনা যায়, তারা এখানে বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক প্রোপালশন সিস্টেম নিয়ে কাজ করে যেটি বিখ্যাত অরোরা প্রোগ্রাম এর সাথে সম্পর্কিত।
অনেক ধরনের তত্ত্ব প্রচলিত আছে এখানকার ভূর্গভস্থ ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে। এটি পাপোস লেকে অবস্থিত (অনেকে আবার একে এস—৪ লোকেশন ও বলে থাকেন ), যেখানে এলিয়েন টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা করা হয়। আপনি যদি প্রচলিত স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এলাকাটি খোঁজার চেষ্টা করেন, আপনি গ্রুম ড্রাই লেকের ল্যান্ডিং স্ট্রিপ গুলো সহজেই দেখতে পাবেন।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই পাপোস লেকটি কে কিন্তু আপনি গুগল ম্যাপে দেখতে পাবেন না। এই বেজটি ৫০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই অস্বাভাবিক ভাবে এই অঞ্চলে ইউএফও এর আনাগোনা বেড়ে যায়। এটা সাধারনত সন্ধার দিকেই বেশি দেখা যেত, যখন বিভিন্ন এয়ারলাইনের পাইলটরা পশ্চিমের দিকে যেতেন। ইউ এফ ও গুলো ইউ-২ বিমানের রুপালী ডানায় অস্তমিত সূর্যের আগুনে রং ধারণ করত। এরকম অসংখ্যা ইউএফও দেখার ঘটনা তখন এয়ার ফোর্সের প্রজেক্ট ব্লু বুক এ লিপিবদ্ধ করা হয়। প্রজেক্ট ব্লু বুক মুলত বিভিন্ন ধরনের ইউ এফ ও দেখার ঘটনাগুলো অনুসন্ধান করে সরকারকে জানাত।
অনেক মানুষই এই কন্সপিরেসি থিয়োরী গুলো সত্য বলে দাবি করেন। এদের মধ্যে অন্যতম হল বব লাজার যিনি ১৯৮৯ সালে দাবি করেন যে, তিনি একটা সময়ে কাজ করতেন এই এরিয়া ৫১ এর সেক্টর-০৪ এ। তিনি বলেন, তিনি এখানে এলিয়েন স্পেস ক্রাফ্ট নিয়ে গবেষণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, যে কার্জক্রমটি নাকি সরাসরি আমেরিকা সরকার তত্ত্বাবধান করে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত একটি প্রামান্য তথ্যচিত্রে বব লাজার পুনরায় তার এই দাবি পুর্ণব্যক্ত করেছিলেন।
একই ভাবে, ১৯৯৬ সালে ড্রিমল্যান্ড নামে একটি তথ্যচিত্রে ৭১ বছর বয়সের একজন মেকানিক্যান ইঞ্জিনিয়ারের সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়, যিনি দাবি করেন, ১৯৫০ এর দশকে তিনি এরিয়া ৫১ এর একজন কর্মী ছিলেন। তার দাবি অনুযায়ী তিনি একটি ফ্লাইং ডিস্ক সিমুলেটর এর তৈরিতে ছিলেন, যেটি মুলত একটি দূর্ঘটনায় পতিত হওয়া ইউ এফ ও এর অংশ থেকে পুনরায় তৈরি করা হয়েছিল।
বিভিন্ন বই, উপন্যাস, চলচিত্র, টিভি অনুষ্ঠানে এরিয়া ৫১ কে ব্যবহার করা হয়েছে বর্হিজাগতিক প্রাণ, টাইম ট্রাভেল, ইউ এফ ও এর আড্ডা হিসেবে। ১৯৯৬ সালের বিখ্যাত চলচিত্র ইন্ডিপেনডেন্স ডে, ইন্ডিপেনডেন্স ডে: রিসার্জেন্স এ এই জায়গার কথা এসেছে।
১৯৯৭ সালে ডেভিড ডারলিংটন একটি নন ফিকশন বই লেখেন, এরিয়া ৫১: দ্যা ড্রিমল্যান্ড ক্রনিকলস নামে। বিখ্যাত টিভি সিরিজ, দ্যা এক্স ফাইলস এর বেশ কয়েকটি পর্বেও এর কাল্পনিক চিত্র দেখানো হয়েছে।
এমনকি টিভি সিরিজ সেভেন ডেজ, স্টারগেট এসজি—১, হ্যানগার ৫১ সহ বহু জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে এই কন্সপিরোসী থিয়রীকে ব্যবহার করা হয়েছে।
আমার প্রশ্ন হল, যদি এরিয়া ৫১ তে আসলেই কিছু না থাকে, শুধুমাত্র একটি মিলিটারী বেসই হবে সেটা, তাহলে এত রাকটাক কেন? কেনই বা প্রতিষ্ঠিত হবার এতগুলো বছর পর এব্যাপারে আমেরিকার সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিক ভাবে বিবৃতি দেয়নি!
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে। যা রটে, তার কিছু তো বটে! হয়তো এখানে রহস্যময় কোন কিছুই নেই, উন্নত প্রযুক্তির বিমান বা প্রপালশন সিস্টেম নিয়েই এখানে গবেষণা চলছে। আবার কন্সপিরেসি থিয়োরিষ্টরা যেসকল দাবী করে আসছেন নিয়ে তার কিছু অংশ কি সত্য হতে পারে না? হতে পারে না সেই সত্তরের দশক থেকে চলে আসা মিথের কিছুটা বাস্তবতা? সেই রসওয়েল, এলিয়েন কিংবা ইউ এফ ও নামের সেইসব ছাইপাশের বাস্তব উপস্থিতি?
একদিন সময়ই জবাব দেবে এই সব প্রশ্নের।
তথ্যসূত্র:
- Area 51 and aliens: The myth, meme, and the strange reality, explained – Vox
- Strategic Defense Initiative (SDI) – Atomic Heritage Foundation
- Aurora programme – Wikipedia
- 18 Incredible Experiences along Famous ET Highway – Travel Nevada
- The X-Files – Rotten Tomatoes
- Area 51 details left out of Netflix’s Bob Lazar documentary – DigitalSpy
Leave a Reply