পৃথিবীর হার্টবিট কি শরীরের উপর প্রভাব ফেলে?

অলসভাবে ইন্টারনেটে ঘুরাঘুরি করতে করতে পৃথিবীর হার্টবিটের খোঁজ পাই। অবাক হলেন? হুম, আমিও প্রথম দেখায় অবাক হয়েছিলাম। পরে জানতে পারি যে এটা এমন একটা বিষয়, যেখানে পদার্থবিজ্ঞান আর জীববিজ্ঞান সহাবস্থান করছে। কিন্তু, বাংলায় এ ব্যাপারে তেমন কোনো কন্টেন্ট পেলাম না। তাই আমিই লিখতে বসে গেলাম।

শুম্যান রেজোন্যান্স (Schumann Resonances বা SR) হলো পৃথিবীর আয়নোস্ফিয়ারে উৎপন্ন তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গের এক সেট ফ্রিকোয়েন্সি। এই ফ্রিকোয়েন্সিগুলো 7.83 Hz থেকে শুরু হয়। একে পৃথিবীর “হার্টবিট” বলা হয়। এটি নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা করা হয়েছে, কারণ বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন যে এই বিশাল পৃথিবীর পাশাপাশি মানুষের উপরেও এর প্রভাব রয়েছে। কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে এই কম্পাঙ্কগুলো আমাদের মস্তিষ্কের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৫০ বার পৃথিবীর চারপাশে বজ্রপাতের ঝলকানি নিম্ন-ফ্রিকোয়েন্সির তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ (Electromagnetic Wave) তৈরি করে, যা পুরো গ্রহকে ঘিরে রাখে। আমাদের বায়ুমণ্ডলের নিম্ন আয়নোস্ফিয়ার অংশে প্রায় ৬০ মাইল উপরের দিকের তরঙ্গগুলিতে শুম্যান রেজোন্যান্সগুলির উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়। এরা আয়নোস্ফিয়ারের এমন জায়গায় অবস্থান করে, যেখানে সৌর বিকিরণের প্রভাবে নিরপেক্ষ গ্যাসীয় পরমাণু থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া চার্জিত আয়ন রয়েছে। এটি আয়নোস্ফিয়ার কর্তৃক তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ গ্রহণ (Capture) করতে সাহায্য করে।

Schumann resonances - Wikipedia
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে শুম্যান রেজোনেন্সের চিত্র

ভূপৃষ্ঠের বেতার তরঙ্গগুলো আয়নোস্ফিয়ার ভেদ করে আর উপরে যেতে পারে না বলে এই স্তর থেকে তারা প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। একারণে শুম্যান রেজোন্যান্স আয়নোস্ফিয়ারের বদৌলতে ভূপৃষ্ঠের মানুষদেরকেও প্রভাবিত করতে পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

এখন প্রশ্ন হলো, শুম্যান রেজোনেন্স আসলে আমাদের উপর প্রত্যক্ষ বা প্ররোক্ষভাবে কী কী প্রভাব ফেলে? ২০০৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে বিভিন্ন ধরণের ব্রেইন ওয়েভের সাথে ফ্রিকোয়েন্সিগুলোর সম্পর্ক থাকতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, ২০১৬ সালের একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় যে বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করে জানতে পেরেছেন মানুষের মস্তিষ্ক এবং আয়নোস্ফিয়ার দ্বারা উৎপন্ন বর্ণালীর প্যাটার্ন এবং তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্রগুলি (Electromagnetic Field) মিল সম্পন্ন। এর মানে দাঁড়ায় যে শুম্যান রেজোন্যান্সের মতোই কিছু একটা আমাদের মস্তিষ্কেও আছে। তাই এই রেজোনেন্সের প্রভাবক হয়ে ভূমিকা পালন করাটা খুবই সহজ একটা ব্যাপার।

কেউ কেউ বলেছেন যে সম্মোহন, ধ্যান এবং গ্রোথ হরমোনের মাত্রাকে শুম্যান রেজোনেন্স প্রভাবিত করে। তবে এটার স্বপক্ষে এখনো শক্ত ও শতভাগ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যেগুলো পাওয়া গেছে সেগুলোকে দাঁড় করাতে গেলে আরও কিছু গবেষণার প্রয়োজন। কেউ কেউ বলেন যে অনুরণনের ধাক্কা মানুষ এবং প্রাণীদেরকে প্রভাবিত করতে পারে। আর এই প্রভাবের মাত্রা নিউরনের বার্তা বহন ও রক্ত প্রবাহে বেশি। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে এই অনুরনন বা রেজোনেন্সের ফলে স্মৃতিশক্তি ও উন্নত মানসিক চাপ সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। শুধু তা-ই নয়, অ্যান্টি-জেটল্যাগ, অ্যান্টি-মাইন্ড কন্ট্রোল এবং গ্রাউন্ডিংয়ের মতো সুবিধাগুলিও পাওয়া যায়।

Influence of Geomagnetism and Schumann Resonances on Human Health and  Behavior | HeartMath Institute
শুম্যান রেজোনেন্সের প্রভাবে তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়, যা মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে

কিন্তু, শুম্যান রেজোনেন্স যেহেতু তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সৃষ্টি করে, তাই এটি মাইগ্রেনের ব্যাথা, মানসিক যন্ত্রণা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। এমনকি মারাত্মক স্নায়বিক রোগও হতে পারে।

রক্তচাপ, মেলাটোনিন, ক্যান্সার, প্রজনন, কার্ডিয়াক চক্রের সাথেও এই অনুনাদ জড়িয়ে আছে। রেজোনেন্সটি মেলাটোনিন ভারসাম্য পরিবর্তন করে। মেলাটোনিন এক ধরণের হরমোন, যেটি পাইনাল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। সমগ্র দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিতে মেলাটোনিন রিসেপ্টর রয়েছে। আবহাওয়া, ঋতু ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খায়িয়ে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য এই হরমোন ভূমিকা পালন করে। শুধু তা-ই নয়, মেলাটোনিন টি-লিম্ফোসাইটের মাধ্যমে ইমিউন সিস্টেমে সরাসরি কাজ করে।

বেশ কিছু গবেষনায় দেখা গেছে, 16.7 Hz-60Hz এর মধ্যে ELF ক্ষেত্রের এক্সপোজার মেলাটোনিনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। কিন্তু শুম্যান রেজোনেন্স 27.3Hz এবং 33.8 Hz এরও হতে পারে। এর ফলে মানবদেহে মেলাটোনিনের মাত্রা কমতে পারে। আর এখানেই বিপদ! যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের গবেষকেরা বলছেন, মেলাটোনিনের ঘাটতিতে স্তন, গর্ভাশয় ও প্রোস্টেট ক্যানসারের প্রবণতা বেড়ে যায়। শুম্যান রেজোনেন্স মানুষদের উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, সেই ধারণাটা একদমই নতুন। আর এখানে হাইপোথিসিসের পরিমাণ অনেক বেশি। তারপরেও বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে, যেখান থেকে নতুন ব্যাপার জানা গেছে। কিন্তু, এটা নিয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন। আগামীতে এটা নিয়ে কার্যকরী ও বহুমুখী কিছু কাজ হবে এবং মানবজাতির কল্যাণে হয়ত বা নতুন কোনো হাতিয়ার পাওয়া যাবে।

তথ্যসূত্রঃ
১. Is the Earth’s “heartbeat” of 7.83 Hz influencing human behavior? -Big think
২. WHAT IS SCHUMANN RESONANCE AND WHY IT IS IMPORTANT FOR YOUR HEALTH
৩. Schumann Resonance Affects Melatonin -lynchburgparksandrec.com
৪. Schumann resonances -Wikipedia

লেখাটি 218-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers