মাংকিপক্স ভাইরাস কী?
মাংকিপক্স হলো অর্থোপক্স গণের অন্তর্ভুক্ত একটি ভাইরাস। এটি মূলত একটি দ্বি-সূত্রক DNA ভাইরাস। এর বাইরের আবরণ লিপিডে মোড়ানো। এটি একটি ‘zoonotic’ ভাইরাস। জুনোটিক মানে ‘অন্য প্রাণী থেকে মানুষে’ বা ‘মানুষ থেকে অন্য প্রাণীতে’ যেতে পারে এমন ভাইরাস , কতকটা আমাদের সবার পরিচিত কোভিড-১৯ এর করোনা ভাইরাসের মতোই।
মাংকিপক্স ভাইরাস স্মলপক্স (গুটিবসন্ত) ও চিকেনপক্স (জলবসন্ত) এর ভাইরাস একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত । ১৯৮০-র দশকে স্মলপক্স বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল । কিন্তু বিশ্বজুড়ে বিপুল তৎপরতায় ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রমের ফলে ১৯৮০ সালের পর এটি বিশ্বব্যাপী বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। যদিও মাংকিপক্স রয়ে যায়। মাংকিপক্স রয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ এর বিস্তৃতি নির্দিষ্ট অঞ্চলজুড়ে (মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায়) সীমাবদ্ধ।
কিন্তু সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু মানুষ মাংকিপক্স-এ আক্রান্ত হচ্ছে এবং দিনদিন এ সংখ্যা বাড়ছে।

উৎস:
মাংকিপক্স ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে একটি ল্যাবরেটরিতে সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়। ড্যানিশ ভাইরোলজিষ্ট ম্যাগনাস গবেষণার জন্য সংরক্ষিত কিছু বানরের দেহে ভাইরাসটি শনাক্ত করেন। ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত মানবদেহে এর কোনো হদিশ মেলে নি। তবে ১৯৭০ সালে কঙ্গোর ৯ বছরের বালকের দেহে এটি প্রথম শনাক্ত হয়। রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় কঙ্গোতে এটি ছড়িয়ে পরে। পরবর্তীতে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় ১১ টি দেশে এটি ছড়িয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত কঙ্গোতে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
বাহক:
বানরদের দেহ থেকে মাংকিপক্স প্রথম সনাক্ত করা হলেও এর বাহক মূলত নন-হিউম্যান প্রাইমেট, কয়েক প্রজাতির ইঁদুর ও কাঠবিড়ালি। প্রাণীগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানবদেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটায়।
উপসর্গ:
- তীব্র জ্বরের সাথে মাথা ব্যাথা।
- পিঠসহ সারা শরীরের মাংশপেশীতে ব্যাথা।
- লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
- জ্বর আসার ৩ – ৫ দিনের মধ্যে শরীরে র্যাশ হয়ে পরবর্তীতে সারা শরীরে গুটি গুটি হয় ( গুটিবসন্তের মতো তবে আকারে বড়)।
সাধারণত আক্রান্তের সংস্পর্শে আসার ৫-২১ দিনের মধ্যে উপসর্গ প্রকাশ পায়।

সংক্রমণ:
- আক্রান্ত ব্যাক্তির বা প্রাণির সংস্পর্শে আসলে।
- আক্রান্ত প্রাণির কাঁমড়ে,আঁচড়ে কিংবা আক্রান্ত প্রাণির কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ মাংস খেলে।
- আক্রান্ত ব্যাক্তির বা প্রাণির বডি ফ্লুইড ( কফ,থুথু, রক্তের) মাধ্যমে।
- আক্রান্ত ব্যাক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাধ্যমে ( জামাকাপড়,বিছানাপত্র ইত্যাদি)।
- আক্রান্ত মায়ের দেহ থেকে সন্তানের ভ্রুণে।
- পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যাতীত আক্রান্ত ব্যাক্তির কাছাকাছি থাকা স্বাস্থ্যকর্মীর দেহে।
- শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সংক্রমণের পক্ষে এখনো বিশদ তথ্য না থাকলেও সম্ভাবনা রয়েছে।

চিকিৎসা:
মাংকিপক্সে আক্রান্তদের প্রাথমিকভাবে সাধারণ ভাইরাস সংক্রমিত রোগের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত এন্টিভাইরাল ঔষধ ও ‘ইম্যুনোগ্লুবিউলিন’ প্রয়োগ করে চিকিৎসা করা হচ্ছে। ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যাক্তির এন্টিবডির অভাব পূরণে ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত ঔষধ ইম্যুনোগ্লোবিউলিন; যা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা।
তাছাড়া আক্রান্ত ব্যাক্তির পুষ্টির চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার ও তরল খেতে হবে। মাংকিপক্স একটি সেল্ফ-লিমিটিং ডিজিজ হওয়ায় এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই ( নিজে থেকেই ভালো হয় এমন রোগ; যেমনঃ জলবসন্ত)। তবে রোগীর পরিস্থিতির যেন অবনতি না ঘটে সেজন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। এছাড়া মাংকিপক্সের জন্য কার্যকরী কিছু ঔষুধ থাকলেও সেগুলি খুব একটা উৎপাদন করা হয় না। তার অন্যতম কারণ হলো রোগটির করোনার মতো মহামারী আকারে ছড়িয়ে না পড়া। তাই এর কার্যকর ভ্যাক্সিনও তৈরী হচ্ছে না । তবে স্মলপক্সের ভ্যাক্সিন এ রোগে প্রায় ৮৫% কার্যকর । তবে যারা স্মলপক্সের ভ্যাক্সিন নিয়েছে , যাদের বয়স ৪০ বা এর বেশি, তাদের ক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য। কিন্তু ১৯৮০ এর দশকের পর থেকে স্মলপক্স বিলুপ্ত হওয়ায় এর ভ্যাক্সিন আর উৎপাদন করা হয় না।
তাছাড়াও আক্রান্তের তীব্রতা ও রোগীর সামগ্রিক শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় Tecovirimat (Tecovirimat monohydrate নামে একটি এন্টি-ভাইরাল এজেন্ট) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এটি ইউরোপীয় মেডিকেল এসোসিয়েশন কর্তৃক অনুমোদিত হলেও এখনো সর্বত্র ব্যবহার উপযোগী নয়( সূত্রঃ EMC: European Medical Association)।

সতর্কতা:
মাংকিপক্স সম্পূর্ণ নতুন কোনো রোগ নয়। এর আগেও আফ্রিকায় সহস্রাধিক মানুষ এতে সংক্রমিত হয়েছে। তাদের মধ্যে মৃত্যুহারও খুব একটা বেশি নয়। ২০০৩ সালে আমেরিকাতেও অনেক মানুষ এতে আক্রান্ত হয় কিন্তু এর তীব্রতা কম থাকায় মৃত্যুহার কম। আর মাংকিপক্স এর কাছাকাছি গোত্রের অন্যান্য ভাইরাসের ( গুটিবসন্ত বা জলবসন্ত) মতোই সেল্ফ লিমিটিং ডিজিজ (নিজে থেকেই সেরে যায় এমন রোগ) হওয়া এর অন্যতম কারণ। তবে মাংকিপক্সের নতুন কোনো ধরণ বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদিও এবিষয়ে এখনো বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই। তবে মাংকিপক্স নিয়ে একেবারেই দুশ্চিন্তার যে কিছু নেই তা নয়। মাংকিপক্সে মৃত্যুহার কম হলেও আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে শিশু ও যুবকরা। তাছাড়া গর্ভকালীন সময়ে মা মাংকিপক্সে আক্রান্ত হলে সন্তানের নানান শারীরিক জটিলতা সৃষ্টির ঝুঁকি তো রয়েছেই।
রোগ প্রতিরোধে যা যা করবেন:
- আপনি সংক্রমিত এলাকায় অবস্থান করলে নিজে সচেতন হোন ও সাবধানতা অবলম্বন করুন
- আক্রান্ত ব্যাক্তি অথবা মাংকিপক্স-এর উপসর্গ আছে এমন ব্যাক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।
- দেহে মাংকিপক্সের উপসর্গ দেখা দিলে নিজেকে কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে,যেন আপনার দ্বারা অন্য কেউ আক্রান্ত না হয়।
- সংক্রমিত অঞ্চল থেকে প্রাণিসম্পদ কেনাবেচা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- মাংকিপক্সের উপসর্গযুক্ত প্রাণির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে

মাংকিপক্স কি শুধু সমকামীদের দেহেই ছড়ায়?
প্রথমেই বলে রাখছি, WHO’র প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। আর সাধারণ যুক্তিতে দেখলেও সমকামীরাও মানুষ তারা বিশেষ কেউ নয়। তাই তাদের ক্ষেত্রেই ছড়ায় এটা ঠিক নয়। আর প্রথম মাংকিপক্স এ আক্রান্ত ব্যাক্তি হয়তো সমকামী ছিল এবং তার মাধ্যমে তার কাছাকাছি থাকা আরো সমকামীদের শরীরে ছড়ায়। এবং তাদের মাধ্যমে অন্যদের শরীরে। এইভাবে আক্রান্ত ব্যাক্তিগণের বেশিরভাগই সমকামী। তাই এ বিষয়ে স্বীকৃত কোনো জার্নালে বা WHO, EMC, CDC তে এরূপ কোনো তথ্য নেই যা সমকামীদের এ বিষয় নিয়ে লিখেছে বা সমর্থন করে। তাই এটি স্রেফ একটি গুজব। এতে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না যে মাংকিপক্স শুধুমাত্র সমকামীদের দেহেই ছড়ায়। এমনটা ভাবা অনুচিত হবে যে,”আমরা সমকামী নই তাই আমাদের শরীরে এর কোনো সংক্রমণ হবে না।”
তথ্যসূত্র:
- মাংকিপক্স সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা: Monkeypox/World Health Organisation
- ভাইরাসের উৎস: Wikipedia,
- বর্তমান পরিস্থিতি:Healthline
ইউরোপীয়ান স্বাস্থ্যসংস্থা EMC
Leave a Reply